শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সামরিক চাপে পিষ্ট পাকিস্তানের রাজনীতি

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

সামরিক চাপে পিষ্ট পাকিস্তানের রাজনীতি

পাকিস্তানের ইতিহাসকে বলা যায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও রক্তাক্ত কোন্দলের এক করুণ উপাখ্যান। ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। নিজ দেশে ফেরার আগে ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশে বিভক্ত করেছিল। স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান প্রায়ই একটি অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে, যার নেপথ্যে ছিল সামরিক বাহিনী এবং বিভক্ত ও অদক্ষ নেতৃত্ব।

১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালের মধ্যে ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  ২৬ নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে গৃহীত ভারতীয় সংবিধানের অধীনে এ নির্বাচন পরিচালিত হয়েছিল। লোকসভার ৪৮৯টি আসনের জন্য ১ হাজার ৯৪৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তখন প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১৭৩ মিলিয়নের বেশি নাগরিক ভোট দেওয়ার যোগ্য ছিল। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ৪৫-৭%। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (আইএনসি) ৪৮৯ আসনের মধ্যে ৩৬৪ এবং মোট ভোটের ৪৫% পেয়ে ব্যাপক বিজয় অর্জন করেছিল। এর বিপরীতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে পাকিস্তানে জাতীয় পর্যায়ে সরাসরি কোনো নির্বাচন হয়নি। মাঝে মাঝে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পাকিস্তান সরকারের ‘ইলেকটোরাল রিফর্মস কমিশন (১৯৫৬) রিপোর্ট’ এসব প্রাদেশিক নির্বাচনকে ‘ভোটারদের সঙ্গে প্রহসন, উপহাস এবং প্রতারণা’ হিসেবে বর্ণনা করে। স্বাধীনতার পর ১০-২০ মার্চ, ১৯৫১-এর মধ্যে প্রথম সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের জন্য। এ নির্বাচনে ১৯৭ আসনের বিপরীতে ১৮৯টি আসনের জন্য ৯৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং বাকি আটটি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ণ হয়েছিল। সাতটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়। প্রায় ১০ লাখ ভোটার নিয়ে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে লাহোরে ভোটারের উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩০% এবং পাঞ্জাবের গ্রামীণ এলাকায় তা ছিল আরও কম। ১৯৫১ সালের ৮ ডিসেম্বর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে প্রাদেশিক আইনসভার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে যারা হেরেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই বিজয়ীদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও কারচুপির অভিযোগ এনেছিলেন। একই অভিযোগ আজ সাত দশক পরও পাকিস্তানে শোনা যায়। একই ভাবে ১৯৫৩ সালের মে মাসে সিন্ধুর প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এ নির্বাচনেও কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে পূর্ব বাংলার আইনসভার জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পাকিস্তান মুসলিম লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী যুক্তফ্রন্টের কাছে হেরে যায়। ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহের নান্দাইলে একজন নবীন ছাত্রনেতা ও ভাষা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী খালেক নেওয়াজ খানের কাছে তাঁর সংসদীয় আসন হারান। যুক্তফ্রন্টের এই তরুণ তুর্কির কাছে নূরুল আমিনের লজ্জাজনক পরাজয় তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে পাকিস্তান মুসলিম লীগকে কার্যত নির্বাসিত করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশের বিদায় ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর এটি ছিল প্রথম সরাসরি সাধারণ নির্বাচন। প্রায় দুই দশকের দীর্ঘ সংগ্রামের পর সামরিক শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল এ নির্বাচন। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনটিকে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের গণভোট হিসেবে দেখা হয়েছিল। এ সময় পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫% ছিল বাঙালি। তবু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করত এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করত। ফলে নির্বাচনে ৩১৩টির মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধে সামরিক সরকার নির্বাচিত সংসদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। তবে এর আগে ১৯৫১ সাল থেকেই অসংখ্য অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল পাকিস্তানে। বস্তুত ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পাকিস্তান কয়েক দশক সামরিক শাসনের অধীনে কাটিয়েছে (১৯৫৮-১৯৭১, ১৯৭৭-১৯৮৮, ১৯৯৯-২০০৮)। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন প্রধান শহরে অবস্থিত কয়েকটি কর্পস বা কমান্ডে বিভক্ত। সেনাবাহিনীর রাওয়ালপিন্ডি কমান্ড সংবিধান লঙ্ঘন এবং দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে সমগ্র দেশে সামরিক আইন বা সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় বরাবরই জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। রাওয়ালপিন্ডি ব্রিটিশ রাজত্বের আগে একটি ছোট্ট শহর ছিল এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে পিছিয়ে ছিল। পরে সামরিক অভিজ্ঞতা ও সেনা স্থাপনাকে পুঁজি করে দেশে সামরিক শাসন জারির নেপথ্যে রাওয়ালপিন্ডিই অধিকতর জড়িত থাকার নজির পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো এবং তারও আগে ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও রাওয়ালপিন্ডি কমান্ডের যোগসূত্র ছিল। লাল মসজিদের ঘটনায় ১০০ জনের বেশি মাদরাসা ছাত্র নিহত হওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীকেও দায়ী করা হয়। ১৯৯৯-২০০৮ মেয়াদে সামরিক শাসন ছিল সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। তখন পাকিস্তান তথাকথিত জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে পশ্চিমাদের মিত্র হয়েছিল। যার ফলে নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকসহ ৮০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি নাগরিক নিহত হয়েছিল। পাকিস্তানি গবেষকরা অনেক নিবন্ধে এ সময়কার আর্থিক ক্ষতি ট্রিলিয়ন রুপি বলে অনুমান করেন। সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থা অনুসরণ করে। বাস্তবে ১৯৪৭ সাল থেকে তার প্রায় ৭৫ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রার অর্ধেকের বেশি সময়জুড়ে সামরিক বাহিনী দেশের ক্ষমতায় ছিল। পাকিস্তান তিনটি পৃথক সামরিক অভ্যুত্থানের অধীনে চারজন ভিন্ন ভিন্ন সামরিক শাসক দ্বারা শাসিত হয়েছে। এর মধ্যে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক ৪ জুলাই, ১৯৭৭-এর মধ্যরাতে ‘অপারেশন ফেয়ার প্লে’ মঞ্চস্থ করেছিলেন, যা ছিল মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান। জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৮৮ সালে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের আগ পর্যন্ত যুগপৎ সেনাপ্রধান ও সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর গোলাম ইসহাক খান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইসহাক খানের হাতে অপরিসীম ও অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ছিল এবং তিনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি সেনা সমর্থন নিয়ে ১৯৯০ সালে বেনজির ভুট্টো এবং ১৯৯৩ সালে নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন, যদিও পরবর্তীতে তিনি নিজেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, যা পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ‘ওয়াহিদ কাকার’ সূত্র হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৯ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এক সফরে শ্রীলঙ্কা যান। এ সময় শ্রীলঙ্কা সফর থেকে ফিরে আসার আগেই জেনারেল মোশাররফকে বরখাস্ত করার এবং তাঁর বিমানটিকে পাকিস্তানে অবতরণ করতে বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। এ তথ্য ফাঁস হওয়ায় জেনারেল মোশাররফ ও অনুগত সিনিয়র অফিসাররা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়া নওয়াজ শরিফ এবং তাঁর মন্ত্রীদের গ্রেফতার করেন। আরও পরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শওকত আজিজের প্রস্থান, পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহম্মদ চৌধুরীকে ৯ মার্চ, ২০০৭ তারিখে ‘অকার্যকর প্রধান বিচারপতি’ বানানো এবং এ বিষয়ে পাকিস্তানের সংবিধানের দুটি প্রধান ধারা সংশোধন জেনারেল মোশাররফের অবস্থান দুর্বল করে ফেলে। এ সময় আইনজীবীদের নেতৃত্বে দেশব্যাপী গণবিক্ষোভ ও ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়, যা আইনজীবী আন্দোলন নামে পরিচিতি পায়। অবশেষে লং মার্চের মাধ্যমে এ আন্দোলন শেষ হয়। ২০০৮ সালে অভিশংসন এড়াতে জেনারেল মোশাররফ দীর্ঘদিনের একনায়কত্ব ছেড়ে পদত্যাগ করেন এবং স্ব-আরোপিত নির্বাসনে লন্ডনে চলে যান।

পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ ৮ এপ্রিল, ২০১০ তারিখে সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধন পাস করে। এ সংশোধনের ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একতরফাভাবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা হারান। বিশ্লেষকরা সংবিধানের এ পরিবর্তনকে পাকিস্তানের জন্য আধারাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের দিকে যাত্রার একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া এ সংশোধনটিতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে খাইবার পাখতুনখোয়া রাখা হয়েছে এবং প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসন, পৃথক আইনসভা এবং আর্থিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করেছে। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এবং জেনারেল মুহম্মদ জিয়াউল হকের মতো সাবেক সামরিক শাসকদের অধীনে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে কুক্ষিগত ব্যাপক ক্ষমতার লাগাম টানা এবং পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমাতে এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়। বিলটি কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের দ্বারা পাকিস্তানের সংবিধানের অনবরত ও ইচ্ছামাফিক লঙ্ঘন বন্ধ করেছে। সংশোধন বিলটি ১৫ এপ্রিল, ২০১০ তারিখে পাকিস্তানের সিনেট দ্বারা পাস হয় এবং ১৯ এপ্রিল, ২০১০ তারিখে রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি বিলে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে এটি আইনে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন রাষ্ট্রপতি তাঁর ক্ষমতার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন এবং এ ক্ষমতা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্থানান্তর করেন। ২০১০ সালে জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার তার সংক্ষিপ্ত মেয়াদেরই সামরিক শাসনের দুষ্টচক্রকে থামানোর একটি প্রশংসনীয় প্রয়াস চালায়। অনেকে এ সংশোধনের পরও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থাগুলোয় সেনাবাহিনীর প্রভাব হ্রাস পায়নি বলে মনে করেন। সর্বশেষ সাংবিধানিক সংকটের পর ইমরান খান একটি অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন। আগস্টে তাঁকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে পুলিশ এবং বিচার বিভাগের মাধ্যমে একজন সহকারীকে আটক ও নির্যাতন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। নভেম্বরে তিনি পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে একটি রাজনৈতিক সমাবেশের সময় হত্যা-প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যান। এসব ঘটনা স্পষ্টত ইঙ্গিত দেয় যে, সাম্প্রতিক দিনগুলোয় পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব আবার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আবারও অনিশ্চয়তার মুখে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে পাকিস্তান এমন একটি দেশ যেখানে সামরিক বাহিনী একটি প্রভাবশালী সংস্থা যা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূলনীতি লঙ্ঘন করে এবং সর্বদা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে ঐতিহ্যগতভাবে লালন করে। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী দুর্নীতি দমন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে বেসামরিক সরকারকে বারবার উৎখাত করেছে। বাস্তবে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সময়ই সামরিক বাহিনী পরবর্তীতে গণতন্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া উপেক্ষা এবং সহজে ব্যারাকে ফিরে যেতে অস্বীকার করেছে। সামরিক বাহিনীর গোষ্ঠী বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাব, দুর্নীতি, নিম্ন শিক্ষার হার, নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, বিশেষ করে বিচার বিভাগ প্রতিটি সামরিক শাসনামলে বিরূপভাবে চিহ্নিত হয়েছিল। স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটনের (১৮ এপ্রিল, ১৯২৭-২৪ ডিসেম্বর, ২০০৮) উদ্ধৃতি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। স্যামুয়েল ছিলেন একজন আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং থিঙ্কট্যাঙ্ক, যিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে হার্ভার্ড সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক হিসেবে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় কাটিয়েছেন। স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতে, রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের উৎসগুলো কেবল সামরিক বাহিনীরই গভীর আগ্রহ বা অতি উৎসাহ নয়, এটি দুর্বল রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মজ্জাগত পশ্চান্মুখিতার ফলও। নিঃসন্দেহে পাকিস্তান এ ধরনের দুষ্ট রাজনৈতিক চক্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ‘সামরিক বাহিনী রাজনীতিকে বিকলাঙ্গ করে রাখে, নাকি দক্ষ রাজনৈতিক সংগঠনের অভাব রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণকে আমন্ত্রণ জানায়’- এ নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে পাকিস্তানে। তবে যে সত্যটি আজ প্রতিষ্ঠিত তা হলো, সামরিক বাহিনী সর্বদা ক্ষমতায় আসার শুরুটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য স্বল্পসময়ের প্রশাসন চালানোর আশ্বাস দিয়ে। তারপর তারা বেমালুম তা ভুলে যায় এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বেসামরিক প্রশাসনের কাছে আর ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চায় না। সামরিক সরকারগুলো বেশির ভাগই তাদের নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি, ঐক্য, শ্রেণি সুবিধা এবং জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াতে থাকে। বাস্তবে সামরিক বাহিনীকে দেশের জটিল সমস্যা মোকাবিলায় অক্ষম বলেই ভাবতে পছন্দ করে সুশীলসমাজ। কারণ তারা অস্ত্রের জোরে সব সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে।  গণতন্ত্রের আড়ালে সামরিক শাসনের সম্প্রসারণের জন্য একদল স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করলে সামরিক জান্তা আরও উৎসাহিত হয় ও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর