শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ত্যাগ করতে করতে আনন্দ খুঁজুক জীবন

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

ত্যাগ করতে করতে আনন্দ খুঁজুক জীবন

খ্যাতির জন্য নয়, আনন্দের জন্য কাজ করতে চাই : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কথাটা খুব মনে ধরল। কথাটা খুবই অর্থবহ, যদিও এ ধরনের কথাগুলো এখন আর আমরা তেমনটা শুনতে পাই না। বরং এমন সব কথা শুনছি যার কোনো মূল্য নেই। স্যুট-বুট-টাই লাগালেই কথাগুলো যে ভদ্র মানুষের মতো হবে তা নয়। গলায় একটা বড় পদের সাইনবোর্ড ঝোলালেই যে কথাগুলো অমৃত-মধুর হবে তা নয়। যদিও তেলবাজ সমাজ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তেলবাজি করতে এতটুকু কার্পণ্য করছে না। কারণ যতক্ষণ বড় পদের সাইনবোর্ডটা থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত চারপাশের স্বার্থবাজ মানুষ মিথ্যা করে হলেও প্রশংসার মতো মহামূল্যবান অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে কোনোভাবেই পিছপা হবে না। খুব অদ্ভুত বিষয় হলো, বড় পদের সাইনবোর্ড ঝোলানো মানুষটার যখন ক্ষমতা থাকবে না তখন মানুষ যতটা তেলবাজি করেছে তার চেয়ে বেশি সমালোচনা করতে কোনোক্রমেই নিজেকে পিছিয়ে রাখবে না। পচনশীলতার নিয়মও বুঝি এটা, যা মানুষের দেহেই কেবল পচন ধরায় না, মনেও পচন ধরায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, যদিও প্রকৃতি এ নিয়মকে কখনো গ্রহণযোগ্য মনে করে না। সবচেয়ে অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব হলো, ক্ষমতাবানরা নিজেদের প্রশংসা ও গুণগান শুনতে ভালোবাসে। হয়তো মানুষের ক্ষমতা যত বাড়তে থাকে নিজের প্রশংসা শোনার চামড়াটাও মানুষের গন্ডারের মতো হতে থাকে। তবে সবচেয়ে হতাশার কথা হলো, সমাজে তেলবাজ মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে সমাজকে তত ব্যক্তিত্বহীন মানুষের বোঝা বইতে হবে।

কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাহেব ও মোসাহেব’ নামের কবিতাটা মনে পড়ে গেল। কবিতাটা মনে হয় সবাইকে আরেকবার শোনানো দরকার, কারণ মানুষ তার ভিতরটা দেখতে ভয় পায়। সে জায়গাটা মানুষকে চেনানো দরকার। সাহেব-মোসাহেবরা আমাদের চারপাশেই হয়তো আছে, যেমন চারপাশে ছড়িয়ে আছে সাহেব-বিবি-গোলামরা। মজার বিষয় হলো, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ১৯৫৩ সালে বিমল মিত্র রচিত একটি বাংলা উপন্যাস। ১৯৫৬ সালে উপন্যাসটি ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বাংলা ছায়াছবিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ব্রিটিশ রাজত্বকালে বাংলায় সামন্ততন্ত্রের করুণ পতনকে তুলে ধরা হয়েছিল চলচ্চিত্রটিতে। সামন্ত কর্তাদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের কাছে পুড়ে মরেছে তাদের বিয়ে করা বউদের মন। স্বামীদের মন জোগাতে বউরা সবকিছু উজাড় করে দিতে চেয়েছেন কিন্তু বারবার ভেঙেছে মন। নর্তকীদের রঙের নেশার কাছে জীবনের মূল্য হারিয়ে গেছে। বড় বড় ইট-পাথরের প্রাসাদে অপেক্ষার পর অপেক্ষা করেছেন বউরা, কিন্তু চার দেয়ালে আটকে গেছে তাদের জীবনের আনন্দ। তবে অতি জৌলুশে একদিন ভেঙে পড়েছে কর্তাদের আভিজাত্যের অহংকার। অথচ সাধারণ একটা মানুষের জীবনে টানাপোড়েন আছে, দারিদ্র্যের ছাপ চোখেমুখে লেগে আছে কিন্তু তার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। প্রাচুর্যের বোঝা মানুষকে ধ্বংস করে, অভাবের অনুভূতিতে মানুষের ভিতর নতুন করে বেঁচে ওঠার জীবনীশক্তি গড়ে তোলে। এটাই সত্য, সত্য এমন করেই কখনো কখনো নির্মম হয়।

আপনি সাহেব না মোসাহেব তা চেনার দায়িত্ব আপনার। কারণ সামনে থেকে সত্য স্বীকার করতে সবাই ভয় পায় অথচ মানুষের ভিতরটা জানে সেখানে কত ধ্বংসযজ্ঞের খেলা চলছে। সবাই যেন কাঠের পুতুল হয়ে যাচ্ছে, নিজের মতো করে ভাবার মতো লোকের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। গণতন্ত্রের নাম দিয়ে সংখ্যাধিক্যকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানুষ অন্ধ অনুকরণে গা ভাসাচ্ছে। সত্য হচ্ছে মিথ্যা, মিথ্যে হচ্ছে সত্য। মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করে দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্য সত্য হয়েও থাকতে পারে মিথ্যা। কারণ সত্য বিচারে মানুষ তার নিজের বিচারকে খুব কমই অনুসরণ করে। সমষ্টির সমর্থনের আশায় সামষ্টিকের মিথ্যাকেই প্রতিদিন এমন করে বড় সত্য ভেবে অনুকরণ করে। এভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভ্রান্ত ধারণাকেও মানুষ সঠিক বলে বিশ্বাস করতে থাকে যদিও সে জানে যে তারা ভুল। কিটি জেনোভেস নামের এক নারীকে ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক শহরের জনাকীর্ণ রাস্তায় উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, সে সময় ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো মানুষ এ ঘটনা তাদের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছিল কিন্তু কিটি জেনোভেসকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য কেউই এগিয়ে আসেনি। কেন এমনটা হলো তা নিয়ে তখন গবেষকরা দিনের পর দিন গবেষণা করেছেন।

গবেষণালব্ধ মনোবিজ্ঞনের পরীক্ষা বলছে, একজন মানুষ যত বেশিসংখ্যক মানুষের সামনে বিপদে পড়বে তার সাহায্য পাওয়ার সুযোগ তত বেশি কমে আসবে। অথচ উল্টো ঘটার কথা। এর পেছনে দুটি বিষয় Diffusion of Responsibility এবং Bystander Effect মানুষের মধ্যে কাজ করে। যেখানে মানুষ ভাবে, অনেক মানুষ তো আছে, তাদের কেউ না কেউ সাহায্য করবে, আমি কেন ঘটনায় জড়িয়ে গিয়ে নিজেকে ঝামেলায় ফেলব। খুব অদ্ভুত হয় মানুষের মনস্তত্ত্ব। কখনো কখনো মানুষ গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে অনুকরণপ্রিয় হয়, আবার কখনো কখনো মনুষ্যত্বের পরীক্ষা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সুবিধাবাদী হয়। এর কোনোটিতেই আনন্দের মর্মবাণী নেই বরং আছে জরাগ্রস্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা প্রসঙ্গে বলতে চাই, সবাই যদি খ্যাতির পেছনে ছুটতে থাকে, মিথ্যা প্রশংসার পেছনে ছুটতে থাকে তাহলে মানুষের জন্য বাস্তবে কাজ করে আনন্দের জায়গাটা তৈরি করবে কে? আমাদের তরুণদের স্বপ্ন দেখাবে কে? স্বপ্ন দেখাটা যত কঠিন স্বপ্ন দেখানোটা তার থেকে বেশি কঠিন। সবাই স্বপ্ন দেখাতে পারে না, কেউ কেউ পারে। সবাই ত্যাগের আনন্দে নিজেকে ডোবাতে পারে না, কেউ কেউ পারে। যে মানুষের কিছু নেই তার দেওয়ার মতো মন আছে। যার সব আছে তার কেড়ে নেওয়ার লোভ আছে। খুব অদ্ভুত এ বৈপরীত্য, যা নদীর মাঝখানে এসে ঝড়ের মধ্যে ফেলে দেয় মানুষকে। যার কিছু নেই সে ঝড়ের সঙ্গে লড়তে লড়তে তীরে এসে নতুন জীবনের ডাক দেয়। যার সব আছে সে নিজের জীবন ভুলে গিয়ে ধনসম্পদ বাঁচাতে বাঁচাতে ডুবে মরে। ভরা পেট কখনো স্বপ্ন দেখতে পারে না, নতুন চিন্তা করতে পারে না, সৃজনশীল হতে পারে না। খালি পেট এর সবই পারে। মানুষ জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলো খুঁজুক, মানুষের ভিতরের সাধারণ মানুষটা বৃষ্টির পানিতে নিজেকে ভেজাতে ভেজাতে স্বপ্ন আর বাস্তবতার অঙ্কটা মিলিয়ে দেখুক। খুব ছোট হয়ে নুয়ে পড়া মানুষটা তার স্বার্থের বন্দিত্ব থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন জীবনের আনন্দে ডুবে থাকুক। মানুষের জীবনটা আনন্দের বরফ কুড়াক, যেখানে শীতের তীব্রতা শরীরে এসে লাগবে, চাদরে নয়।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

সর্বশেষ খবর