মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

দেবী দুর্গার রূপ কল্পনা

ফনিন্দ্র সরকার

দেবী দুর্গার রূপ কল্পনা

হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব দুর্গাপূজা। একে ‘দুর্গোৎসব’ বা ‘শারদোৎসব’ও বলা হয়। শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে শারদোৎসব কথাটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কখনো কখনো মূল পূজার অনুষ্ঠান হেমন্তকালে চলে যায়, কিন্তু আগমনি বার্তাটি শরৎকালেই এসে যায়। এসবের ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। আমি সে তাৎপর্যে যেতে চাই না, হিন্দুদের অধিকাংশ পূজানুষ্ঠানই কোনো না কোনো প্রতীক বা মূর্তি অবলম্বনে হয়ে থাকে। মহাশক্তি নিরাকার। এ শাশ্বত সত্যের ওপর ভর করে ভক্ত তার হৃদয়মন্দিরে ভক্তিভাব সমৃদ্ধ করতে মহাশক্তিকে রূপ কল্পনায় প্রতিষ্ঠিত করে। রূপের মাধ্যমে উপাসনা পরমব্রহ্ম বা পরমেশ্বরেরই আরাধনা। এ পরম সত্তা সগুণে ঈশ্বর বা শক্তি। এটি অভিন্ন তত্ত্ব। পরমেশ্বরের শক্তিরহস্য দুরধিগম্য। মুনিঋষিরা শক্তিরহস্য উদ্ঘাটনে সচেষ্ট। যুগ যুগ ধরে এ চেষ্টা চলছে। মানববুদ্ধিতে রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব নয়। শক্তিরহস্যকে তত্ত্ব ও ভাব- এ দুই প্রকারে কিছুটা ধারণা করা যায় মাত্র।

জগৎ সৃষ্টির আগে কী ছিল তা কেবলই ধারণার বিষয়। হয়তো জল স্থল অন্তরিক্ষ ছিল না; পৃথিবী স্বর্গাদি বা কোনো মানব ছিল না; চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, দিবারাত্রি এসব কিছুই ছিল না। এমনকি মৃত্যু-আমৃত্যুও ছিল না। তখন ‘অপ্রতর্ক্য’ অবস্থায় কী ছিল? হিন্দু শাস্ত্রানুসারে এর উত্তর একমাত্র ব্রহ্মই ছিলেন। পরমব্রহ্ম নিরোপাধক হয়ে কোনো কিছু সৃষ্টি করেন না। শাস্ত্রে আছে, ‘স্বধরা ত্বদেকং’-ব্রহ্ম আত্মমায়ায় নিবৃষ্ট ছিলেন। এ মায়াশক্তি জগৎ সৃষ্টির মূল কারণ। দুর্গা দেবীর আরেক নাম ‘চন্ডী’। চন্ডীতত্ত্ব নিয়ে একটি গ্রন্থ আছে সে গ্রন্থে দেবগণের একটি স্তুতি হলো-

‘হেতুঃ সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দৌষৈর্ণ জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা

সর্বাশ্রয়াখিলমিদং জগদংশ ভূতমব্যাকৃতা হি পরমা প্রকৃতি স্ত¡মাদ্যা॥’

অর্থাৎ আপনি সমগ্র জগতের মূল কারণ, আপনি সত্তাদি গুণময়ী হলেও রাগদ্বেষাদি দোষযুক্ত ব্যক্তি আপনাকে জানতে পারে না। আপনি বিষ্ণু ও শিবাদি দেবগণেরও অজ্ঞাত। ব্রহ্মা থেকে কীট পর্যন্ত অখিল বিশ্ব আপনার অংশভূতা কারণ আপনি সবার আশ্রয়স্বরূপা, আপনি ষড়বিকার রহিতা পরমা আদ্যা প্রকৃতি। আদ্যশক্তি বা প্রকৃতি সৃষ্টির অন্যতম একটি কারণ। দৃশ্যমান এ জগতে সবকিছুই মহাশক্তির রূপ-বিগ্রহ। আসলে এ শক্তি হচ্ছে মৌলশক্তি। এ শক্তিই দুই ভাবে প্রকটিত। যেমন জগৎপালক বা পালিকা ও জগদাত্মিকা মায়ারূপ। যেখানে এ শক্তি জগদংশভূতা, সেখানে তিনি মায়ারূপ অর্থে আবরিত। এ যেন জাদুকরের জাদু। জাদুকরই সত্য, তাঁর জাদু মিথ্যা। আবার যেখানে তিনি অব্যক্ত, সেখানে তিনি মায়াতীত-মহামায়া, স্বরূপশক্তি। এ মর্ত্য জগৎ পরমাত্মাময়ী সত্তার একাংশ। মায়ার জগৎ মানুষকে ভগবৎ-বিমুখ করে। মহামায়া মানুষকে ভগবৎ-অনুগামী করেন। বৈষ্ণব শাস্ত্রে দেখা যায় মায়াবিমুখ মোহন মহামায়া বা যোগমায়া উন্মুখ মোহন। এ মহামায়াই মহাবিদ্যার অংশ হিসেবে বিভিন্ন রূপে রূপায়িত হন ভক্তকুলে- যেমন দুর্গা, কালী, তারা; প্রভৃতি জগন্মাতার নানা অবয়বে বিকশিত। এর একটি বিকাশমান রূপ দেবী দুর্গা। দেবীর মায়ারূপ সমগ্র অন্তর ও বাহ্য জগৎকে আলোকিত করে রাখে। আত্মমায়ায় সর্বব্যাপী ব্রহ্মই ইচ্ছা জ্ঞান, ক্রিয়াদিতে শক্তিযুক্ত হয়ে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সাধন করেছেন। সেই অখন্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মই সচ্চিদনন্দময়ী রূপে প্রকাশিত। ইনিই দেবী দুর্গা। এই দেবী শক্তি বা দৈবীমায়াই জগৎকারণ, মহাকালি-যিনি কালকে কলন করেন।

আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতায় যে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে তাতে দেখা যায় জড় ও শক্তি কখনো বিযুক্ত থাকতে পারে না। এ শক্তিকে মাতৃরূপে বিজ্ঞানীরা উপাসনা করতে দ্বিধা করেন না। প্রাচীন ঋষিরা ব্রহ্মশক্তি রূপা জগন্মাতার উপাসনায় দুটো ভাবকে প্রাধান্য দিয়ে গেছেন- একটি ভক্তিভাব অন্যটি শক্তিভাব। এ দুটো ভাবের লক্ষ্য কিন্তু এক ও অভিন্ন। কার্যভেদে প্রয়োজনভেদে ঘটেছে এসব রূপ বৈচিত্র্য। এভাবেই দেবী দুর্গা কখনো সৌম্যা কখনো বা ভয়ংকরী।

‘চিত্তে কৃপা সমর নিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা।

 ত্বয়্যেব বরদে ভুবনব্রয়েহপি’॥

অর্থাৎ চিত্তে কৃপা, সমরে নিষ্ঠুরতা- এ উভয়ের একত্রে সমাবেশ ত্রিলোকে কেবল তোমাতে, তোমার আপাত নিষ্ঠুরতা আসুরিক বৃত্তির বিনাশ। আসলে এটি তোমার কৃপা। অস্ত্রঘাতে পবিত্র করে যেন স্বর্গে স্থান দান। এ তোমার অসুর বিনাশ নয়, অসুর উদ্ধার। এ হচ্ছে সন্তানের কল্যাণে মায়ের অনুশাসন। অনুশাসনই উত্তরণের পরম রাস্তা। হিন্দু শাস্ত্রমতে ভক্তের কাছে সব মূর্তিই বিশুদ্ধ জ্ঞানরূপা, বেদের রূপ। প্রখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ও গবেষক শ্রীধর স্বামী বলেছেন, ‘বিশুদ্ধোর্জিত সত্তমূর্তি’ সত্তাত্মিকা মূর্তি ভিন্ন ভিন্ন সাধকের শ্রদ্ধা-ভক্তির তারতম্যে সাত্তকি, রাজসী ও তামসী নানাভাবে উপাসিতা হন। যেমন এক বস্তুতে প্রকৃতিভেদে কারও প্রীতি, কারও অপ্রীতি, কারও দ্বেষ, কারও প্রেম বর্ষিত হয়। তাই জগন্মাতার দিব্য-শুদ্ধ সত্তাত্মিকা মূর্তিকে নিজ নিজ প্রকৃতি অনুসারে ভক্তেরা অর্চনা করে থাকেন। একই মহাশক্তির রূপবৈচিত্র্যে নানা নামে নানা মূর্তি ভক্তকুলকে আলোকময় করে থাকে।

দেবী দুর্গা মহাশক্তির অন্যতম প্রধান আধার। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা ভক্তের কাছে মমতাময়ী মা এবং ভক্তের পথচলায় মহান শাসক। মূর্তির রূপকল্পনায় যে দৃশ্যের অবতারণা হয় সত্যি তা বিস্ময়কর ও ভাবের জগতে সমৃদ্ধময়। দেবীর রূপবৈচিত্র্যে অধ্যাত্মবাদ আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গা পূজানুষ্ঠানে মুখরিত হয়ে মানবসমাজে সাম্যরূপে প্রতিভাত হয়।

হিন্দুদের বেদশাস্ত্রে বহু দেবতার উল্লেখ আছে। এসব দেবতা বিভিন্ন নামে ও পরিচয়ে আখ্যায়িত। দেবতারা পূজিত হন ভক্তদ্বারা। ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে দুর্গাপূজার কার্যক্রম পরিচালিত হবে এটাই সবার প্রার্থনা। 

                লেখক : কলাম লেখক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর