শুক্রবার, ৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

অকৃতজ্ঞ মানুষের গল্প

মহিউদ্দিন খান মোহন

অকৃতজ্ঞ মানুষের গল্প

কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী। চতুষ্পদ এ প্রাণীটি মনিবের জন্য কখনো কখনো সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধা করে না- এর বহু প্রমাণ রয়েছে। যে ঘরে সে পালিত হয়, সে ঘরের মানুষের প্রতি সে থাকে কৃতজ্ঞ। বিভিন্ন সময় এ প্রাণীটি প্রভুভক্তি, বিশ্বস্ততা কিংবা কৃতজ্ঞতার জন্য সংবাদপত্রেরও শিরোনাম হয়েছে।

২০১৩ সালের ৪ জুলাই তেমনি একটি খবর বেরিয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিদিনে। প্রভুর জন্য একটি কুকুরের জীবনদানের ঘটনাটি ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার এক শহরে। খবরে প্রকাশ, এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে তার পোষা কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে পুলিশকে বিরত রাখতে চায়। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করায় কুকুরটি আক্রমণ করে পুলিশকে। সে তাদের হাত কামড়ে দেয়। একপর্যায়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা কুকুরটিকে গুলি করলে ওটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখে কুকুরটির মালিকও হাউমাউ করে কেঁদেছেন বলে খবরে প্রকাশ। লোকটি দোষী কি নির্দোষ, অপরাধী কি নিরপরাধ তা বোঝার ক্ষমতা ওই কুকুরটির ছিল না। সে দেখেছে ওর প্রভু বিপদাপন্ন, তাই তাকে রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে সে জীবন দিয়েছে। কুকুরের এ ধরনের প্রভুভক্তির অনেক কাহিনি আছে। গল্প-উপন্যাস, নাটক-সিনেমায়ও কুকুরের প্রভুভক্তি ও কৃতজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ছেলেবেলায় সম্ভবত ক্লাস থ্রির বাংলা বইয়ে একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটি ছিল- পালিত কুকুরসহ জাহাজে ভ্রমণ করছিল এক বালক। হঠাৎ পা ফসকে সে সাগরে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার কুকুরটি লাফিয়ে পড়ে সাগরে। বালকের জামা কামড়ে ধরে প্রাণপণ সাঁতরাতে থাকে জাহাজের দিকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজ থামিয়ে দেন। ওই সময় একটি হাঙর দ্রুত ছুটে আসতে থাকে বালক ও কুকুরের দিকে। ক্যাপ্টেন তার বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়েন। হাঙরের মাথা চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে যায়। জাহাজের খালাসিরা ছোট বোট নিয়ে উদ্ধার করে আনেন বালক ও তার কুকুরকে।

দ্বিতীয় গল্পটি পড়েছিলাম ১৯৭৯ সালে ডিএফপি প্রকাশিত (বর্তমানে লুপ্ত) সাহিত্য পত্রিকা মাসিক ‘পূর্বাচল’-এ। লেখকের নাম মনে নেই। সম্ভবত গল্পটির শিরোনাম ছিল ‘হিসাব’ অথবা ‘অঙ্ক’। একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পরিবারে মোট সদস্য চারজন। তিনি নিজে, ছোটবেলা থেকে আদর-স্নেহে বড় করে তোলা এক যুবক, যাকে অনাথ অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়ে পুত্রস্নেহে লালনপালন করে ওই স্কুলেই দফতরির চাকরি দিয়ে রেখেছেন, একটি বিড়াল এবং একটি কুকুর; যেটি রাতে তার কামরাতেই থাকত। এ তিন প্রাণীকেই খুব ভালোবাসতেন তিনি।

প্রতি রাতে তিনি বিড়ালটিকে এক বাটি দুধ খেতে দিতেন। একদিন রাতে খেতে গিয়ে দেখেন পাতিলে দুধ নেই। বুঝলেন বিড়ালটি চুরি করে দুধ খেয়ে ফেলেছে। রাগে দুঃখে প্রধান শিক্ষক বিড়ালটিকে খুব মারলেন। বিড়ালটি বাসা ছেড়ে চলে গেল। কয়েকদিন পর স্কুল কম্পাউন্ডে বিড়ালটিকে দেখে তিনি ‘মিনি’ বলে ডাকলেন। বিড়ালটি একবার তাকিয়েই ভোঁ-দৌড় দিল উল্টো দিকে। শিক্ষক মন খারাপ করে চলে গেলেন অফিসে। এর কয়েকদিন পরই ঈদের ছুটি হলো। স্কুল থেকে বেতন-বোনাস পেয়ে রাতে দফতরি ছেলেটিকে কিছু টাকা দিলেন। সে বাড়ি যাবে। বাকি টাকা বালিশের নিচে রেখে প্রধান শিক্ষক ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝরাতে ঘরের মধ্যে ধস্তাধস্তির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তার। উঠে আলো জ্বেলে দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। দেখলেন কুকুরটি দফতরির একটি হাত কামড়ে ধরেছে আর দফতরি একটি ধারালো চাকু দিয়ে কুকুরটিকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। দফতরি সজোরে কুকুরটির বুকে চাকু বসিয়ে দিতেই সেটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আর সে সুযোগে দুর্বৃত্ত দফতরি পালিয়ে গেল। শিক্ষক আহত কুকুরটিকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না। তীব্র মনঃকষ্ট নিয়ে স্কুল কম্পাউন্ডের এক কোণে প্রিয় কুকুরটিকে মাটিচাপা দিয়ে সজল নয়নে ঘরে ফেরেন তিনি। গল্পটির শেষ কটি লাইন ছিল এ রকম- ‘তারপর অঙ্কের শিক্ষক ওয়াজিউল্লাহ (পাঠক, গল্পের শিক্ষকের নামটি মনে নেই, তাই আমার একজন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের নামটি ব্যবহার করলাম) অঙ্ক কষতে বসলেন। হিসাব কষলেন, ‘কৃতজ্ঞতার পূর্ণমান যদি ১০০ হয়, তাহলে কুকুর পাবে ১০০, বিড়াল পাবে ৫ (যেহেতু ডাক দেওয়ার পর একবার ফিরে তাকিয়েছিল), আর মানুষ পাবে শূন্য।’ গল্পটি এখানেই শেষ। গল্পটিতে লেখক কী মেসেজ দিতে চেয়েছেন তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না।

কুকুরের প্রভুভক্তির তৃতীয় যে গল্পটির কথা আমি উল্লেখ করতে যাচ্ছি সেটা নিছক গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’-এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতা তখন ময়মনসিংহ জেলার কোনো এক থানার ওসি। বাসভবন হিসেবে পেয়েছেন পুরনো কোনো এক জমিদারবাড়ি। চারদিকে ঝোপজঙ্গল। এক দুপুরে হুমায়ূন আহমেদ ভাইবোন নিয়ে উঠোনে খেলছিলেন। দালানের সিঁড়িতে বসে ছিল তার সবচেয়ে ছোট ভাই আহসান হাবীব (প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট ও লেখক)। হঠাৎ একটি গোখরা সাপ বেরিয়ে এসে ফণা তুলে হাবীবকে ছোবল মারতে উদ্যত হয়। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হুমায়ূন আহমেদের বাবার পোষা কুকুরটি কালবিলম্ব না করে হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপটির ওপর। কামড়ে ধরে উদ্যত ফণাসমেত মাথা। কামড়ে ওটাকে ছিঁড়ে ফেলে। সাপের নিশ্চল দেহ পড়ে থাকে সিঁড়িতে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান শিশু আহসান হাবীব। তিন দিন পর কুকুরটি দেহে সাপের বিষক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করে। নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে ওটা। একপর্যায়ে শরীরে ঘা হয়ে যায়। তীব্র যন্ত্রণায় দিনরাত কাতরাতে থাকে কুকুরটি। কয়েক দিন এ দৃশ্য দেখে আর সহ্য করতে পারলেন না ওসি ফয়জুর রহমান আহমেদ। নিজের ব্যক্তিগত বন্দুক দিয়ে গুলি করে মেরে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলেন কুকুরটিকে। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, মৃত কুকুরটিকে মাটিচাপা দেওয়ার পর তাঁর পিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘যে আমার পুত্রের জীবন রক্ষা করল, আমি তাকে নিজ হাতে হত্যা করলাম!’

এখানে হুমায়ূনের পিতার কোনো অপরাধ আমি দেখি না। যদিও তিনি অপরাধবোধে ভুগছিলেন। প্রিয় কুকুরটিকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতেই তিনি ওটাকে হত্যা করেছিলেন। এখানে যদি কেউ তার ‘অকৃতজ্ঞতা’ খুঁজতে যান তাহলে ভুল করবেন। এ ক্ষেত্রে ওসি ফয়জুর রহমান আহমেদের সে সময়ের মানসিক অবস্থাটি উপলব্ধি করতে পারলেই আর কোনো সমস্যা থাকবে না। একটি মুম্বাই ফিল্ম দেখেছিলাম ‘তেরি মেহেরবানিয়া’ নামে। প্রখ্যাত অভিনেতা জ্যাকি শ্রফ অভিনীত ওই সিনেমায় এক প্রভুভক্ত কুকুরের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছিল। মানুষ ও কুকুরের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর কুকুর পশুকুলের মধ্যে নিকৃষ্টদের অন্যতম। এখনো অনেকে কুকুর দেখলে ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। যদিও ইউরোপ-আমেরিকার সাহেব-মেমসাহেবরা অতিযতেœ কুকুর পোষেন। সেই অবহেলিত ঘৃণিত কুকুরও অনেক সময় মানুষের জন্য শিক্ষা গ্রহণের প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানুষ একে অন্যকে ‘কুকুরের বাচ্চা’ বা ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দিলেও অনেক সময়ই তারা কুকুরের মতো প্রভুভক্তি কিংবা দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারে না। ছয় দশকের জীবনে বহু অকৃতজ্ঞ মানুষের দেখা পেয়েছি, যারা উপকারীর বা সাহায্য-সহায়তাকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন দূরে থাক, উল্টো তার ক্ষতি করতেও দ্বিধা করেনি। আর সেজন্যই বাংলা ভাষায় ‘কৃতঘ্ন’ (যে উপকারীর ক্ষতি করে) শব্দটির প্রচলন হয়েছে।

পারিবারিক কিংবা সমাজ জীবন তো বটেই, রাজনৈতিক অঙ্গনেও এ ধরনের অকৃজ্ঞ বা কৃতঘ্ন ব্যক্তির সন্ধান হামেশাই মেলে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রে অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের একটি ডায়ালগ অনেকেরই মনে থাকার কথা। মীরজাফরের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘জনাব জাফর আলী খাঁ, আপনি শুধু সিপাহ্সালার নন, আপনি আমার আত্মীয়। বিপদের দিনে মেরুদন্ড সোজা করে, শির উঁচিয়ে যে পাশে এসে দাঁড়ায়, সে-ই না পরম আত্মীয়।’ কিন্তু নবাব সিরাজের সেই ‘পরম আত্মীয়’ই তাঁর সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। শুধু কি তাই? নবাবের বুকে মোহাম্মদী বেগ নামে যে যুবক ছোরা বসিয়েছিল, সে ছিল নবাবের নানা নবাব আলীবর্দী খাঁর পালিত পুত্র। মহীশুরের রাজা টিপু সুলতানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাঁর চাচাশ্বশুর মীর সাদিক। খন্দকার মোশতাক ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিশ্বাসভাজন সহকর্মী। কিন্তু সেই মোশতাকই রাষ্ট্রক্ষমতার লোভে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে; যে ষড়যন্ত্রে নিহত হন তিনি।

বস্তুত কুকুরের সঙ্গে কিছু কিছু মানুষের পার্থক্য এখানেই। কুকুর তার প্রভু বা উপকারী বন্ধুর বিপদের দিনে চুপচাপ বসে থাকে না, বরং বিপদ থেকে বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর অকৃতজ্ঞ মানুষ করে উল্টোটা। স্বার্থের জন্য উপকারী ব্যক্তিটির বুকে চাকু বসাতেও দ্বিধা করে না। আমার জীবনে এমন অনেক অকৃতজ্ঞ মানুষের দেখা পেয়েছি, যারা একসময়ের উপকারী ব্যক্তিটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে কুণ্ঠিত হয় না। এমনও দেখেছি, যার অনুগ্রহে একসময় তার সংসার চলেছে, জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা হয়েছে, পরবর্তী সময়ে নিজের অবস্থার উন্নতি হওয়ায় অতীতের সবকিছু ভুলে গেছে। এমনকি একসময় যে তার দুঃসময় ছিল, সে যে অন্যের অনুগ্রহ প্রার্থী ছিল তা-ও বেমালুম অস্বীকার করার প্রয়াস পায়! এর অবশ্য একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে বলে আমার মনে হয়। তা হলো, একসময়ের কপর্দকহীন ওই ব্যক্তি অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে ওঠার ফলে তার কিছু মোসাহেব জুটে যায়। সেই মোসাহেবদের সামনে তার অতীতের দারিদ্র্যের কথা স্বীকার করতে সে হীনমন্যতায় ভোগে। অবশ্য প্রভু কিংবা উপকারী ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধ লড়াই, এমনকি জীবনদানের ঘটনার নজির মানুষের মধ্যে নেই এটা বলা যাবে না। মহান আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব আমরা। আমাদের বলা হয় ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। সেই আমাদেরই মধ্য থেকে কিছু মানুষ যখন সৃষ্টির নিকৃষ্ট জীবের চেয়েও জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়, তখন নিজে নিজেই লজ্জা পেতে হয়। ভাগ্যিস পশুপাখি কথা বলতে পারে না বা আমরা ওদের ভাষা বুঝি না। তা না হলে যেসব ঘটনা কতিপয় মানুষ সমাজে ঘটায়, তাতে পশু-পাখিও আমাদের নিন্দাবাদ দিত, উপহাস করত। হয়তো খারাপ উদাহরণের ক্ষেত্রে ‘মানুষ’ শব্দটি ব্যবহার করত!

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর