সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি লিফলেট ও মানবাধিকার চর্চা

অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান

লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি লিফলেট ও মানবাধিকার চর্চা

২০২১ সালে জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান Disinformation and freedom of opinion and expression শিরোনামে তার রিপোর্টে লিখেছেন, অসত্য তথ্য (ডিসইনফরমেশন) গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ। একই সঙ্গে তিনি এও লিখেছেন- এসব অসত্য তথ্য কঠোর হাতে দমন করাও মানবাধিকারের পরিপন্থী।  সুতরাং অসত্য তথ্যের প্রচারণা উভয় সংকটের জন্ম দিতে পারে। এ রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, সরকারকে বাকস্বাধীনতার অধিকারকে সুপ্রশস্ত করতে হবে যাতে করে অসত্য তথ্য জনগণের কাছে ধরা পড়ে যায় এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবকে তারা মোকাবিলা করতে পারেন। অসত্য তথ্য প্রচার-প্রপাগান্ডার হাতিয়ার বানিয়ে মানবাধিকার হরণের উদাহরণ সারা পৃথিবীতে রয়েছে। বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে অসত্য তথ্য ছড়িয়ে বৌদ্ধদের রোহিঙ্গা নিধনে প্ররোচিত করা হয়েছে। যার পরিণামে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য প্রচারের একটি সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের র‌্যাব এবং এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ও তৎকালীন কর্মরত ঊর্ধ্বতন ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্যাংশন আরোপ করে। এরই সূত্র ধরে আগামী ১০ ডিসেম্বর কিছু ভুঁইফোড় সংগঠনের উদ্যোগে লন্ডনে একটি র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে সম্প্রতি Human Rights Day Rally : Human Rights in Bangladesh- A Cry for Help শিরোনামে ইংরেজিতে একটি লিফলেট প্রকাশিত হয়েছে। এতে আয়োজকরা দাবি করেছেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্যাংশন দেওয়া হোক। তারা লিখেছেন- Sanction Hasina & Her Death Squad. এই লিফলেটে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে ভয়াবহ অসত্য তথ্য প্রচার করা হয়েছে। অবশ্য এতে তারা একটি সত্য তথ্য তুলে ধরেছেন। সত্য কথাটি হলো- যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন আরোপ করেছে। যাই হোক, আয়োজকরা তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে লিফলেটটিতে ব্যক্ত করেছেন। তারা পুরো সরকারের বিরুদ্ধে স্যাংশন চান। তাদের এ কর্মকান্ড থেকে এটি প্রতীয়মান হচ্ছে- বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের সুরে তারা কথা বলছেন।

ওই লিফলেটের শুরুতেই দাবি করা হয়েছে- সরকারিভাবে ৬৩১ জনকে অপহরণ ও গুম করা হয়েছে। এ তথ্যের উৎস কী? কত বছরে এ গুমগুলো হয়েছে তার কোনো উল্লেখ নেই। বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংগঠনেরও ভিত্তিহীন দাবি ছিল তাদের সংখ্যার কাছাকাছি। এ সংগঠনের দাবি, ৬৩৮ জন গুমের শিকার হয়েছে। এ সংগঠনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে হংকংভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন AHRC দাবি করেছে, ৬১৯ জন গুমের শিকার হয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, এ তিনটি সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের কোনোটিই ৬০০-এর নিচে নয়, যা কি না জাতিসংঘের WGEID দাবি করা সংখ্যার চেয়ে ঢের বেশি। অবশ্য আমাদের এও মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘের দেওয়া গুম হওয়া মানুষের তালিকায় দুজন বিদেশি নাগরিক রয়েছেন, ১০ জন পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন এবং ২৮ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ২৮ জনের অধিকাংশের বিরুদ্ধে আগে থেকেই মামলা ছিল। এদের কেউ মাদক মামলায়, আবার কেউ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত থাকার কারণে গ্রেফতার হয়েছেন। জাতিসংঘের এ তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনকে বিভিন্ন মামলায় কারাগারে আটক অবস্থায় পাওয়া গেছে। তা ছাড়া এ সিদ্ধান্ত টানলে ভুল হবে না যে, মামলার আসামিদের মধ্যে অনেকেই আইনের আওতা থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য গা-ঢাকা দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত দোষীদের অপরাধের বিচার চলমান রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড মেনে সাজা দেওয়া হচ্ছে। এ আদালতের রায়ে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের আইনে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য প্রতিবন্ধকতা ছিল। এর ফলে অভিযুক্তরা অসম সুযোগ পেতেন। মূল আইনে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের অধিকার ছিল না। ফলে ২০১৩ সালে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়া হলে শাহবাগ চত্বরে এ বিধানের বিপক্ষে আন্দোলন হয়। তখন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ জনদাবির মুখে ১৯৭৩ সালের আইনটি সংশোধন করে। অথচ এ লিফলেটে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে ‘বিচারিক হত্যাকান্ড’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এটা স্পষ্টভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত লিফলেট প্রচারকারীরা তাদেরই অংশ।

শাহবাগ চত্বরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের আন্দোলনকে বানচাল করে দিতে দেশজুড়ে তান্ডব শুরু করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামী। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নেমে আসে, ক্ষুণ্ণ হয় তাদের মানবাধিকার। অথচ লন্ডন থেকে প্রকাশিত লিফলেটে শাপলা চত্বর ম্যাসাকার, বগুড়া ম্যাসাকার এবং সাতক্ষীরা ম্যাসাকারের নামে তিনটি মনগড়া নারকীয় হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বিরোধী দলের সরকার উচ্ছেদের রাজনীতি এবং পরবর্তীতে বিরোধী দলের সংখ্যাতত্ত্বের রাজনীতি মানবাধিকারের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের চেয়ে ক্ষমতার প্রতি তাদের মোহকে স্পষ্ট করে তোলে। সেই একই গোষ্ঠী একই বিষয় নিয়ে আবার মাঠে নেমেছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। ধনী-গরিব কিংবা ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন আইনের দৃষ্টিতে সমান, আদালতে উভয়ের গুরুত্ব একই রকম হওয়া উচিত। প্রত্যেকের মানবিক মর্যাদা রক্ষা করা বিচারকের কাজ। যদিও সব ক্ষেত্রে তা হয় না। কিন্তু তাই বলে কি যখন হয় তখনো এর বিরোধিতা করতে হবে? বেগম খালেদা জিয়া একটি বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন হওয়ায় তিনি আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন? আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করে তাকে শাস্তি দিয়েছেন। তারপরও তার বয়স ও স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সরকার তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়েছে। সময়ে সময়ে প্যারোলের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এর চেয়ে বেশি তারা কী চান? যদি লিফলেট প্রচারকারীরা বলেন, বাংলাদেশে যেটুকু আইনের শাসন আছে তাও উঠে যাক, তাহলে তারা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি করতেই পারেন!

বাংলাদেশে ৩৪টি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৩০টিই বেসরকারি মালিকানাধীন, যার কয়েকটির মালিক বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ছাড়াও রয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ সংবাদপত্র। এরপরও অসত্য দাবি করা হচ্ছে যে, সরকার ‘নিরপেক্ষ’ সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিচ্ছে। এভাবে লিফলেট থেকে আরও অনেক অসত্য তথ্যের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সেটা কেবল লেখাকে দীর্ঘায়িত করবে।

বিদেশে বসে মানবাধিকারের মধুর বাণী উচ্চারণ খুব সহজ। কিন্তু পথে-প্রান্তরে ঘুরে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা পাহাড় সরানোর সমান। ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হওয়া আইনি-রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিপরীতে মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া কঠিন কাজ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বীর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম যে, এ দেশে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করব। আমরা সব ক্ষেত্রে সফল হতে পারিনি, কিন্তু লড়াই জারি রয়েছে। এ লড়াই একান্তই আমাদের নিজস্ব লড়াই। এক্ষেত্রে কোনো বিদেশি স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী মানবাধিকারের ছদ্মবেশে রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকান্ড আমাদের আশাহত করতে পারবে না। মানবাধিকারের পক্ষে আমাদের সংগ্রাম চলবেই!

ঘৃণা ছড়ানোর অধিকার পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই কোনো নাগরিককে দেয়নি। ঠিক একইভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলেও কোনো ব্যক্তিকে এ অধিকার দেওয়া হয়নি। কিন্তু লন্ডনে বসে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের অপব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরা এসব কর্মকান্ড সমর্থন করেন না। তা ছাড়া, অসত্য তথ্য ব্যবহার করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্যাংশনের দাবি করে প্রচারণা চালানোর আর যাই উদ্দেশ্য থাক, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যে তাদের উদ্দেশ্য নয় এ কথা বলা বাহুল্য। বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য ছড়ানো এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের পক্ষে সম্ভব নয়।

ইতিবাচক নানা সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির সময়ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। করোনা মোকাবিলায় আমরা উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভালো করেছি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত যেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে বর্তমান সরকার দারুণ সফলতা লাভ করেছে। একই সঙ্গে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার নয়।  সচেতন নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মী সবার দাবি হওয়া উচিত, স্বাস্থ্য অধিকারকে সংবিধানে বলবৎযোগ্য অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পাশাপাশি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের পরিধিও বিস্তৃত করতে হবে।  এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তবে বিরোধী দলগুলো এবং নাগরিক সমাজেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

সর্বশেষ খবর