শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

হুন্ডি নামের দানব রুখতে হবে

মোহাম্মদ সোহেল

হুন্ডি দেশের অর্থনীতির জন্য সাক্ষাৎ শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।  এর মাধ্যমে পাচার হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারসাজিতে তছনছ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড লাগিয়ে হুন্ডির ব্যবসা করছে বাংলাদেশের দুটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান। ফলে দেশে আসছে না ডলার। ডলার সংকটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা অচলাবস্থার শিকার হয়। বন্ড বিনিয়োগেও দেখা দেয় মন্দা। প্রবাসীদের বন্ড নবায়ন হচ্ছে না। অংশীজনরা বলছেন, বন্ডে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রচলিত আড়াই শতাংশের সঙ্গে আরও ১ শতাংশ প্রণোদনাসহ তিন স্তরে বিনিয়োগ সুবিধা থাকলে তবেই কমতে পারে হুন্ডি। পাশাপাশি হুন্ডিতে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দুদকের অনুসন্ধান ও বিদেশে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবকিছুর আগে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। একটি গ্রহণযোগ্য মূল্য নির্ধারিত হলেই সবকিছু স্বাভাবিক হবে। ডলার সংকট দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিচ্ছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম এক বছরে বেড়ে গেছে ২০ শতাংশের বেশি। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চিত টাকা থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। ডলার সংকট মোচনে যেসব কারণে প্রবাসীরা ব্যাংকিং খাতের বদলে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠছে সে পথ বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সক্রিয় হলে কারা হুন্ডির সঙ্গে জড়িত তা চিহ্নিত করা কঠিন কিছু নয়। কারণ কোন এলাকার কারা হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত এটি ওপেন সিক্রেট বিষয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সক্রিয় হলে তাদের জালের মধ্যে আটকানো সম্ভব হবে। সংকট নিরসনে ব্যাংকিং খাতে আসা অর্থের জন্য প্রণোদনা বাড়ানোর বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। হুন্ডি বাদ দিয়ে প্রবাসীরা যাতে বৈধ পথে দেশে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হয়, সে পথেই হাঁটছে সরকার। আশা করা হচ্ছে বাস্তবসম্মত বিভিন্ন পদক্ষেপ ডলার সংকট মোচনে আশার আলো দেখাবে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়াতে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেমিট্যান্স সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সধারী এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে দেশে রেমিট্যান্স আনতে বিদেশি অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার, ব্যাংক, ডিজিটাল ওয়ালেট, কার্ড স্কিম ও এগ্রিগেটর পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। আগ্রহী এমএফএস প্রোভাইডারদের প্রবাসী আয় প্রত্যাবাসন-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন পেতে চলতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রা প্রথমে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা হবে। আর এটি জমা হবে প্রবাসীর মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে টাকার অঙ্কে। এজন্য বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের যথাযথ ইকেওয়াইসি পরিপালন করে এমএফএসে হিসাব খুলতে হবে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারদের সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট সুবিধা দেবে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লাইসেন্সধারী এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রবাসীরা তাৎক্ষণিকভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের ধারণা হুন্ডির মাধ্যমে বছরে পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর সহজ পথ প্রবাসীদের হুন্ডিমুখী হতে নিরুৎসাহিত করবে। এর ফলে দেশে ডলারের মূল্য কমে আসবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হুন্ডি বন্ধে প্রবাসীদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর দিকে নজর রাখা খুবই প্রাসঙ্গিক। এর ফলে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো নিরুৎসাহিত করা হবে। ডলার সংকটের অবসানে হুন্ডি বন্ধে সর্বাত্মক সতর্কতার পাশাপাশি বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করাও জরুরি। বিদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয় বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। এ ব্যাপারে দেশে যে আস্থার সংকট রয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে অর্থ পাচারে ওভার ইনভয়েসিংয়ের আশ্রয় নেওয়া হয় এমন অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, কতিপয় অসৎ লোকের কর্মকাণ্ড ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সুনামেও বাদ সাধছে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের আশ্রয় নিচ্ছে ব্যবসায়ীদের একাংশ। অর্থ পাচার প্রতিরোধে নিয়োজিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনেও ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক ডলার সংকটের মধ্যে কোনো কোনো আমদানি পণ্যে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং দেখানো হয়েছে। গত অর্থবছরে বিভিন্ন রিপোর্টিং এজেন্সি ৮ হাজার ৫৭১টি সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত করেছে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬২ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। দেশে ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের বেশির ভাগেরই সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, হংকংসহ বিভিন্ন দেশে নিজস্ব অফিস রয়েছে। তারা কোনো পণ্য আমদানির সময় সরাসরি রপ্তানিকারক দেশের বদলে  নিজস্ব অফিসের মাধ্যমেই আমদানি দেখায়। তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি মূল্য দেখিয়ে ভোগ্যপণ্য দেশে আনা হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, অন্যদিকে অতিরিক্ত মূল্যে জনগণকে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এর ফলে ক্রেতাদের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে যে কোনো সরকারের কৃতিত্ব বলে ভাবা হয়। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে অসৎ ব্যবসায়ীদের একাংশ উঠেপড়ে লেগেছে। এক বছরের ব্যবধানে ৬২ শতাংশ বেশি লেনদেন প্রমাণ করছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে কারসাজি চলছে। এ ষড়যন্ত্র রুখতে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আমদানিতে বাদ সাধতে হবে।  হুন্ডি ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের রাজনৈতিক কানেকশনও খতিয়ে দেখা উচিত।

লেখক : প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর