হঠাৎই সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদে দেহ-মন কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। অর্ধশত বছরের কম হবে না সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একজন রাজনৈতিক মানুষ। তাঁর কাছে বেশি সময়ই রাজনৈতিক আচরণ পাওয়া গেছে। আমি যখন আওয়ামী লীগ ছাড়ি তিনিই একমাত্র নেতা প্রথম বলেছিলেন, ‘কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ ছাড়লে কী হবে সে কখনো বঙ্গবন্ধুকে ছাড়েনি, সারা জীবনেও ছাড়বে না।’ ওই একই কথা পরে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম এ রকম অনেকে বলেছেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর চলে যাওয়ার কথা কোনো সংবাদপত্রে এক কলাম, কোনো সংবাদপত্রে দুই কলামে দেখলাম। কোনো কোনো দামি পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় সাজেদা চৌধুরী স্থান পাননি। অবক্ষয়ের জমানা না হলে প্রায় সবকটি পত্রিকায় সাজেদা চৌধুরীর চিরবিদায়ের খবর হতো ৮ কলাম জুড়ে। হয়তো পুরো প্রথম পৃষ্ঠাই থাকত সাজেদা চৌধুরীকে নিয়ে।
যাক, এখন তো আর সত্য তার সঠিক স্থান পাবে না। এখন সব কিছুই বাতাসে ওড়ে। যদি আবার কোনো দিন এ বলগা হাওয়া থেমে শান্তি-সুস্থিতি আসে তাহলে নিশ্চয়ই সারা বাংলায় হোক বা না হোক আওয়ামী লীগের ইতিহাসে আমেনা বেগম, সাজেদা চৌধুরী এবং জোহরা তাজউদ্দীনের নাম অনেক ওপরে লেখা হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাজেদা চৌধুরী বড় কষ্ট করে সীমান্ত পার হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে বাবলু, ছোটকা, লাবু ও মেয়ে মানুর বোঝা বইছিলেন ইসমত কাদির গামা। কাউকে কাঁধে, কাউকে কোলে, কাউকে বগলদাবা করে কত কষ্ট করে যে ভারত সীমান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন সে কথা কেই বা মনে করে! কদিন আমিও শুনেছি, বড় ছেলে বাবলু মাকে যথাযথ সম্মান করেনি, আদরযত্ন করেনি। কেন এমন হয়? বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি ব্লকে ২০০৪ সালে আমার মা যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তাঁর দুই পা বুকে চেপে রেখেছিলাম। ছাড়ার জ্ঞান ছিল না। পা বুকে নিয়ে কতবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ উচ্চারণ করেছিলাম। আমার উচ্চারিত কলমা মায়ের কানে গিয়েছিল কি না সে আফসোস আজও আমায় কুরে কুরে খায়। তাহলে এমন হবে কেন? আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেগম সাজেদা চৌধুরী ছিলেন একজন দিকপাল, সব কিছুর জন্য মানানসই। ২৪ ঘণ্টা আওয়ামী রাজনীতি করেছেন। তার পরও যথাযথ স্বস্তি পাননি, মর্যাদা পাননি। কষ্টই পেয়েছেন বেশি। মানুষ মরণশীল। সবাই মরবে। সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে আল্লাহ তাঁকে বেহেশতবাসী করুন।
আজ পাঁচ দিন পড়ে আছি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। আদরযত্ন অসাধারণ। সব রোগীর জন্য যদি এমন হয় তাহলে নামকরা বহু দেশের চিকিৎসাকে পিছে ফেলে দিতে পারবে। এটা সত্য, আমাকে দেখা আর অন্যদের দেখাশোনা কোনোক্রমেই যে এক রকম হবে না নির্দ্বিধায় বলা চলে। তবু বলছি, যদি হতো ভালো হতো। ৩০ আগস্ট মঙ্গলবার টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। বহুদিন পর পিতার সমাধিতে। বড় ভালো লেগেছে, প্রশান্তি লেগেছে। শরীর ছিল বড় ঝরঝরে তরতরে। সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে গোসল সেরে খাবার খেয়ে ৮টা ৩০-এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে ৯টা ৩০-এ পদ্মার পাড়ে পৌঁছেছিলাম। তারপর একদল পাচ্চরের বাহাদুরপুর, আরেক দল ভাটিপাড়া সাম্পানে খাবার খেয়ে নিরাপদে পিতার সমাধির দিকে এগোচ্ছিলাম। কিন্তু গোনাপাড়া মোড়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সড়ক অবরোধে অনেক সময় আটকে ছিলাম। প্রখর রোদে ছেলেমেয়েগুলো কাঁদছিল আর সেøাগান দিচ্ছিল। ওদের কথা সরকারি সব উচ্চমহলে জানিয়েছিলাম। হাসপাতালে এসে পড়ায় শেষের খবর আর নিতে পারিনি কতটা কী হয়েছে। ৩১ ও ১ তারিখ কিছুই বুঝিনি। ভালোভাবেই সব কাজকর্ম করেছি। ৩ তারিখ রাতে বুকে ব্যথা। কষ্ট হলেও রাতে কাউকে জানাইনি। সকালের দিকে আপনা থেকেই ব্যথাটা কমে এসেছিল। বারবার মনে করছিলাম গ্যাসের ব্যথা হবে। গ্যাসের তেমন একটা ওষুধ খাই না। তবু একটা অ্যান্টাসিড খেয়েছিলাম। ব্যথাও কিছুটা কমে এসেছিল তাই পরদিন টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। কোনো কষ্ট অনুভব করিনি। ওভাবেই শেখ সেলিম এমপির বাড়ি গিয়েছিলাম। প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা কথা হয়েছে। কত কথা, কত আনন্দ, কত বেদনা। খালাম্মার কথা, ছোট্ট পরশ-তাপসকে কোলে নেওয়ার কথা, শেখ পরিবারের একমাত্র মারুফ প্রতিরোধ যুদ্ধে শরিক হয়েছিল সেসব কথা। প্রায় ৮-১০ বছর পর দেখা হওয়ায় তারও হয়তো হৃদয়ের কপাট খুলে গিয়েছিল। অনেক কথা বললেন। ফেরার সময় দুটি অমূল্য বই উপহার দিয়েছেন। একটি বঙ্গবন্ধুর ওপর, আরেকটি ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘটনাবহুল ইতিহাস’। বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা বইটি নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখেছি। এখনো পড়া হয়নি। তবে ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘটনাবহুল ইতিহাস’-এর কিছুটা পড়েছি। আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। বুকভরা এত পা-িত্য আছে কখনো ভাবিনি। প-িত ভেবেছি মণি ভাইকে। একেবারে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ঘরে ঢোকার পথেই সেলিম ভাইয়ের ছেলে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নাঈমকে পেয়েছিলাম। খুবই ভালো লেগেছে। ওর সঙ্গে আরও একবার কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। ভালোভাবেই বাসায় ফিরেছিলাম। কিন্তু কেন যেন ৬ তারিখ ১০টার পর থেকে একটু একটু ব্যথা অনুভব করছিলাম। সে আর বাড়া-কমার নাম নিচ্ছিল না। একইভাবে সামান্য ব্যথা। ওই নিয়েই কালিহাতী কর্মিসভায় গিয়েছিলাম। প্রায় তিন বছর পর কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ। একটা ভরপুর কর্মিসভা। যেমন হওয়ার কথা তেমন হয়েছিল। সব জায়গার নেতা-কর্মীরা এসেছিলেন। মাইক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎ ছিল না। আগাগোড়াই খালি গলায় হাজার মানুষের সামনে বক্তৃতা করার অভ্যাস। সেদিনও তাই করেছি। বলার চেষ্টা করেছি, বিরোধী দল হলে তারা কেউ আমাদের শত্রু না। সমালোচনা করা আর শত্রুতা করা এক কথা নয়। দেশের জন্য যাদের ভূমিকা আছে তারা বিরোধী হলেও তাদের সম্মান করতে হবে। আবু সাঈদ চৌধুরী নেই, শাজাহান সিরাজ নেই, কাল আমি থাকব না, লতিফ সিদ্দিকীও থাকবেন না। আমার দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ থাকবে। তারা যদি সবাইকে যথাযথ সম্মান দিতে পারে তা হলেই হবে আমাদের দল গঠনের সার্থকতা। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ জনগণের মালিক নয়- জনগণের সেবক, জনগণের পাহারাদার। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে হামিদপুর কালিহাতীর প্রথম যুদ্ধে আলী আজগর শহীদ হয়েছিল। আজ কেউ তাঁর কথা মনে রাখে না। কুষ্টিয়া কামার্তির লাল মিয়া, সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক, যাঁরা না হলে আমরা কালিহাতীতে দাঁড়াতেই পারতাম না। মুসলিম লীগের দাপটে কোথায় হারিয়ে যেতাম। আজ তাঁদের নাম নেই। হুমায়ুন বাঙাল, মুক্তিযুদ্ধে যাঁর দুর্দান্ত ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা কে কোথায় অতীতের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছেন। এখান থেকে খুঁজে বের করে আনাই কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা-কর্মীদের প্রধান কাজ। নিশ্চয়ই আমরাও নির্বাচন করব। নির্বাচনের সময় নির্বাচন করব। কিন্তু অন্য সময় আমাদের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা হবে মানবসেবা। আমরা সেখান থেকে পিছিয়ে পড়ব না। আমরা আওয়ামী লীগ করি না, বিএনপি করি না। আমাদের আদর্শ বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। আমরা বঙ্গবন্ধুকে সারা বাংলার বন্ধু বানাতে চাই। তাঁকে আমরা সার্বিকভাবে সব দেশবাসীর অন্তরে শ্রদ্ধার স্থানে স্থাপিত করতে চাই। সেজন্য আমাদের অনেক দায়িত্ব। অন্যকে তাচ্ছিল্য করে হিংসা করে ছোট বলে আমরা বঙ্গবন্ধুকে বড় করতে পারব না, মানুষের অন্তরে জায়গা করতে পারব না।
সেদিন সিসিইউতে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী এসেছিলেন। হাত ধরে অনেক সময় বসে ছিলেন। মনে হচ্ছিল আমি যেন বাবার হাত ধরে আছি। ছোটবেলায় বাবার আঙুল ধরে বাড়ির পাশের আউলিয়াবাদ হাটে যেতাম। সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। রাগ করে কত বকাবকি করেছেন, মারধর করেছেন। কিন্তু বড় ভাই বড় ভাই-ই, বাপের সমান। আজ যে যত বড় নেতা হয়েছে খুব কম নেতাই আছে যারা লতিফ সিদ্দিকীর জুতা টানেনি। আমিও টেনেছি। আইয়ুব-মোনায়েম বিরোধী আন্দোলনে লতিফ সিদ্দিকীর দুর্বার সাহস সংগ্রাম আর সংগ্রাম আমাদের বড় উজ্জীবিত করেছে। আমরা সাহসী হয়েছি, সংগ্রামী হয়েছি। সারা জীবনই লতিফ সিদ্দিকী বিরোধী একটি বলয় কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধু থাকতেও করেছে, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরও করেছে। যে কারণে লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ থেকে বাদ পড়তে হয়েছে, যে খোঁড়া যুক্তি দেখানো হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম প্রসঙ্গে যা তিনি বলেছেন তার ৯০ ভাগ অ্যাকাডেমিকালি শুদ্ধ। রসুল (সা.)-কে তিনি কোনোমতেই ছোট করেননি।
এই যে সেদিন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারতে গেলেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতা গিয়েছিলেন তখন ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি থেকে উড়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন রাশিয়া গিয়েছিলেন তখন প্রটোকল ভেঙে সবাই বিমানবন্দরে ছিলেন। শত্রুর দৃষ্টি থেকে দেখলেও বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকেও কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এ কথাগুলো ভুলে যাওয়ার নয়। শুনলাম, সাতটি সমঝোতা চুক্তিতে সই হয়েছে। সমঝোতা চুক্তি সাধারণত বিষয় নির্বাচন করা। ওইসব বিষয়ের ওপর আলোচনা হবে, দুই দেশ ভালোমন্দ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করবে তারপর কার্যকর হবে। আমরা তিস্তার জন্য ডুবে মরছি, ভেসে যাচ্ছি। তিস্তা নিয়ে কোনো কথা নেই। কুশিয়ারা নিয়ে চুক্তি হয়েছে। কুশিয়ারাও একটা সমস্যা। কিন্তু তিস্তার থেকে খুব বড় সমস্যা নয়। কী বলব বোঝাতে পারছি না। এত দিনের কাক্সিক্ষত একটি ভারত সফর চট করে কীভাবে সফল বলি। তার ওপর আবার আমাদের প-িত পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি ভারতে গিয়ে যা যা বলে এসেছেন তা আবার দেশবাসীকে জানিয়ে সর্বনাশ করেছেন। এখন মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানো মানুষের প্রয়োজন। না হলে দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রশাসন মুখ থুবড়ে পড়বে। কেউ কারও মেধা কাজে খাটাতে পারছে না। একবার মানুষ পরনির্ভরশীল হয়ে পড়লে তার কোনো ব্যক্তিত্ব থাকে না। তার দ্বারা কোনো কাজও করা যায় না। এর আমি একজন শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধে যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছি অনেকেই তার দ্বিগুণ তিন গুণ করেছে। আবার কেউ কেউ লেজ গুটিয়ে বসে পড়েছে। লেজ গুটানোদের দ্বারা আর পরে কোনো কাজ হয়নি। আমার প্রিয় বোনের ক্ষেত্রেও প্রায় অনেকটাই তেমন হয়েছে। অথর্ব স্তাবকদের দিয়ে তিনি আর কিছুই করতে পারবেন না। তাই এ ব্যাপারে তিনি যত তাড়াতাড়ি ভাববেন ততই মঙ্গল।
ছোটাছুটি করা মুক্তমনের মানুষের হাসপাতালের নিয়মবাঁধা জীবন কখনো ভালো লাগে না। কেউ কেউ দেখা করতে আসে। তাদের দেখে খুবই আনন্দ লাগে। সেদিন আশ্চর্য হয়েছিলাম হঠাৎই শাহ মোয়াজ্জেম ভাই এসেছিলেন। তাঁকে নিয়ে ইদানীং সুনামে বদনামে ভরা। প্রায় ১০-১২ বছর আগে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। আমাকে আগাগোড়াই ভাই বলে ডাকলেও সন্তানের মতো আদর করেন, যত্ন করেন। বিক্রমপুরের ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানবদের মধ্যে বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর একজন। এ ধরনের কয়েকজনকে বাদ দিলেই শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সম্মান, মর্যাদা ও জ্ঞান-গরিমা আমার কাছে আকাশসমান। সেই ’৬০ সালের কথা- শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সভাপতি, শেখ ফজলুল হক মণি সাধারণ সম্পাদক। আরও অনেক নেতাসহ তাঁরা টাঙ্গাইলে গিয়েছিলেন। রওশন টকিজে ছাত্রলীগের সম্মেলন। উপচে পড়া ভিড় হয়েছিল। আমরা শুনেছিলাম আইয়ুব খান শেখ ফজলুল হক মণির এমএ ডিগ্রি দুবার বাতিল করেছেন। ছোট মানুষ, কোনো ডিগ্রি বাতিল করা যায় ওসব জানা ছিল না। তাই তাঁর প্রতি আকর্ষণ বেশি। চমৎকার সাবলীল বক্তৃতা করেছেন। সেই আমার জীবনে প্রথম কোনো সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া। প্রচন্ড গরমে হলের অনেক লোক বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন যখন দাঁড়ালেন, তার প্রতিটি কথা হলের ভিতর আলোড়ন তুলছিল। মনে হচ্ছিল হলের টিনের বেড়া শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বক্তৃতায় একটি একটি করে খসে পড়ছে। হল ভরে গেল মানুষে। হলের সামনে রাস্তা ভরে গেল। হলে ৫০০-৬০০ সিট। রাস্তায় ৫-১০ হাজার। দম বন্ধ করা অবস্থা। মনে হলো চারদিকে বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কারও কোনো আকারবিকার নেই। ঘামে শরীর ভিজে যাচ্ছে আমরা কেউ বুঝতেও পারছি না। এক-দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন, আমরা শুধু তন্ময় হয়ে শুনলাম আর ভাবলাম আইয়ুব-মোনায়েমের আমলে এমন সাহসী কথা কেউ বলতে পারে! শওকত আলী তালুকদার সভাপতি, লতিফ সিদ্দিকীকে করা হলো সাধারণ সম্পাদক। টাঙ্গাইল মহকুমাকে মর্যাদা দেওয়া হলো জেলার। এরপর চলল সংগ্রাম আর সংগ্রাম। ’৬৯-এ এলো গণঅভ্যুত্থান। আরও নেতা হিসেবে বেরিয়ে এলেন মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন। তত দিনে লতিফ সিদ্দিকী দিগ্বিজয়ী নেতা আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডার যখন বিশ্ব বিজয়ে বেরোতে চেয়েছিলেন মেসিডনের রাজা আলেকজান্ডারের পিতা ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি বিশ্ব বিজয়ে বেরোবে যাও, ঘোড়াশালে একটা ঘোড়া কদিন থেকে কথা শুনছে না। লাফালাফি করছে। সেটাকে যদি তুমি ঠিক করতে পার তাহলে তুমি বিশ্ব জয় করতে পারবে। ঘোড়াশালে গিয়ে দেখেন সত্যিই ঘোড়া লাফালাফি করছে। কিছুক্ষণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন উল্টো দিকে ঘোড়াটিকে বাঁধা হয়েছে। সে তার যেই ছায়া দেখছে অমনি লাফালাফি করছে। আলেকজান্ডার এক হ্যাঁচকা টানে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দেন। ঘোড়াটি কিছুক্ষণ ছায়া না দেখে শান্ত হয়। আলেকজান্ডার পিতার কাছে ফিরে এসে বলেন, আপনার ঘোড়াকে শান্ত করে এসেছি। পিতা অবাক, ‘তুমি এত তাড়াতাড়ি ঘোড়াকে শান্ত করলে কী করে?’ ব্যাপারটা কিছুই না। আমি গিয়ে দেখলাম ঘোড়া তার ছায়া দেখে লাফালাফি করছে। কিছুক্ষণ পর যখন এক হ্যাঁচকায় ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিলাম সে শান্ত হয়ে গেল। পিতা আলেকজান্ডারকে বললেন, ঠিক আছে তুমি বিশ্ব বিজয়ে বেরিয়ে যেতে পার।
’৬৬ সাল আমার কাছে প্রায় তেমন ঘটনা। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে থাকি। সেনাবাহিনীর সিপাই। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের বিশাল সভা। গিয়ে দেখি লোক আর লোক। ১৫-২০ হাজারের কম হবে না। প্রধান অতিথি চাঁদপুরের মুকুটহীন সম্রাট মিজানুর রহমান চৌধুরী। ছাত্র বক্তা লতিফ সিদ্দিকী। লতিফ সিদ্দিকী যখন বক্তৃতা করছিলেন সারা মাঠ মনে হয় দুলছিল। খেত-খামারে যেমন সোনালি ধান দোলে তেমনি দুলছিল। করতালি থামছিলই না। অনেক সময় ধরে বক্তৃতা করেছিলেন। আমার সারা দেহ-মন পুলকিত হয়েছিল। সাহস করে বড় ভাইয়ের কাছে যাইনি। চলে এসেছিলাম ক্যান্টনমেন্টে। তারই কয়েক মাস পরের কথা। ভৈরব কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠান। লতিফ সিদ্দিকী প্রধান অতিথি, জিল্লুর রহমান সাধারণ বক্তা। কুমিল্লার মতো লোকজন ছিল না। কিন্তু কলেজ আঙিনা ছিল টইটম্বুর। পা রাখার জায়গা ছিল না। এই লতিফ সিদ্দিকীর প্রধান গুরু ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। আগাগোড়াই শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন আমাদের নেতা, আমাদের গুরু। ছয় দফা, ১১ দফার মধ্য দিয়ে ’৭০-এ সাধারণ নির্বাচন হলো। পৃথিবীর বিস্ময় বাংলাদেশের নির্বাচন। ৯৯ ভাগ আসন জয় করল আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানিরা ভোটের অধিকার মেনে নিল না। ব্যালটকে ছিন্নভিন্ন করতে চাইল বেয়নেট দিয়ে। আমরা তা হতে দিইনি। যে নেতারা সত্যিই তাদের ঘাম-শ্রম দিয়ে দেশকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা অস্ত্রহাতে যুদ্ধ ময়দানে জীবন দেওয়া-নেওয়া ততটা পেরে না উঠলেও যুদ্ধে জোগান দেওয়া, পৃথিবীব্যাপী জনমত তৈরি করা, শরণার্থী দেখাশুনা এসব কাজে সামান্য কিছু টাউট বাটপাড় নেতানেত্রী ছাড়া বাকিরা অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে মনে হয় দুটি ঘটনাই এমন বিস্ময়কর। এক. ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোয় হিন্দু সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দকে ৩ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। তিনি ৩ ঘণ্টা কয়েক মিনিট হিন্দু শাস্ত্রের ওপর বক্তব্য দিয়েছিলেন। বিচারকদের বেল বাজানোর কথা মনে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধেও ঠিক তেমনি ভারতের যৌথ পার্লামেন্টে আমাদের তিন প্রতিনিধি ফণীভূষণ মজুমদার, নূরজাহান মুরশিদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন গিয়েছিলেন বাঙালির দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরতে, ভারতীয় পার্লামেন্টকে অভিহিত করতে। ফণী দা ও নূরজাহান মুরশিদ লিখিত বক্তব্য পড়েছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন যখন বক্তৃতা করতে দাঁড়ান তখন হাউসে গুঞ্জন উঠেছিল, লিখিত বক্তৃতাই যদি শুনতে হয় তাহলে সময় নষ্ট করে লাভ কী? কাগজ পাঠিয়ে দিলেই আমরা পড়ে নিতাম। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ডান হাতে যে কাগজ ছিল তা তিনি হাত থেকে ছেড়ে দেন। কাগজটি বাতাসে হেলেদুলে ফ্লোরে পড়ে যায়। পুরো হাউস টেবিল চাপড়ে স্বাগত জানায়। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলতে শুরু করেন, ‘আমি বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের পক্ষ থেকে এসেছি। আমি কোনো দিন কোনো পার্লামেন্টে বক্তৃতা করিনি। আমি বাংলাদেশের পার্লামেন্টের সদস্য। এ কারণে আমার ১৪ বছর জেল হয়েছে। তবু আমি মহান ভারতের পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়েছি। এ আমার বক্তৃতা নয়, এ আমার দেশের দুঃখী মানুষের কান্না যা আমার কণ্ঠে উচ্চারিত হতে চলেছে। ভুলত্রুটি যা কিছুই হোক ক্ষমা করবেন। আমার কান্না, আমার দেশের কান্না যদি আপনাদের দেহ-মন সামান্য স্পর্শ করতে পারে আমি ধন্য হব।’ তিনি ভারতের যৌথ পার্লামেন্টে ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট তাঁর দুঃখ-বেদনা-আনন্দ, শৌর্যবীর্য তুলে ধরেছিলেন। টেবিল চাপড়ানো ছাড়া মাননীয় সদস্যদের আর কোনো কাজ ছিল না। বক্তৃতা শেষে তাঁকে যে কত মানুষ বুকে জড়িয়ে ধরেছিল তার কোনো লেখাজোখা নেই। শিকাগোয় যেমন আর কেউ স্বামী বিবেকানন্দের মতো বিচারকদের ভুলিয়ে দিয়ে ৩ মিনিটের জায়গায় ৩ ঘণ্টা অমর বাণী শোনাতে পারেননি, তেমনি ভারতের পার্লামেন্টেও নয়। কত বড় বড় নেতা এসেছেন, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, সোভিয়েত ইউনিয়নের কোসিগিন, আমেরিকার বুশ, ক্লিনটন, বাইডেন আরও কতজন; কেউ না। আর কোনো দিন হয়তো ভারতের পার্লামেন্টের সদস্যদের তন্ময় করে ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট বক্তৃতা করতে পারবেন না। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভাবশিষ্য আর শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাবশিষ্য। বুঝতে পারলাম না আমরা কেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাম।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com