শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

রুখতে হবে পরিবহন মাফিয়াদের

আলম রায়হান

রুখতে হবে পরিবহন মাফিয়াদের

করোনার প্রভাব বাড়ায় আজ থেকে বাস-লঞ্চে অর্ধেক যাত্রী বহনের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। শনিবার থেকে ট্রেনও চলবে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে। এ অজুহাতে আবারও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে পরিবহন খাতের মাফিয়ারা। বাংলাদেশে পরিবহনব্যবস্থা আকাশ, রেল, সড়ক ও নদী কেন্দ্রিক। এর সঙ্গে আছে সমুদ্র পরিবহন। তবে তা একেবারেই পণ্য পরিবহননির্ভর। অন্যান্য দেশেও তাই। এখানে যেমন মিল রয়েছে তেমন রয়েছে বড় অমিলও। তা হচ্ছে চরম অব্যবস্থাপনা। আর সবকিছু ছাপিয়ে সড়ক ও নৌ পরিবহন খাতে চলছে মাফিয়া চক্রের দৌরাত্ম্য। আকাশ পরিবহনের একটি বড় অংশ চলে রাষ্ট্রীয় মালিকানায়। মানে সরকারি। আর প্রবচনই তো আছে- ‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল!’ আকাশ পরিবহনে তা-ই চলে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গচ্চা দেওয়া হয়। এ হচ্ছে ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অনিবার্য ফল। পাশাপাশি আকাশপথে আছে প্রাইভেট বিনিয়োগ। তবে তা এখনো হামাগুড়ি দেওয়ার বৃত্তেই রয়ে গেছে। রেলপথ চলে একেবারেই সরকারি ব্যবস্থাপনায়। এ খাত গ্রাস করে আছে চরম অব্যবস্থাপনা ও লাগামহীন দুর্নীতি। ফলে গচ্চা অনিবার্য। আর এ গচ্চাও বহন করতে হয় জনগণকে। একটু ঘুরিয়ে, হরেক কিসিমের ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে। সমুদ্র পরিবহনের অবস্থাও তথৈবচ। বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে সড়ক ও নৌ পরিবহন খাত। এ দুই খাতে অবশ্য সরকারি অংশগ্রহণ আছে। অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সরকারি এ অংশগ্রহণ অনেকটা দূর আকাশের তারার মতো। অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। কিন্তু প্রভাব নেই সাধারণের ব্যবহারিক জীবনে। এগুলো কেবল গবেষকদের উপজীব্য। তবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সড়ক ও নৌ পরিবহনে রাষ্ট্রীয় পরিবহন ও দূর আকাশের তারার মধ্যে মিল থাকলেও বড় রকমের অমিলও আছে। দূর আকাশের তারার জন্য জনগণকে কোনো খরচ করতে হয় না। কিন্তু সরকারি মালিকানায় সড়ক, নৌ ও সমুদ্র পরিবহন খাতে জনগণকে বেশ গচ্চা দিতে হয়। এ অরাজকতা চলছে নীরবে নিরন্তর।

বিপরীত অবস্থানে সড়ক ও নৌ পরিবহনে ব্যক্তিমালিকানার চলছে চরম অবস্থা। এরা জনগণকে প্রতিনিয়ত জিম্মি করে রাখছে। এমনকি এরা সরকারকেও জিম্মি করার ক্ষমতা রাখে। জিম্মি করেও। যেটি এবার প্রকটভাবে টের পাওয়া গেছে এবং অনেকেই অনুধাবন শুরু করেছেন। সড়ক ও নৌ পরিবহন মূলত চলে গেছে একাধিক শ্রেণি থেকে আসা মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণে। ছাত্রজীবন থেকে গড়ে ওঠা পোড় খাওয়া রাজনীতিক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়- ‘তারা ক্ষমতাধর!’ ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মূল্যায়ন খুবই সহি। তবে তিনি যে কথাটি বলেননি তা হচ্ছে, সড়ক পরিবহনের বিভিন্ন পরিচয়ে ব্যক্তিদের ক্ষমতার উৎস সরকার। এ কারণেই এরা সব সরকারের সময়ই ক্ষমতাধর। সরকার পরিবর্তন হলেও পরিবহন মাফিয়াদের দাপট কমে না। বরং সময়ের পরিক্রমায় বাড়ে। শুধু তাই নয়, সব সরকারের সময়ই এরা থেকে যায় অধরা। কেবল সড়কের নয়, নৌপরিবহন খাতও মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত। পরিবহন খাতের মাফিয়ারা যে কতটা বেপরোয়া তার কিঞ্চিৎ প্রকাশ ঘটেছে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে মাত্রাতিরিক্ত বাসভাড়া বৃদ্ধির ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তবে এটিই প্রথম বা একমাত্র নয়। পরিবহন মাফিয়া চক্রের প্রথম দাম্ভিক প্রকাশ ঘটে বিএনপি সরকার আমলে। তা ছিল ভয়াবহতম। তখন খালেদা জিয়ার সর্বশেষ সরকার ক্ষমতায়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে কর্নেল আকবর হোসেন। তিনি জিয়া সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। খালেদা সরকারের প্রতিটি সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গঠিত সরকার ছাড়া। দল ও সরকারে তাঁর অন্যরকম প্রভাব। জেনারেল জিয়ার মতোই খালেদা জিয়াও তাঁর ওপর আস্থা রাখতেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন বিএনপি সরকারের মন্ত্রী থাকাকালেই, ২০০৬ সালের ২৬ জুন। এর মাস কয়েক আগে তিনি নৌপরিবহন মাফিয়া চক্রের তান্ডবের শিকার হন। তখন নৌপরিবহন সেক্টরের নেতা গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। তারেক রহমানের বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত মামুনের তান্ডবে আকবর হোসেনের মন্ত্রিত্ব যায় যায়। আর মন্ত্রিত্ব যাওয়া কেবল নয়, আকবর হোসেনের কপালে আরও অনেক লানত ছিল। তবে তিনি শেষতক অল্পের জন্য রক্ষা পান বিআইডব্লিউটিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান শিমুল বিশ্বাস শক্তভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ানোয়। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে সড়ক ও নৌ পরিবহন খাতে ভাড়া বৃদ্ধির যে অসহনীয় বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে সফল হয়েছে মাফিয়া চক্র তাতে সব স্তর ও পেশার মানুষ বিরক্ত, বিক্ষুব্ধ। আর এ বিষয়টি সরকারের বিফলতার একটি মনুমেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে বিশাল ক্ষোভের ছোট প্রকাশ ঘটেছে মাসখানেক আগে কেবল রাজধানীর সড়কে ছাত্রদের কারণে। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, ছাত্রদের এ ক্ষোভ কখনো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে না।

সড়কের এ ক্ষোভের সঙ্গে নৌপরিবহন খাতে অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধি চরম জনক্ষোভের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন সরকারের নীতিনির্ধারকদের। সড়কের মতো নৌপরিবহন খাতের বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ হয়নি। এর অর্থ এই নয়, এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। বরং এ নিয়ে আছে চরম জনক্ষোভ। তবে তা এখনো তেমন আলোচনায় আসেনি। অনেকেই মনে করেন আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনীতির খেলা এরই মধ্যে প্রায়ই ক্লাইমেক্সে পৌঁছে গেছে। যার স্টেজ রিহার্সেল হয়ে গেল সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে। ধারাবাহিকভাবে চলছে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ইস্যুতে।

ক্ষমতাসীনরা এটি বিবেচনায় রাখলে ভালো। সঙ্গে আরও একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না। বাসভাড়ার প্রতিবাদে ছাত্রদের আন্দোলন চলাকালে বাসচাপায় এত ছাত্রের মৃতুর কারণ কী? একি কেবলই ঘটনাচক্র নাকি এর পেছনেও কোনো চক্রান্ত আছে! এর সঙ্গে আর একটি পরিসংখ্যান বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তা হচ্ছে চলতি বছরের নভেম্বরে সারা দেশে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে কোনো চক্রান্ত থাকা বিচিত্র নয়।

আর চক্রান্ত কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে হয় না। বিদেশি অর্থনীতি এবং অন্যান্য স্বার্থের খেলা থাকে। যেমন ছিল খালেদা সরকারের মন্ত্রী আকবর হোসেনের বিরুদ্ধে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নেতৃত্বে লঞ্চ মালিকদের আন্দোলনের নেপথ্যে। এ ঘটনার মাস কয়েক আগে ফেরি মেরামতে দুর্নীতির অভিযোগ করে ডেনমার্ক। কিন্তু দৃঢ়চেতা আকবর হোসেন দেশেই ফেরি মেরামত করে উপযুক্ত জবাব দেন। এর চেয়ে বহুগুণ বড়, হিমালয়সম জবাব দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু কেন্দ্র করে। ড্যানিশ কোম্পানির মতো বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল, রামের জন্মের আগে রামায়ণ রচনার মতো।

অভিযোগ পরে বা আগে যখনই তোলা হোক না কেন প্রতিটি ঘটনার পেছনেই উদ্দেশ্য থাকে। এখন দেখার বিষয় এ উদ্দেশ্যের ফাঁদে কে ধরা পড়ে, আর কে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। সঙ্গে অনিবার্য একটি দিক হচ্ছে, চক্রান্ত বহতা নদীর চেয়েও অধিক বহমান। কাজেই এ বিষয়ে সবারই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের। বলা বাহুল্য, নানান ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা বেশ সতর্কতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। কিন্তু ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করে নানারকম রাজনীতির খেলার সিংহদ্বার কেন খুলে দেওয়া হলো তা অনেকেরই বোধগম্য নয়। কার বা কাদের পরামর্শে এ কাজ হয়েছে মোটেই পরিষ্কার নয়। তবে কাজটি যে ঠিক হয়নি তা খুবই পরিষ্কার করে বলেছেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু। নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও সংকট মোকাবিলা করে বেড়ে ওঠা প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেছেন, ‘ডিজেলের দাম একসঙ্গে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা ঠিক হয়নি।’ ডিজেলের এ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে ‘অমানবিক’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন সাবেক এই মন্ত্রী।

প্রশ্ন হচ্ছে, নানান মানবিক গুণের ধারক আওয়ামী লীগ সরকার কেন এ অমানবিক কাজটি করতে গেল! কারণ যা-ই হোক এর বিরূপ ফলভোগ কিন্তু অনিবার্য। তবে এর তীব্রতা হ্রাস করার পথ এখনো কিছুটা খোলা আছে। এজন্য প্রয়োজন পরিবহন খাতের মাফিয়াদের রাশ শক্তভাবে টেনে ধরা। এদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলে তারা সড়ক ও নৌ পথের ভাড়া কমাতে বাধ্য হবে। আর সরকারের জন্য এ কাজটা অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে ছাত্ররা সড়কে প্রতিবাদ জানিয়ে। ছাত্রদের আন্দোলনের সূত্র ধরে পরিবহন মাফিয়াদের রাশ টেনে ধরার সহজ কাজটি করা না হলে ষড়যন্ত্রের পথ প্রশস্তই থেকে যাবে। এ প্রসঙ্গে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, ’৭১ সালে বিজয়ী শক্তির বিপক্ষে সক্রিয় সব কেন্দ্র সাম্প্রতিক সময়ে নানান ধরনের মাফিয়ার ওপর সওয়ার হয়ে মাঠে নেমেছে। এ ব্যাপারে বহিঃশক্তির বিষয়টিও বিবেচনা করা প্রয়োজন। বৈদেশিক শক্তি চিরকাল এক অবস্থানে থাকে না। এবং এটিই বাস্তবতা। এ বাস্তবতার কারণেই ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং আগে-পরে যেসব দেশ ও আন্তর্জাতিক শক্তিকেন্দ্র বাংলাদেশের পক্ষে ছিল তাদের সবাই চিরকাল পক্ষে থাকবে তা ধরে নেওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। আর এটি মোটেই ইউটোপিয়ান ধারণা নয়। বরং নানাভাবে প্রমাণিত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তো প্রমাণিত হয়েছে নির্মমভাবে। এর সঙ্গে বর্তমান সরকারের দৃঢ় মানসিকতা ও কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি কোনো কোনো রাষ্ট্রের অতিবিরক্তির উদ্রেক করে থাকতে পারে। কাজেই আগামী নির্বাচন সামনে রেখে অতিসতর্কভাবে পদক্ষেপ দেওয়া জরুরি মনে করেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে সেই প্রবচন, ‘পচা শামুকেও পা কাটে’। আর ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি তো সরকার নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করেছে! সে ঘা শুকানোর আগে পরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নেওয়ার অজুহাতে ভাড়া বাড়লে তা হবে আরও বিপদ ডেকে আনার নামান্তর।

                লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর