বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

জনসম্পৃক্ততা ছাড়া আন্দোলন সফল হয় না

নূরে আলম সিদ্দিকী

জনসম্পৃক্ততা ছাড়া আন্দোলন সফল হয় না

বাংলাদেশ আজ নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ। সভা-সমিতিতেও গর্জে ওঠে না বিরোধীদের অগ্নিস্নাত অবয়বগুলো, তাদের কণ্ঠে ঝরে না বজ্রনির্ঘোষ। এতটাই ছিমছাম পরিপাটি যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, এমনকি ’৬২-এর পর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও এমন শান্ত-প্রশান্ত উত্তাপ-বিবর্জিত রাজনৈতিক আবহাওয়া কোনো দিনই ছিল না। আমরা সেই যৌবনের উদ্ধৃত স্পর্ধিত জীবনে সামরিক ব্যক্তিত্ব লৌহমানবরূপে খ্যাত আইয়ুব খানের তক্ত-তাউস যখন প্রকম্পিত করতাম, সেই সময় থেকে বিস্তীর্ণ পথ-পরিক্রমণের অবিশ্রান্ত ধারায় আন্দোলনকে সূচারুরূপে পরিচালিত করে সমস্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দ্বিজাতিতত্ত্বের খোলস থেকে মুক্ত করে যখন বাঙালি জাতিসত্তার স্রোতধারায় অবগাহন করাতে পারলাম, সেই বিমূর্ত মুহূর্তগুলোয় এ দেশ ছিল উত্তাল। মানুষের হৃদয় ছিল স্পন্দিত, রাজপথ ছিল স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা ২৩টি বছর আমরণ সংগ্রাম করেছি, অনেক নির্যাতন-নিগ্রহের নির্মমতাকে আলিঙ্গন করে সম্মুখের পথে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছি, কখনো কোনো দিন আজকের এই রাজনৈতিক আবহাওয়ার এই নিস্তব্ধতা, এই নিথর পরিবেশের মুখোমুখি হইনি।

আজ যারা ক্ষমতাসীন তারা একটা অর্থহীন বা স্বকল্পকল্পিত পরিতৃপ্তিতে অনর্থক বুঁদ হয়ে আনন্দ পেতে পারেন। তারা হৃদয়ের কন্দরে কন্দরে অনুচ্চ স্বরে বলতেও পারেন, ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? প্রকৃত বাস্তবতা কি সত্যিই আনন্দে উচ্ছ্বসিত ঊর্মিমালায় অবলীলাক্রমে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো? এ কথা আজ নিষ্ঠুর বাস্তব, রাজপথে আজ কোনো মিছিল নেই। আজকের বিরোধী দল সত্যিই নিস্পৃহ ও নিস্তব্ধ। রাজনৈতিক বিকলাঙ্গ শক্তির মতো তারা ক্রমাগত ভুল পথে হেঁটে চলেছে। সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সাল থেকেই আমাদের পূর্বসূরি এবং আমাদের অনন্তকালের পথচলার সংগ্রাম ছিল আমাদের নিত্যদিনের সাথী। মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল আমাদের সঙ্গে ছায়ার মতো। কারাগারের নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা আমাদের সবার সঙ্গে নিত্যদিন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে থাকত। সেদিনের আন্দোলন তার নিজস্ব ধারাবাহিকতায় পরিচালিত হয়েছিল কিন্তু সফলতার দিক ছিল এই যে, আমরা সেই আন্দোলনের সঙ্গে জনগণকে একই সূত্রে গাঁথতে পেরেছিলাম। আমাদের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমণের নেতা ছিলেন, আন্দোলনের রথের সারথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে আমরা যারা তরুণ তাজা তপ্ত প্রাণের অগ্নিস্নাত কর্মী ছিলাম, যারা সহজেই মৃত্যুকে ভ্রুকুটি দেখাতে পারতাম, যারা কারাগারের নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণাকে উদ্ধত চরিত্রে বরণ করে নিতে পারতাম, তাদের সবার চোখের সামনে ছিল স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের প্রত্যয়দৃঢ় সুকঠিন শপথ। আমরা রাজপথকে উত্তপ্ত রেখেছিলাম কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এমনকি তারও পূর্বসূরি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোনো দিন নির্বাচনবিমুখ ছিলেন না। লৌহমানব (!) আইয়ুব খান যখন মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশে নির্বাচন দিলেন, তখনো আওয়ামী লীগ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে সেই নির্বাচনের মোকাবিলা করেছিল মাদারে মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে। তখন আমাদের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট ছিল, মৌলিক গণতন্ত্রের আওতায় এবং ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে আমাদের কাক্সিক্ষত ফল আসবে না। পরাজয় শতকরা এক শ ভাগ নিশ্চিত জেনেও ওই নির্বাচনটিকে জনসম্পৃক্ততা গড়ে তোলার কামনায় এবং সুদক্ষ রাজনৈতিক কৌশলে সেদিন এ দেশের সচেতন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তখনকার ছাত্রসমাজ এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও মাদারে মিল্লাতের সমর্থনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। তখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল এখতিয়ারও ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। তখনকার ছাত্র রাজনীতি ছিল প্রচণ্ড মুখরিত, বিস্ফোরিত এবং উজ্জীবিত। আমার মনে পড়ে, ছাত্রসমাজের আন্দোলনকে অবদমিত করার জন্য আইয়ুব খান কাউকে ফাঁসির দণ্ড প্রদান, কাউকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ইত্যাদি ভয়াবহ নির্যাতনের নিদর্শন একের পর এক তৈরি করেছিলেন। তার নির্যাতনমূলক সব পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল ছাত্র রাজনীতিকে উদগ্র সন্ত্রাসী কার্যক্রমের গহ্বরে ঠেলে দেওয়া। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আলোকিত প্রদীপ্ত প্রজ্জ্বলিত প্রত্যয়বোধ থেকে সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেদিন ছাত্র আন্দোলনে যারা আমাদের অগ্রজ ছিলেন, তারা আইয়ুব খানের ওই ফাঁদে পা দেননি। সুদৃঢ় ও বজ্রকঠিন বিশ্বাসের অতলান্তে অবগাহন করে তারা আন্দোলনকে সুষ্ঠু ও নিখুঁতভাবে পরিচালনার যে দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপন করেন, সেটি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সূর্যস্নাত মানুষগুলোকে গণতন্ত্রের প্রতি আরও ব্রতী হিসেবে প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছিল।

একটা কথা আজ আমার ভীষণভাবে মনে পড়ে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর দীর্ঘদিন কারাগারের নির্যাতন-নিগ্রহ সহ্য করে আমরা যখন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসি, তখন অবলোকন করেছিলাম যে, একদল তরুণ তাজা তপ্ত-প্রাণ যারা অত্যন্ত সাহসী কিন্তু রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত হয়ে একটা স্বকল্পকল্পিত বিপ্লবের দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছেন। তাদের বিপরীতে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি সত্যিই খুব দুরূহ এবং কঠিন পথচলার মতো ছিল। যেকোনো অবস্থায় রোমান্টিক বিপ্লবের কথা তরুণ তাজা তপ্ত-প্রাণকে অনিবার্যভাবেই আকর্ষণ করে। তরুণের প্রাণ বিপ্লবের ঘণ্টা শুনলেই আন্দোলিত হয়ে ওঠে, উদগ্রীব হয়ে ওঠে। আমি ’৬৯ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আশ্চর্যান্বিত হয়ে লক্ষ করলাম, সেই বিপ্লবের স্রোতধারায় অবগাহন করার জন্য ছাত্রলীগের একটি অংশ বিপ্লবের রোমান্টিকতায় এমন করে ভাসছিল যে, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা এমনকি রেজিস দেব্রেও যেন তাদের চেতনার কাছে ম্রিয়মাণ। ওই সমস্ত রোমান্টিক বিপ্লবীর উচ্চকিত স্লোগান এতটাই উন্মাদনা তৈরি করত যে, তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের স্লোগান দিলে অনেকটাই আপসগামী হিসেবে প্রতিভাত হতে হতো। এমনিতেই আমাকে তখনকার বাম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সিআইয়ের দালাল, আমেরিকার দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত একটা ভ্রান্ত ডানপন্থি বিপ্লববিরোধী সত্তা হিসেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করত। ওই বিপ্লবের মুখে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের কথা, ১৯৭০-এর নির্বাচনকে স্বাগত জানানোর কথা ও ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণের কথা উচ্চারণ করলে তারা তেজোদ্দীপ্ত ও তীক্ষè ভাষায় তাদের সেই পুরনো গীত তারস্বরে গাইতে শুরু করলেন। তাদের তির্যক মন্তব্য বিষমাখা তীরের মতোই বুকে এসে বিঁধত। আমার সমমনা সহকর্মী ও সহযাত্রীদের অনেককেই নিদারুণভাবে বিমর্ষ ও মর্মাহত হয়ে কীরকম যেন নিস্পৃহ হয়ে যেতে দেখতাম।

আমি তখন ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার আমার সহকর্মীরা ছাত্রলীগের তখনকার রাজনীতিতে নিতান্তই সংখ্যালঘিষ্ঠ ছিল। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের যে কাউন্সিল হয়, সেখানে আমার এবং আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ওপর ৮০ ভাগ সমর্থন থাকলেও এবং ’৬৯-এর শেষের দিকে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের ওই সম্মেলনে ছাত্রলীগের কাউন্সিল তাদের নেতৃত্ব নির্ণয় ও নির্বাচিত করতে পারনি। সেটি হলে পরবর্তীকালে জাসদের উদগ্র বৈপ্লবিক ভ্রান্ত চেতনায় গণতন্ত্র যেমন পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছে, জাসদের তথাকথিত বিপ্লবের উন্মাদনার আবির মাখানো সেসমস্ত ভ্রান্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি থানা লুট, খাদ্য ও পাটের গুদামে আগুন, যত্রতত্র আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের জাসদপন্থি সশস্ত্রবাহিনী গণবাহিনীর আঘাতে এত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীকে অসহায়ের মতো জীবন দিতে হতো না। সেদিনের চটকদার সামাজিক বিপ্লবের স্লোগান যুবসমাজকে একটা নিষ্ঠুর উত্তেজনার পথে অস্বাভাবিকভাবে টেনে নিতে সক্ষম হয়। সেদিন আমি শেখ ফজলুল হক মণি ভাইকে উজ্জীবিত করেছিলাম, বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, একটি উদীয়মান জাগ্রত উজ্জীবিত উচ্চকিত প্রত্যয়যুক্ত যুব সংগঠন গড়ে তুলতে না পারলে, আলোর দিকে ধেয়ে আসা পতঙ্গের মতো অগণিত যুবসমাজকে জাসদের গণবাহিনীতে যোগ দেওয়া থেকে আটকাতে পারব না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধুয়া তুলে তারা যে অন্ধ উন্মাদনা তৈরি করেছিলেন, তাতে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও পাঞ্জা লড়া আওয়ামী লীগের মতো সনাতন সংগঠনের একার পক্ষে সম্ভব হতো না। সে কি উন্মাদনা, সে কি চঞ্চলতা! আগুনের দিকে ঝাঁপ দেওয়ার উদগ্র বাসনায় তখনকার যুবসমাজের চিত্তে সে কি অস্থিরতা, চিন্তার সেকি ব্যাকুলতা। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিসেবে এমনিতেই আমি অনুধাবন করেছিলাম, আমাদের মূল সংগঠনেও গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের চাইতে তথাকথিত রোমান্টিসিজমের প্রলেপমাখা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আকর্ষণ ছিল অনবদ্য ও মারাত্মক প্রভাববিস্তারী। তাই বঙ্গবন্ধুর একান্ত আশীর্বাদ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগের পক্ষে (মুজিববাদ) বৈজ্ঞানিকদের সামাজিক বিপ্লবের ভুয়া আহ্বান মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এমনকি বিদ্যালয়সমূহেও জাসদপন্থি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের প্রচণ্ড প্রভাব নিষ্ঠুর বাস্তবতায় প্রতিভাত হচ্ছিল। আমি বলব না, জাসদ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে বা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল, কিন্তু এ কথা তো সহজেই অনুমেয়, তারা রাজনৈতিক অস্থিরতার যে পটভূমি তৈরি করেছিল, যে অনিশ্চয়তার আবহে বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনকে প্রকম্পিত করেছিল সেই দুঃসহনীয় পরিবেশটিকে পুঁজি করে পৈশাচিক খুনিরা এত বড় অঘটন ঘটানোর দুঃসাহসিক প্রয়াস নিয়েছিল যে, খুনিদের কেউই আগে-পাছে জাসদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল এটা জানা না গেলেও, জাসদের সামাজিক বিপ্লবের অস্থিরতা তখনকার রাজনৈতিক অঙ্গনকে যেমনভাবে পর্যুদস্ত করেছিল, সেই সুযোগ যে তারা নিয়েছে, বিশ্লেষণে সেটি পরিস্ফুটিত হয়। ১৫ আগস্টের অব্যবহিত পরই আমরা যখন কারাগারে অন্তরিন, তখন সিপাহি বিপ্লবের নামে একটা উদ্ভট ও উচ্ছৃঙ্খল এবং অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলার আবহে সেনাছাউনিতে অফিসার হত্যার যে হোলিখেলা শুরু করা হয়েছিল, সেটি সার্বিকভাবে সফল হলে আমরা জাতি হিসেবে আজ কোথায় থাকতাম, আমাদের কি বিবর্ণ, কি মলিন এবং কি অসহায় ইতিহাস রচিত হতো, তা আল্লাহই জানেন। সিপাহি বিপ্লবের উসকানির অংশ ছিল গণবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য এবং নানাবিধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পেছনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আমি সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমতে বিশ্বাস করি, কারাগারের অভ্যন্তরেও এ বিশ্বাস করতাম, কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে অবমুক্ত অবস্থায়ও করি। ওইসব তথাকথিত বিপ্লব বিন্দুমাত্র বাংলাদেশে সফল হলে এ দেশের শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিকতা খোলনলচেসহ বিলুপ্ত হয়ে যেত।

এখন অন্য একটি দিকে ফিরে আসতে চাই। আজকের রাজনীতিতে লক্ষ করি, সত্যিকার অর্থে কার্যকর, অর্থবহ ও জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের বিবর্জতায় শাসকগোষ্ঠী অনেকটাই স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কোনোরকম জনমতের তোয়াক্কা না করে নির্বিকার ও নির্বিচার তারা একটার পর একটা কার্যত একদলীয় শাসনব্যবস্থার কার্যক্রম চাপিয়ে দিচ্ছেন। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল একের পর এক অত্যন্ত নিরর্থক ও নির্মম ভুল রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। এ দেশের রাজনীতির একজন অতি ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে কোনোভাবেই আমি এটা বুঝতে পারি না, কোন অজুহাতে, কোন যুক্তিতে, কোন বিবেচনা ও বিশ্লেষণে তারা লাগাতারভাবে নির্বাচন বর্জন করেই যাচ্ছেন। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততায় তাদের এত অনীহা কেন? এ অনীহা তাদের মনের মধ্যে কালো মেঘের মতো জমাট বাঁধল কেন, কীভাবে ও কী কারণে? তারা আন্দোলনের দৃপ্ত পদচারণে রাজপথে নেই। তাদের মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাত মিছিলের বক্ষবিদীর্ণ করে গর্জে ওঠে না। যে-কোনো প্রতিবাদ দৃশ্যত পরিস্ফুটিত হতে হবে। মনে মনে কল্পনা করে কোনো আন্দোলন সংঘটিত করা যায় না। যেকোনো আন্দোলন সফল করার জন্য জনসম্পৃক্ততা অনিবার্য। এ বিষয়ে বিএনপির কারও সঙ্গে আলাপ হলে একটি কথাই উঠে আসে। এই নিরর্থক নির্বাচন তাদের জন্য কোনো ফল এনে দেবে না। এ উপলব্ধিটি নিতান্তই অবান্তর অবাস্তব এবং ইতিহাসের বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। সেই পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থেকে শুরু করে মাদারে মিল্লাতের সঙ্গে আইয়ুব খানের নির্বাচন, ’৬৪-এর নির্বাচন আওয়ামী লীগকে জনসম্পৃক্ততার রাখীবন্ধনের যোগসূত্রটি তুলে দেয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইয়াহিয়া খানের শাসনামলেই তার লৌহদৃঢ় স্বৈরশাসনকে মোকাবিলা করে এমনকি ইএলএফও (ইলেকশন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু যে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, তাতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের ১৬৭টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৫টিতে জয়লাভ করে। এ বিজয় শুধু অবিভাজ্য পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের পাদপীঠ তৈরি করেনি, আতঙ্কিত ভীতসন্ত্রস্ত পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনায় ইয়াহিয়া খান এ রায়কে অস্বীকার করলে এবং ১ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে সারা পূর্ব পাকিস্তান বজ্রনির্ঘোষে গর্জে ওঠে, আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে অগ্নি উদ্গীরণ করে। প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ গড়ে তোলার বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বান বক্ষে লালন করে সারা বাংলাদেশ গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠে।

সমস্ত পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে বিমোহিত হৃদয়ে আন্দোলিত চিত্তে অবলোকন করে ঐক্যবদ্ধ বাঙালির সেই বিস্ফোরণ ও অভ্যুদয়কে। বঙ্গবন্ধুকে কারারুদ্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে অবরুদ্ধ রাখলেও বাঙালির অপ্রতিরোধ্য মুক্তিযুদ্ধকে তারা বিন্দুমাত্র অবদমিত, প্রশমিত ও পর্যুদস্ত করতে পারেনি। বরং পরাজয়ের নির্মমতাকে অবলীলাক্রমে মেনে নিতে হয়েছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। সেই উদ্ধত, উচ্ছৃঙ্খল, পাশবিক ও পৈশাচিক শক্তি বাংলার জাগ্রত জনতা ও তরুণ তাজা তপ্ত-প্রাণের কাছে আত্মসমর্পণ করতে সেদিন বাধ্য হয়েছিল। সেদিনের আমাদের বিজয় শুধু রণাঙ্গনেই সংঘটিত হয়নি, বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সর্বত্র প্রতিটি ধূলিকণায়, প্রতিটি গ্রামগঞ্জে, নগরে-বন্দরে সর্বত্রই তাদের পরাজয়ের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আজকে তাই সেই সত্যের আলোকে আমি মনে করি, নির্বাচন বর্জন আন্দোলনকে সফল করে না বরং অনেকটাই পিছিয়ে দেয়। লাগাতার নির্বাচন বর্জন জনমনে অস্থিরতা ও আশঙ্কার জন্ম দেয় ও জাতীয় জীবনে অনিশ্চয়তা টেনে আনে। এমনকি আন্দোলনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে সরকারি দলকেও বুঝতে হবে, প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচন সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও বিএনপির অগণিত নেতা-কর্মী যারা সর্বতোভাবে বিএনপির আদর্শে অগ্নিস্নাত এবং যে বিশাল জনগোষ্ঠী বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে আগ্রহী, তারা বিএনপির এ সিদ্ধান্তে দিশাহারা। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বর্জন করলেও তার দলের নেতা-কর্মীরা জনগণের চাপ ও প্রভাবেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিভিন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ থাকলে যেখানে দলের তরফ থেকে একজন প্রার্থী হতো, ধানের শীষের প্রার্থী মানেই বিএনপির প্রার্থী হিসেবে পরিচিত হতো, সে ক্ষেত্রে একাধিক প্রার্থী নির্বাচনের প্রতীক নিয়ে স্ব স্ব এলাকায় স্বকীয় সিদ্ধান্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নিজেদের ভোট বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল আসছে না। বিএনপির নেতৃত্বের সবাই জানেন যে, তাদের অনুসারীরা তাদের সাংগঠনিক ভুল সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে থাকছেন না কিন্তু কেন্দ্রের একক মনোনয়ন না থাকার কারণে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির ভোটও নানাভাবে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। আরেকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাদের দলের এখন যাকে কেন্দ্রবিন্দু ভাবা হচ্ছে, তিনি বিদেশে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রাচুর্যময় জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তার বিলাসবহুল জীবন কর্মীরা উপলব্ধি করে আত্মহননের দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধীভূত হচ্ছেন। আমরা জানি, তাদের কেন্দ্রীয় ওই নেতা সাজাপ্রাপ্ত। বাংলাদেশে এলে তাকে কারারুদ্ধ হতে হবে। যদি আন্দোলনই চান, তবে এ কারাভোগে আপত্তি কেন? আমরা কি কারাগারের নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা সহ্য করিনি? আমাদের পথ কি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল? কণ্টকাকীর্ণ বিস্তীর্ণ পথ পরিক্রমণে আমাদের জীবন কি পর্যুদস্ত, বিপর্যস্ত, নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়নি? ২৩টি বছরের সংগ্রামে আমরা কত যে কণ্টকাকীর্ণ পথ হেঁটেছি, সেটি কি স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ নয়? তাই গণতান্ত্রিক আলোকচ্ছটাকে আলিঙ্গন করতে হলে, তাদের নেতাকে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে অকুতোভয়ে এগিয়ে আসতে হবে। যদি এগিয়ে আসতে পারেন, কারাগারের নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা যদি অকপট চিত্তে উদগ্র আকাক্সক্ষায় দুই হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে পারেন, তবে জনগণও যথাসময়ে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। নিরন্তর লাগাতার নির্বাচন বর্জন তাদের নেতা-কর্মীদের দলীয় শৃঙ্খলা থেকে ক্রমাগতভাবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এ বাস্তবতাকে কখন তারা বুঝবেন, এটি আজকের রাজনৈতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং সময়ের জিজ্ঞাসা।

লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি

সর্বশেষ খবর