সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

সম্পত্তিতে হিন্দু বিধবার অংশ বনাম আদালতের দৃষ্টান্ত

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

সম্পত্তিতে হিন্দু বিধবার অংশ বনাম আদালতের দৃষ্টান্ত

১৯৩৭ সালের হিন্দু আইন অনুযায়ী মেয়েরা কোনো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতেন না। তবে বিধবা হওয়ার পর সন্তান নাবালক থাকা অবস্থায় শুধু বসতি বাড়ির অধিকারী হতেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ হাই কোর্ট জানিয়েছে হিন্দু বিধবা নারীরা শুধু বসতভিটা নয়, স্বামীর সব সম্পত্তিতে ভাগ পাবেন। দীর্ঘ ৮৪ বছর পর হিন্দু আইনের এ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রোপার্টি অ্যাক্ট, ১৯৩৭ বাংলাদেশে প্রযোজ্য হলো। এর আগে ২০২০ সালের ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল হিন্দু বিধবারা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন, তবে প্রাপ্ত সম্পত্তি কোনো ধরনের বিক্রি, হস্তান্তরযোগ্য নয়। শুধু ভোগদখলকৃত বলে গণ্য হবে।

১২ অক্টোবর ২০২১ হাই কোর্ট রায় প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছে, ‘সম্পত্তি’ শব্দের অর্থ সব সম্পত্তি যেখানে স্থাবর বা অস্থাবর, বসতভিটা, কৃষিভূমি, নগদ টাকা বা অন্য কোনো ধরনের সম্পত্তি। কৃষিজমি ও বসতভিটার মধ্যে পার্থক্য করার সুযোগ নেই এবং এ ধরনের সম্পত্তি বিধবার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়।

যে ঘটনা থেকে হিন্দু নারীর জীবন ও সম্পদের বৈষম্য দূরীকরণে আদালতের উদ্যোগ সে কেস স্টাডি নিম্নরূপ : খুলনার রাজবিহারী মন্ডলের দুই ছেলে জ্যোতিন্দ্রনাথ মন্ডল ও অভিমন্য মন্ডল। অভিমন্য মন্ডল ১৯৫৮ সালে মারা যান। এ অবস্থায় মৃত ভাইয়ের স্ত্রী (গৌরীদাসী) কৃষিজমি পাবেন না, শুধু বসতভিটা থেকে অর্ধেক পাবেন- এমন দাবি নিয়ে ১৯৮৩ সালে নিম্ন আদালতে মামলা করেন জ্যোতিন্দ্রনাথ। মামলায় পক্ষ যথাযথভাবে না করায় ১৯৯৬ সালে তা খারিজ করে রায় দেয় আদালত। তবে গৌরীর কৃষিজমির সম্পত্তি পাবেন না বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে খুলনার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আপিল করেন জ্যোতিন্দ্রনাথ। আদালত ২০০৪ সালের ৭ মার্চ রায় দেয়। রায়ে বসতভিটা ও কৃষিজমিতে গৌরীদাসীর অধিকার থাকবে বলা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে হাই কোর্টে রিভিশন আবেদন করেন জ্যোতিন্দ্রনাথসহ অন্যরা।

হাই কোর্ট রায়ে বলে, রাজবিহারী মন্ডলের আগে তার পুত্র অভিমন্য মারা যান। গৌরীদাসী অভিমন্যর বিধবা স্ত্রী। বিবাদী গৌরী শুধু বসতভিটার উত্তরাধিকারী এবং তাকে কৃষিজমি থেকে বঞ্চিত করার কারণ দেখা যাচ্ছে না। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া বসতভিটায় বাস করছিলেন গৌরী এবং আপাতদৃষ্টিতে জীবন ধারণের জন্য শ্বশুরের কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল তিনি। এ মামলার বিবাদী গৌরীদাসীর ক্ষেত্রে হিন্দু আইনের দায়ভাগা পদ্ধতি প্রযোজ্য। ১৯৩৭ সালের আইনের ৩(১) ধারা অনুসারে বাবার আগে মারা যাওয়া ছেলের মতোই তিনি (গৌরী) তার শ্বশুরের রেখে যাওয়া সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন।

আইন পেশার সুবাদে হিন্দু নারী পূজা বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় বছর পাঁচেক আগে। হিন্দু শাস্ত্রমতে বিয়ের নিয়ম ও প্রথা মেনে পূজার বাবা মেয়ের সুখের জন্য নগদ টাকা, ব্যবহার্য আসবাবপত্র ও স্বর্ণালঙ্কার যৌতুক বা স্ত্রীধন হিসেবে প্রদান করেন। কিন্তু বিধিবাম! বিয়ের কয়েক বছর পর পূজার স্বামী উধাও হয়ে যান। এরই মধ্যে পূজার বাবাও মারা যান। ভাইয়ের সংসারে বেশিদিন থাকা হয়নি পূজা বিশ্বাসের। বাবা এলাকার সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন। হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পূজা বিশ্বাস বাবার সম্পত্তির কিছুই পাননি। অবশেষে বিয়ের সময় পাওয়া দু-একটি গয়না বিক্রি করে জীবন সংগ্রামে নামেন পূজা বিশ্বাস। তাঁর আকুতি একই বাবা-মায়ের সন্তান, অথচ নারী-পুরুষের মধ্যে ধর্ম নামক বিধিরেখা টানা হয়েছে। আইনের এ অসমতা দূর করতে সম্পত্তিতে হিন্দু নারী ও পুরুষের সমান অধিকার আদায়ে হাই কোর্টের এ রায় মাইলফলক হয়ে থাকল।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর