শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছেন মর্যাদাবান আলেম

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হারিয়ে যাচ্ছেন মর্যাদাবান আলেম

জগতের শ্রেষ্ঠ সন্তান আলেম সমাজ। সাধারণ মানুষ আলেমদের অনুকরণ-অনুসরণকেই আখেরাতের মুক্তির পাথেয় মনে করে। এ মনে করাটা এমনি এমনি নয়। আলেমদের মর্যাদা সম্পর্কে কোরআন-সুন্নাহয় এত এত গুরুত্ব এসেছে যে, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আলেমদের প্রতি মহব্বত রাখা সৌভাগ্য মনে করতে বাধ্য হয়েছে। আলেমদের মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণিত অসংখ্য হাদিস থেকে একটি শোনাচ্ছি আপনাদের। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত; রসুল (সা.) বলেছেন, ‘শুনে রাখো! আলেমরা নবীদের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকার। আর নবীরা সম্পত্তি হিসেবে দিনার বা দিরহাম রেখে যান না। তারা রেখে যান জ্ঞানসম্পদ। যে জ্ঞান অর্জন করল, সে প্রচুর লাভবান হলো।’ জ্ঞানী তথা আলেমরা নবীর উত্তরাধিকার হওয়ার কারণে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে এ হাদিসের প্রথম অংশে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান সংগ্রহে পথ চলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। কোনো জ্ঞানী যখন জমিনে পা রাখে ফেরেশতারা তার সম্মানে নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেয়। জ্ঞানীর জন্য প্রতিটি প্রাণী এমনকি সাগরের মাছ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও কল্যাণ প্রার্থনা করে। লাখো তারার চেয়ে চাঁদের আলো যেমন বেশি উজ্জ্বল, তেমনি ইবাদতে মগ্ন হাজারো ব্যক্তির চেয়ে একজন জ্ঞানী আল্লাহর কাছে অনেক বেশি দামি।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ) আলেমদের চলার পথে ফেরেশতারা পাখা বিছিয়ে দেয় কেন- এ সম্পর্কে জানতে চাইলে এক আল্লাহর অলি বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টিরাজ্যে একমাত্র আলেমরাই রাজকীয় মেহমান।’ সুরা ফাতিরের ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রাখো! আমার বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমসমাজই আমাকে ভয় করে।’ ভয় বলতে এখানে ভয়ংকর কিছু বোঝানো হয়নি। ভয় মানে হলো প্রেম হারানোর ভয়। মাহরুম হওয়ার আতঙ্ক। সৃষ্টিরাজ্য নিয়ে গবেষণার কারণে আলেমরা খোদাতায়ালার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন। আর তখনই তাদের মনে আল্লাহর প্রেম জাগে। প্রেম মানেই হারানোর ভয়। যেখানে হারানোর ভয় নেই, সেটা প্রেম হতে পারে না। একজন আলেম সব সময় সতর্ক আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অপছন্দ এমন কাজ তো বটেই এমন চিন্তাও যেন তার মনে না জাগে। এই যে সর্বক্ষণ প্রভুর অপছন্দ থেকে বেঁচে থাকার ফিকির, দয়াময়ের রহমত থেকে মাহরুম হওয়ার আশঙ্কা- শরিয়তে এ ভাবকেই তাকওয়া বলা হয়েছে। সত্যিকারের মুত্তাকি এমন ব্যক্তিই।

একটা সময় ছিল আলেমরা জনগণের মডেল ছিলেন। কেবল দূর অতীত নয়, আজও অল্প কয়েকজন আলেম আছেন যারা এখনো জনগণের অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। মানুষ তাদের ভালোবাসাকেই আখেরাতের মুক্তির অসিলা মনে করে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাকে ধর্মের বন্ধন বলে বিশ্বাস করে। আলেমের চেহারা দেখা, মুসাফা ও কোলাকুলি করা স্বয়ং নবীজির চেহারা দেখা, নবীজির সঙ্গে মুসাফা করা, কোলাকুলি করার সমান বলে হাদিসেই বর্ণিত হয়েছে। দুঃখের কথা হলো, দিন যতই বাড়ছে দলাদলি, হানাহানি, উগ্রতা আমাদের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা যারা আলেম, উম্মাহর জিম্মাদারি কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছি আমাদের চরিত্র, চিন্তা-চেতনা, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার, লেনদেন এক কথায় জীবনের কোথাও রসুলের আদর্শ বাস্তবায়ন করে জ্বলন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারিনি। সাধারণ মানুষের মাঝে আমরা বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। এর প্রমাণ হলো আজও মাদরাসা পড়ুয়াদের বড় অংশ বেকার। কিন্তু কথা ছিল মাদরাসা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় কোম্পানি ওই ছাত্রটিকে লুফে নেবে হিসাব বিভাগ দেখার জন্য। কারণ মাদরাসা থেকে বের হওয়া ছাত্রকে হিসাব বিভাগের দায়িত্ব দিলে সে আমানতদারিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। সামাজিক সালিশে মদখোর ঘুষখোর নেতাকে বাদ দিয়ে মসজিদের ইমামকে দায়িত্ব দেবে মানুষ। এলাকার নির্বাচনে আলেমরা জনপ্রতিনিধি হবেন। না এমন কোনো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। তবে হ্যাঁ! আমাদের মাহফিল বেড়েছে। শ্রোতা বেড়েছে। সমর্থক বেড়েছে। দাতা বেড়েছে। মসজিদ বেড়েছে। কিন্তু মানুষ আমাদের বিশ্বাস করে ব্যবসা, দোকান, ক্যাশ, নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব দেবে সেটা হয়নি।

পাঠক! গভীরভাবে ভেবে দেখুন, তখনো হুজুর (সা.)-এর এত ফলোয়ার হয়নি, মসজিদ হয়নি, মাহফিল জমেনি কিন্তু তিনি আল আমিন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কেমন আল আমিন? হুজুর (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে মক্কার কাফেররা। নবীজি আজ রাতে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করে চলে যাবেন। এমন সময় নবীজি বলেন, ‘আলী! আমি চললাম। ওই যে বাইরে যারা দাঁড়িয়ে আছে, সুযোগ পেলেই আমার গর্দান উড়িয়ে দেবে- এদের এই এই সম্পদ, স্বর্ণ, অর্থকড়ি আমার কাছে আমানত রেখেছিল। তুমি এগুলো সবার হাতে পৌঁছে দিয়ে তবে মক্কা ছাড়বে।’

এরও আগের ঘটনা। হুজুর (সা.) নবুয়তি দাবি করার সঙ্গে সঙ্গে মক্কার প্রতিটি লোক তাকে মিথ্যুক, পাগল বলে গালাগালি করছে। রাস্তায় পেলে মারধর করছে। আবার রাতের আঁধারে ওই লোকেরাই এসে বলছে, মুহাম্মদ আমার এ জিনিস তোমার কাছে আমানত রাখলাম। তুমি ছাড়া পুরো আরবে এমন পরম বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। কি আশ্চর্য! যারা তাঁকে মেরেছে তারাই আবার তাঁর কাছে মূল্যবান সম্পদ আমানত রেখে যাচ্ছেন তারা জানে, মুহাম্মদের সঙ্গে যতই শত্রুতা করি, নির্যাতন চালাই তাঁর ও তাঁর লোকদের ওপর, তবু তিনি আমানতের খেয়ানত করবেন না।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর