বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ভাবনাগুলো

তসলিমা নাসরিন

ভাবনাগুলো

১. দু’দিন আগে শিক্ষক দিবস গেল। শিক্ষক দিবসে আমি  ভাবছিলাম এমন কোনও শিক্ষক কি আমি পেয়েছি, যাঁর কাছ থেকে ইস্কুল কলেজের পরীক্ষায় কী করে পাশ করতে হয় এই কৌশল ছাড়া অন্য কিছু শিখেছি? সত্যি কথা বলতে, ঘরে বসে দিন রাত ইস্কুল কলেজের বই পড়েই যা শেখার শিখেছি। আর রাত দিন লুকিয়ে লুকিয়ে ‘আউটবই’ (সিলেবাসের বাইরের গল্প কবিতা প্রবন্ধের বই) পড়ে জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে জেনেছি।

এখনও তাই করি, পড়ে পড়ে শিখি। জগতময় ঘুরে ঘুরে শিখি। 

সবচেয়ে বেশি শিখি ঠেকে ঠেকে আর ঠকে ঠকে। চলার পথে পাল পাল শত্রু আমার পথ রোধ করেছে, আমার কণ্ঠ রোধ করেছে, আমাকে অপমান করেছে, অপদস্থ করেছে, চরম আঘাত করেছে, ধাক্কা দিয়ে নর্দমায় ফেলেছে, নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে; নিজেকে বাঁচাতে উঠে দাঁড়িয়েছি আমি। বার বার। বার বার আমি শিখেছি, নিজেই শিখেছি কী করে উঠে দাঁড়াতে হয়, কী করে মুষ্ঠিবদ্ধ করতে হয় হাত, কী করে যেতে হয় যেদিকে ইচ্ছে করে যেতে, কী করে বলতে হয় যে কথা ইচ্ছে করে বলতে, কী করে প্রতিবাদ করতে হয় আপস না করে, কী করে বাঁচতে হয়, কী করে আমার মতো দুর্ভাগাদের বাঁচাতে হয়। আমি নিজেই নিজের শিক্ষক।

২. বেশ কয়েক বছর থেকে আমি ভাবছি, কবিতা আর ছোটখাটো নিবন্ধ প্রবন্ধ না হয় আমি লিখতে পারি নানা বিষয় নিয়ে, নিজের অভিজ্ঞতা, দর্শন, উপলব্ধি, ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু উপন্যাস কেন বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখি না! এর কারণ, বিচিত্র বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা নেই। একবার একজন বলেছিলেন, গ্রামের জীবন নিয়ে লেখো। আমি বলেছি, লিখবো কী করে, গ্রামে কোনওদিন যাইনি, থাকিনি। গ্রাম দেখেছি মূলত ট্রেন থেকে, বা গাড়ি থেকে, আর শহরের গা ঘেঁষে যে গ্রামগুলো, সেখানে সব মিলিয়ে চারপাঁচ বার যে যাওয়া হয়েছে, তাও সামান্যক্ষণের জন্য। খুব কাছ থেকে গ্রামের মানুষদের জীবন যাপন দেখিনি। বস্তির জীবন? সেও দেখা হয়নি। চোর, বদমাশ, ভিখিরি, নেশাখোর, শ্রমিক, রাজনীতির জগত, বিজনেস পাড়া, বেশ্যা বাড়ি, না, কিছুই কাছ থেকে দেখা হয়নি।

ছোটবেলা থেকেই খুব জানতে চাইতাম জগতটাকে। খুব দেখতে চাইতাম, কিন্তু দেখতে দেওয়া হয়নি। মামারা কাকারা দাদারা কিশোর বয়স থেকেই টই টই করে শহর ঘুরতো। কত কোথাও যেত, বন্ধুর বাড়ি, এই পার্ক, ওই মাঠ, সার্কাস, ঘোড়দৌড়, বাজার, দোকানপাট, সিনেমা, থিয়েটার, বন বাদাড়, বস্তি, পুকুরপাড়, নদীর পাড়, এই মেলা, সেই মেলা; কত নানা রকম মানুষের সঙ্গেও মিশতো, কথা বলতো, বন্ধুত্ব করতো অবাধ স্বাধীনতা ছিল ওদের, ছেলে হওয়ার স্বাধীনতা। আমাদের মেয়েদের তা ছিল না। শুধু ইস্কুল আর বাড়ি, এর বাইরে কোথাও যাওয়া বারণ ছিল। বাবার ওপর খুব রাগ হতো, যেহেতু বাড়ির বাইরেটা, জগতটা বাবা দেখতে দিত না। কিন্তু এখন আর সেই রাগটা হয় না, কারণ মেয়েদের জন্য বাইরেটা খুব খারাপ ছিল। আমিও যদি দাদারা যেভাবে ঘুরতো সেভাবে ঘুরতাম, আমাকে দুদিনেই ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতো লোকেরা, অথবা ভীষণ বদনাম হতো আমার। বাবা পায়ের টেংরি ভেঙে চিরকালের জন্য হয়তো ঘরে বসিয়ে রাখতো। বাড়িতে বাবাদের মামাদের দাদাদের বন্ধুরা এলে ভেতরের ঘরে চলে যেতে হতো। মেয়েদের নাকি পুরুষলোকদের আলোচনার মধ্যে থাকতে নেই। ঘরের জীবন খুব চিনি বলে বাইরের অচেনাকে চেনার বড় ইচ্ছে ছিল। মেয়েদের ইস্কুল কলেজে পড়েছি। মেয়েদের সঙ্গেই মিশেছি। ছেলেরা বড় এক রহস্যের মতো ছিল। মেডিক্যাল কলেজে ছেলেরাও পড়েছে আমাদের সঙ্গে, কিন্তু শৈশব কৈশোরে একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গেলে যা হয়, দূরত্বটা বড় হলেও বজায় থাকেই। সমাজটা যদি ছেলেদের মতো মেয়েদের ঘোরাফেরাকে সহজে মেনে নিত, তাহলে মেয়েরা জগত দেখার সুযোগ থেকে এত ভয়ংকরভাবে বঞ্চিত হতো না। আর জগত খুব খুঁটিয়ে না দেখলে জগত নিয়ে প্রবন্ধ বা পদ্য হয়তো লেখা যেতে পারে, কিন্তু উপন্যাস লেখা যায় না। উপন্যাসে বর্ণনা করতে হয় সব খুঁটিনাটি। জীবন যাপনের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম    সবকিছু। আমার উপন্যাসগুলোয়, আমি তাই লক্ষ্য করেছি বৈচিত্র নেই। মধ্যবিত্ত মেয়েদের ঘরের জীবন, তাদের দুঃখ সুখই আমার উপন্যাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফাঁকি দিতে পারলে বানিয়ে বানিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের, ক্ষেত খামারের, কলকারখানার, জাহাজঘাটের, অথবা অন্য কোনও বিশাল পটভূমি নিয়ে উপন্যাস লিখতে পারতাম। কিন্তু মুশকিল হলো, ওই ফাঁকিটাই আমি দিতে পারি না। অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ হলে শুধু উপন্যাসে নয়, অন্য লেখাতেও বৈচিত্র আসে। জানি কেউ কেউ বলবেন, ঘরের জীবনটা যখন জানি, ঘরের জীবনটাকেই ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলি না কেন। সে চেষ্টা আমি করি, কিন্তু দুঃখটা তো থেকে যায়। চার দেওয়ালের মধ্যে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দেওয়ার দুঃখ। একটা নারীবিদ্বেষী সমাজে জন্ম হলে মেয়েরা জীবনের কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত থাকে! ঘরের জীবনটা আমার দাদারা দেখেছে, বাইরের জীবনটাও দেখেছে। আর, আমি আর আমার বোন মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে শৈশব কৈশোর আর তারুণ্য জুড়ে শুধু ঘরের জীবনটাকেই দেখেছি। আমাদের তো অধিকার আছে সবকিছু দেখার এই পৃথিবীর! নাকি নেই?

শুধু জন্মের সময় শরীরে ছোট একটা পুরুষাঙ্গ ছিল না বলে কত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি! আমার দাদারা পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মেছে, দুনিয়া দেখেছে, কিন্তু লেখার ক্ষমতা নেই বলে কিছুই লিখতে পারেনি। হয়তো অন্য খাতে খাটিয়েছে অভিজ্ঞতা। লেখার হাত থাকলেও অভিজ্ঞতার অভাবে অনেক সময় আমি মন খারাপ করে বসে থাকি। সেদিন খুব ইচ্ছে হয়েছিল কনস্ট্রাকশান ওয়ার্কারদের নিয়ে, ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের নিয়ে বড় একটা উপন্যাস লিখি। কিন্তু ওদের জীবন পুরুষ হয়ে বিচরণ করলে যতটা দেখা সম্ভব, মেয়ে হয়ে ততটা সম্ভব নয়। বাইরের পৃথিবীর প্রায় সবখানেই, প্রায় সব জায়গায় মেয়েরা অনাকাংখিত, অবাঞ্ছিত।

যা কিছুই ঘটুক, পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্ম নিইনি বলে আমার কিন্তু দুঃখ হয় না, বরং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কারণ পুরুষশাসিত সমাজে ওই ছোট্ট অঙ্গটা থাকা খুব ভয়ংকর, রীতিমত মাথা নষ্ট করে দেয়, নীতিবোধ বলে, বিচারবোধ বলে প্রায় কিচ্ছু থাকে না, ভাবার-চিন্তা করার শক্তি লোপ পাইয়ে দেয়, নিজেকে ঈশ্বরের মতো বড় বলে মনে হয়, মূর্খতা আর মূঢ়তার মুকুট পরেই বসে থাকা হয় কেবল। পুরুষ হয়ে জন্মালে আমি আর দশটা পুরুষের মতো হতাম না এ কথা নিশ্চয় করে কী করে বলবো, নাও যদি হতাম, পুরুষ জাতটা তো আমার জাত হতো, যে জাতের বেশির ভাগই অবিবেচক, কূপমন্ডুক! হয়তো অনেকে বলবে বেশির ভাগ পুরুষই ভালো, সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, শুধু হাতে গোনা ক’জন পুরুষই করে না। তাই যদি হয়, বেশির ভাগ পুরুষই যদি সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, তবে সমাজে সমানাধিকারের আজও দেখা নেই কেন? কে বাধা দেয়? বেশির ভাগ পুরুষই যদি পুরুষতন্ত্র বিরোধী, তবে আজো কেন এত বহাল তবিয়তে, এত জাঁকিয়ে, সমাজ জুড়ে বৈষম্যের মূল অপশক্তি পুরুষতন্ত্র টিকে আছে?

৩. নাস্তিক হলেই যে মানুষ মানুষ হিসেবে ভালো হয়, তা নয়। কেউ আস্তিক হলেই যে মানুষ হিসেবে খারাপ, তাও নয়। আমি প্রচুর নাস্তিককে দেখেছি যারা ভীষণরকম নারীবিদ্বেষী। অনেক আস্তিককে দেখেছি যারা কারও অনিষ্ট করে না, নিজের ধর্মকর্ম নিয়ে নিজে থাকে, কারও ওপর নিজের ধর্ম চাপানোর চেষ্টা করে না। তবে কোনো কোনো দেশের যে আস্তিকদের দেখা পাচ্ছি, ওরা অনেকেই অসভ্য আর অশিক্ষিত। ওদের পছন্দের ধর্মটি যারা মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে তারা হেন কোনও কুকর্ম নেই যে করে না। কেউ কেউ তাদের কোপাচ্ছে, তাদের জবাই করছে। হাতের নাগালে না পেলে বিভিন্ন কুৎসিত পদ্ধতিতে তাদের হেনস্থা করছে। এই ধার্মিকদের আল্লাহর বিচারে বিশ্বাস নেই। তাই ওরা নিজেরাই বিচার করছে সবার। ওরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কে দোষী, কে দোষী নয়, এবং এও জানিয়ে দিচ্ছে দোষীদের কী শাস্তি হওয়া উচিত। দুনিয়ার সবাইকে আস্তিক বানাবার, পরহেজগার বানাবার জন্য এই ধার্মিকরা এত মরিয়া কেন, আমি বুঝিনা। ওরা কেন সবাইকে নিয়ে বেহেসতে যেতে চায়। দোযখেও তো মানুষকে যেতে হবে। এই যে সাতটা দোযখ আল্লাহ বানিয়ে রেখেছেন, ওগুলো কি খালি ফেলে রাখার জন্য? ওখানে পুড়তে যদি আমার আপত্তি না থাকে, তবে ধার্মিকদের আপত্তি কেন? ওরা কেন আল্লাহ রসুলকে নিজের সম্পত্তি মনে করে! আল্লাহ রসুল কি তাদের আজও বলেননি যে তাঁরা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নন। তাঁদের নিয়ে আমার যা ধারণা, তা আমি বলবো। দোযখে যাবো জেনেও বলবো। আমি তো সব আস্তিককে নিয়ে দলবেঁধে দোযখে যেতে চাইছি না। আমি জোরজবরদস্তি কোনও আস্তিককে নাস্তিক বানাতেও চাইছি না।

মানুষের অনিষ্ট করে না, অন্যের বিশ্বাসে নাক গলায় না, এরকম ধার্মিকের সংখ্যা সম্ভবত খুব কম বাংলাদেশে। এই সংখ্যাটা যতদিন না বাড়ে, ততদিন বাংলাদেশ নিয়ে আশা ভরসার কিছু নেই। নাস্তিক বা আস্তিক হওয়ার চেয়ে সবচেয়ে প্রয়োজন, ভালো মানুষ হওয়া। ভালো মানুষেরা সবার ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। মানুষ গরু খেলো কী শুয়োর খেলো, মদ খেলো কী ফান্টা খেলো, একজনের সঙ্গে শুলো, কী দশজনের সঙ্গে শুলো- এ সম্পূর্ণই যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা করা ধার্মিকদের বন্ধ করতে হবে। মানুষ ধার্মিক হোক, আপত্তি নেই। ধর্ম এবং মানবাধিকার দুটো তেল আর জলের মতো, একেবারেই মেশে না। ওদুটোকে না মেশাতে চেয়ে বরং ধার্মিকেরা যদি চেষ্টা চরিত্তির করে মানবাধিকার ব্যাপারটিকে মেনে নেয়, তবে সমস্যা অনেক কমে যাবে। যত ধার্মিকই হোক, মানুষ তো। মানুষ কী না পারে। চেষ্টা করলে মন্দ মানুষেরা ভালো মানুষ হতে পারবে না, এ আমি বিশ্বাস করি না।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর