বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আগুন

আগুন

আগুন ব্যবহারের মাধ্যমে আদিম মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর তার প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। মানবসভ্যতায় আগুনের গুরুত্ব, এর শক্তির রহস্য ও বহুরূপ মানবগোষ্ঠীর কাছেই একে স্বর্গীয় অথবা পবিত্র করে তুলেছে। আগুন উপাসক সম্প্রদায়ের কাছে আগুন দেবতা হিসেবে গণ্য। বিভিন্ন সূর্য উপাসনাকারী ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে আগুন হচ্ছে সূর্যের পার্থিব প্রতিভূ। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে আগুন হচ্ছে সর্বাধিক প্রাচীন পূজনীয় পবিত্র উপাদানগুলোর অন্যতম। পুরাণ আগুনকে মানুষ ও দেবতাদের মধ্যে সংযোগ সাধনকারী, মানব জাতি ও তাদের ঘরবাড়ির সুরক্ষক এবং মানুষের সব ক্রিয়াকলাপের সাক্ষী হিসেবে বর্ণনা করেছে। এ কারণেই সব গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান বিশেষ করে বৈবাহিক অনুষ্ঠানাদিতে অগ্নিমন্ত্র পাঠ ও আগুনকে বিয়ের সাক্ষী রাখা হয়। মৃতের সৎকার শেষে আগুন স্পর্শ করে শুদ্ধ হয়ে ঘরে প্রবেশ করতে হয় এবং শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানে আগুনের পূজা করা হয়। বৈদিক যুগের তিন প্রধান দেবতার একজন হলেন অগ্নি; তিনি মর্ত্যরে দেবতা, অন্য দুজন হলেন স্বর্গের ইন্দ্র ও অন্তরিক্ষের বরুণ। অগ্নিকে বলা হয় দেবতাদের মুখ বা দূত। কারণ, যজ্ঞে যে আহুতি দেওয়া হয় তা অগ্নির মাধ্যমেই অন্য দেবতারা পেয়ে থাকেন। বৈদিক ঋষিরা অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, আগুন অর্থাৎ তাপ হচ্ছে জীবনের উৎস এবং জীবের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান এবং সে কারণেই অগ্নিকে দেবতা হিসেবে পূজার প্রচলন শুরু হয়। অগ্নি একাধারে যজ্ঞ, গৃহ ও অন্নের অধিপতি। উপনিষদের ব্রহ্মার মতো অগ্নি সর্বভূতে বিরাজমান।

অগ্নিপূজায় প্রথমে নরবলির বিধান ছিল। কিন্তু এটি নৃশংস বিধায় একসময় পরিবর্তে গো-মহিষাদি বলির বিধান করা হয়। কিন্তু কৃষিকাজের স্বার্থে এসব প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে এর পরিবর্তে ছাগবলি প্রচলিত হয়, কারণ কৃষিকাজে ছাগের কোনো কার্যকারিতা নেই। বর্তমানে অবশ্য ‘মানবতা’বিরোধী বলে ছাগবলিও ক্রমে বন্ধ হয়ে আসছে। আর সমাজ পরিবর্তনের ফলে দুর্গা, কালী ইত্যাদি পৌরাণিক দেবতার পূজা প্রচলনের পর থেকে বর্তমানে অগ্নিসহ অন্যান্য বৈদিক দেবতার পূজাও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। অগ্নিকে আটটি লোকপাল বা বিশ্বের অভিভাবকদের মধ্যে একটি এবং বিশেষ করে, দক্ষিণ-পূর্ব চতুর্থাংশের প্রভু হিসেবে মনে করা হয়। পৌরাণিক ব্যক্তিত্বরূপে বিভিন্ন পর্যায়ে অগ্নি আবির্ভূত হয়েছেন নানা রূপে, যেমন অঙ্গীরার সন্তানরূপে, পিতৃ অথবা মানিশের রাজারূপে, মারুতরূপে, সন্ধিলার পৌত্ররূপে, তমসার শাসনকালে বিরাজমান সাতজন মুনির একজন রূপে, অথবা চতুর্থ মনুরূপে, অন্যতম তারকারূপে এবং একজন ঋষি বা কতিপয় বৈদিক স্তোত্রগীতের রচনায় উৎসাহ প্রদানকারীরূপে। অগ্নির আকৃতি সম্পর্কিত বর্ণনায় বলা হয়েছে- সাধারণভাবে অগ্নি দুই মুখ, তিন পা ও সাত বাহুবিশিষ্ট, যা লোহিত অথবা শিখাবর্ণের। তার সামনে দ্বিধাবিভক্ত লেজাকৃতির একটি ধ্বজা রয়েছে যার ওপর একটি ভেড়াও দেখা যায়। অন্যদের বর্ণনায় অগ্নি ছাগলের চামড়ার আসনে বসে থাকা লোহিত গাত্রবর্ণবিশিষ্ট স্থূলাকৃতির মানব, যার রয়েছে চোখ, চোখের ভ্রু, মাথা ও তামাটে চুল। তার দেহ থেকে সাতটি যশোধারা প্রশ্রুত এবং ডান হাতে রয়েছে একটি বর্শা। অগ্নির বাহন হিসেবে ছাগ ও অশ্বকে দেখা যায়। এর কারণ সঠিকভাবে বলা না গেলেও অনুমান করা হয় যে, অগ্নির মতো ছাগও সর্বভুক এবং অশ্ব অগ্নির মতোই তেজস্বী ও দ্রুতগতিসম্পন্ন। কাশ্যপ ও অদিতির সন্তান অগ্নি। অগ্নির সঙ্গী তথা শক্তি হচ্ছে স্বাহা। জ্যোতিষ্কমণ্ডলীতে শিশুমার নক্ষত্রমণ্ডলীর লেজদেশের একটি নক্ষত্রের নামও অগ্নি।

ইসলাম ধর্মে জিনেরা আগুনের তৈরি এবং জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপের মাধ্যমে পাপীদের শাস্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। মুসলমানরা দোজখের কঠিন আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মোনাজাতে আল্লাহর কাছে আর্জি পেশ করে থাকেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর