শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর এক ছাত্রের কথা

মাওলানা মাহমূদুল হাসান

ফেকাহর মাশহুর চার ইমামের সবচেয়ে বড় ইমাম হলেন আবু হানিফা (রহ.)। তাঁর আসল নাম নোমান, পিতার নাম সাবিত। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন অনেক জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ। তৎকালীন সরকার ছিল ইমামে আজমের বিরোধী। তখন বিশ্বে প্রতি ১০ জন হাফেজ, কারি ও আলেমের মধ্যে সাতজনই তাঁর অনুসারী। তিনি এত বড় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও জালেম সরকারের রোষানল থেকে রক্ষা পাননি। অন্যায়ভাবে তাঁকে কারাগারে আবদ্ধ রাখা হয় এবং বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে সেখানেই হত্যা করা হয়। যা হোক, তাঁর একজন বিশিষ্ট ছাত্রের কথা বলব। যিনি ছিলেন একাধারে মুহাদ্দিস, ফকিহ, মুবাল্লিগ ও মুজাহিদ। আহলে ইলমের কাছে তাঁর নাম খুবই পরিচিত। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক। তাঁর বাড়ি খুরাসানে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মৃত্যুর ৩১ বছর পর ১৮১ হিজরিতে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি একটি স্মরণীয় কথা বলেছিলেন। মসজিদে প্রবেশের সময় জুতা উল্টাপাল্টা দেখে আমার সেই কথা মনে পড়ে যায়। ঘটনা হলো, তিনি এক দিন এক জায়গায় গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তখন তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ২০ বছর আগে এই স্থানে আল্লাহর সঙ্গে আমার বেয়াদবি হয়েছে। কী বেয়াদবি? এই যে খেত দেখা যায়, একদিন আমি রাস্তা বাদ দিয়ে এই খেতের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাই। যার ফলে একটি বা দুটি মরিচের চারা নষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর আমি খেতের মালিককে অনেক চেষ্টা করে খুঁজে পেলাম। পরে জেনেছি, সে আমার ছাত্রের ছাত্র। আমি তাকে বললাম, রাস্তা বাদ দিয়ে তোমার খেতের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছি, যার ফলে তোমার খেত নষ্ট হয়েছে। সে বলল হুজুর, আপনার বরকতময় পা আমার খেতে লেগেছে, এতে আমি অত্যন্ত খুশি। মরিচের চারা সব নষ্ট হয়ে যাক, এতে কিছু আসে যায় না। তখন আমি বললাম, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি যতক্ষণ আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার কথা স্পষ্টভাবে না বলবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমার দিল শান্ত হবে না। আমার এরূপ পীড়াপীড়ির পর সে বলল, হুজুর! যদি আমি ক্ষমার কথা না বলি তাহলে আপনার অন্তর শান্ত হবে না, তাই আপনার অন্তরকে শান্ত করার জন্য আমি আপনাকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দিলাম। যদিও আমার কাছে আপনার সামান্যতম কোনো অপরাধ নেই। আজ ২০ বছর পর এই স্থান দিয়ে অতিক্রম করার সময় সেই অপরাধের কথা স্মরণ হয়ে গেল, আর চিৎকার দিয়ে পড়ে গেলাম। চিন্তা করুন, ওই মানুষগুলো কেমন ছিলেন! সাধারণ একটি ত্রুটি, যা থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তও হয়েছেন। প্রায় দুই যুগ পরেও তাঁর অনুশোচনা কত তাজা! আমরা প্রতিনিয়ত কথা ও কাজের দ্বারা কত মানুষকে কষ্ট দিই; তার জন্য অনুশোচনা তো দূরের কথা, খেয়ালই করি না। আল্লাহর সঙ্গে, রসুলের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে কত বেয়াদবি করছি, কিন্তু অন্তরে তার জন্য কোনো অনুতাপ জাগ্রত হয় না। পশুকে কষ্ট দেওয়াও কি বৈধ? অথচ আমরা পশুকে তো বটেই, আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকেও বিভিন্নভাবে কষ্ট দিচ্ছি। চক্ষু বন্ধ করলে আমাদের পাপের পরিমাণ সমুদ্রের মতো দেখা যায়। আখেরাতে যে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে? আমাদের কাজ দেখে তা মনে হয়, আমরা সন্দেহ করি। বিচারের সময় আল্লাহ দয়া করে আপন হক মাফ করতে পারেন, কিন্তু যদি বান্দার কোনো হক আমার ওপর থাকে, চাই তা এক পয়সা হোক, তা পাই পাই করে শোধ করা হবে। তখন পকেট ভরা ডলার থাকবে না যে, হাত ঢুকিয়ে বের করে বলবেন, নাও তোমার পাওনা। সমস্ত হকদার আপনার সামনে উপস্থিত হয়ে পাওনা প্রার্থনা করতে থাকবে। আপনার নেকি দিয়ে শোধ করতে হবে তাদের হক। সবার হক শোধ করার মতো নেকি কি আপনার পরকালীন অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন? জমা না করলে পাওনাদারদের গোনাহের বোঝাসমূহ আপনার কাঁধে চাপানো হবে। কোনো দেন-দরবারে কাজ হবে না। আল্লাহ বে-ইনসাফি নন। সবাই তাঁর কাছে সমান। সবাইকে তার প্রাপ্য যথাযথভাবে প্রদান করবেন। কারও প্রতি সামান্যতম অবিচার করবেন না। তাই আমাদের উচিত যার যে হক নষ্ট করেছি, তা দুনিয়াতেই আদায় করা। কারণ এক ফোঁটা বিষ যেমন পূর্ণ এক গ্লাস দুধ নষ্ট করে ফেলে। তেমনি সামান্য গোনাহই আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবন নষ্ট করে দিতে পারে। সাপ মানুষকে দংশন করে শরীরের এক স্থানে, এরপর তার বিষক্রিয়া সারা শরীরে ছড়িয়ে জীবন অবসান হয়। গোনাহও এরূপ, বরং এর চেয়েও মারাত্মক। গোনাহর দুনিয়াবী ক্ষতি সম্বন্ধে ‘এক মিনিটের মাদরাসা’ নামক কিতাবে আলোচনা করা হয়েছে। যা প্রতিদিন বাদ-আসর যাত্রাবাড়ীসহ অনেক মাদরাসায় পড়ে শোনানো হয়। এ বইটি প্রতিটি ঘরে থাকা উচিত এবং প্রতিদিন কিছু সময় এর তালিম হওয়া উচিত। গোনাহ পুরুষরাও করে, মহিলারাও করে! আর ছোট ছোট বাচ্চারা গোনাহর কাজ করে করে অভ্যস্ত হয়। যদিও তখন আমলনামায় গোনাহ লিপিবদ্ধ হয় না। কিন্তু অভিভাবকরা এর দায় এড়াতে পারবে না। তাই অভিভাবকদের খুবই সচেতন থাকতে হবে। পাপের ক্ষতিগুলো তাদের নিয়মিত অল্প অল্প করে পড়ে শোনালে বাচ্চাদের মনে গোনাহের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হবে। আল্লাহপাক আমাদের তাওফিক দান করুন!

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর