শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সাফল্যের অনন্য উচ্চতায় একজন এম এ হাসেম

অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু

সাফল্যের অনন্য উচ্চতায় একজন এম এ হাসেম

সময়টা ২০২০ সালের ডিসেম্বর। সারা বিশ্বে করোনা মহামারি। চারদিকে মৃত্যুর হাতছানি।  স্বজনরা লাশ পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখে না। হাসপাতালে আইসিইউ ও অক্সিজেনের হাহাকার। দুই বছরের ব্যবধানে গোটা মানব জাতির জন্য করোনা মহামারির ক্ষত কিছু শুকিয়ে এলেও আমরা কত আপনজনকে হারিয়েছি। বিষয়টি মনে হলে এখনো সবাইকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। আমাদের সময়ের একজন সফল মানুষ, একজন দেশপ্রেমিক শিল্পোদ্যোক্তা পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমকে আজ থেকে দুই বছর আগে (২৪ ডিসেম্বর, ২০২২) আমরা হারিয়েছিলাম। তাঁর মৃত্যুসংবাদ শোনার পরই স্মৃতির দমকা হাওয়ার ওপর ভর করে কিছু লিখেছিলাম, পরদিন দুটি পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সনে মুদ্রিত হওয়ার কারণেই হয়তো গত বছর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে অনেক শুভানুধ্যায়ী লিখতে বলেছিলেন। এবারও তা-ই হলো, দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু লেখার জন্য অনেকে বলেছেন। কভিড-১৯-এর ছোবলে স্বজন হারানোর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই।

করোনা চিকিৎসার সম্মুখসারির যোদ্ধাদের নিয়ে কিছু আশার আলো সঞ্চারণী কথা বলে লেখাটির শুরু করতে চাই। সাধারণ মানুষের মাঝে কাজ করার কারণেই হয়তো কিছু কিছু ভালো সংবাদও দৃষ্টিগোচর হয়। আমি নিজেও ২০২০ সালের শুরুর দিকে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যও আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই সুবাদে পরিচয় ঘটে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সায়েম ও তাঁর প্রতিষ্ঠান এ এম জেড হাসপাতালের ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে। ডা. সায়েমের অসীম সাহসী পদক্ষেপ রোগীদের মনে যেমন আস্থা আর বেঁচে ওঠার সাহস সঞ্চার করত তেমনি তাঁর স্বাস্থ্যকর্মীদের পরম মমতায় এবং সেবায় অসংখ্য করোনা রোগী সুস্থ হয়ে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে পাঠিয়েছিলাম ৮২ বছর বয়স্ক আলহাজ হাসান আলী, ৮৫ বছর বয়সের এ কে এম ফকরুল ইসলাম, ৭০ বছর বয়সের অভিনেতা বাবুল আহমেদসহ অনেক করোনা রোগীকে, যারা প্রত্যেকেই মৃত্যুর মিছিল থেকে ফিরে এসেছিলেন।

এবার আসা যাক করোনা আক্রান্ত হাসেম ভাই প্রসঙ্গে। সংবাদটি শুনে ভাবি সুলতানা হাসেমকে ফোন করি। তিনি জানালেন টাইস্যুট পরেই তো বাসা থেকে হাসপাতালে গেল। কথায় তাঁর সমগ্র অস্তিত্বজুড়ে দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের ছাপ। ফোন করি তাঁদের জ্যেষ্ঠপুত্র আজিজ আল কায়সার টিটুকে, বর্তমানে পারটেক্স গ্রুপ ও দি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান। তিনি জানান, সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন, পিতার অসুস্থতার সংবাদে সফর সংক্ষিপ্ত করে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছেন। কথা হয় দ্বিতীয় সন্তান আজিজ আল মাহমুদ মিঠুর সঙ্গে, যিনি বর্তমানে পারটেক্স স্টার গ্রুপের এমডি। তিনি জানান, দুবাই থেকে ঢাকার পথে। ঘরবন্দি জীবন, যেন কাঁধের ওপর যমের নিঃশ্বাস। কিন্তু আমার পরিবার তখন করোনা নিয়ে এতটা ভয় পায় না। প্রতিদিন হাসেম ভাইয়ের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর রাখছিলাম। সুলতানা হাসেম ভাবি কয়েকদিন পর জানালেন, অবস্থা খারাপের দিকে। আমি ডাক্তার সায়েমকে বিষয়টা জানিয়ে তাঁর পরামর্শ চাই। ডাক্তার সায়েম তাঁর হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগীদের সামলে যেতে রাজি হন। হাসেম ভাইকে দেখতে তাঁর হাসপাতালে যখন আমরা পৌঁছি তখন রাত ১টা। পরিচয় দিলাম, সিকিউরিটি ঢুকতে দেবে না। কী আর করা! মেজো ছেলে মিঠুকে ফোন দিলাম, আমাদের দেখার ব্যবস্থা করলেন। করোনা রোগের অন্যতম সফল চিকিৎসক সায়েম কিছু ব্যবস্থার কথা বললেন। হাসেম ভাইয়ের হাসপাতালের ডাক্তারদের পরিষ্কার কথা, তাঁরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন ও প্রটোকলের বাইরে কোনো চিকিৎসা দেবেন না। অথচ শেষের দিকে এসব বিশেষায়িত হাসপাতাল কভিড ব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশি পদ্ধতি মেনে চিকিৎসা দিয়েছে। এখানে আফসোস বা আক্ষেপ যা-ই বলি না কেন আমার বিশ্বাস সেদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন ও প্রটোকল নিয়ে বাড়াবাড়ি না করলে হয়তো হাসেম ভাইকে আমাদের এত তাড়াতাড়ি হারাতে হতো না। করোনা মহামারির জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্ভাবিত স্থানীয় পদ্ধতির সাফল্যকে গুরুত্ব দিলে হয়তো ক্ষয়ক্ষতি আরও কম হতো।

এম এ হাসেমের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে আমি তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলব, তিনি ২০০১ সালে এমপি হলেও আপাদমস্তক ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মেধা, সততা, পরিশ্রম, সাহসিকতার সঙ্গে পথচলায় ছিলেন নির্ভীক। আমাদের জাতীয় সংসদে তাঁর দেওয়া একটি অবিস্মরণীয় বক্তৃতা আছে। সরকারি দলের এমপি হয়েও তিনি অকপটে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, যোগাযোগব্যবস্থা ও যানজটের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। শুধু সমালোচনাই নয়, তিনি ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে তাঁর যুগান্তকারী পরামর্শও দেন। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি নির্দ্বিধায় কালোকে কালো, সাদাকে সাদা বলতে সক্ষম ছিলেন।

তিনি বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হওয়ার পরও বিশ্বাস করতেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা হচ্ছেন জনগণের আমানতের পাহারাদার মাত্র। তাই যে-কোনো রুগ্ন প্রতিষ্ঠানও তাঁর হাতের ছোঁয়ায় দাঁড়িয়ে যেত। অনন্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইউসিবিএল (ব্যাংক)।

শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়নই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তিনি টাকা পাচারকারীদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। ব্যাংকের ঋণখেলাপি হওয়াটাকেও অপছন্দ করতেন। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র নিয়ে ছিল তাঁর অজস্র স্বপ্ন। কিন্তু দেশকে বিরাজনীতিকীকরণের ষড়যন্ত্রের ফসল ১/১১-এর লুটেরা সরকার এম এ হাসেমকেও রেহাই দেয়নি। আমরা একসঙ্গে কারাগারে ছিলাম। কারাগারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক দিনগুলোও এম এ হাসেমকে দিগ্ভ্রান্ত করতে পারেনি। কাশিমপুর-২ কারাগারের অনেক স্মৃতি আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। অনেক বড় বড় জাতীয় নেতা একই কারাগারে থাকলেও সে সময় হাসেম ভাইয়ের কাছে ভিড় লেগে থাকত। কষ্টের মধ্যেও হাসেম ভাইয়ের অনুপ্রেরণাদায়ক জীবনের গল্প সবার মধ্যে আশার সঞ্চার করত। তাঁর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, তাঁর বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সামান্য সঞ্চয় নির্ভর করে ছোট থেকে বড়, বড় থেকে ব্যবসায়ের মহিরুহে রূপান্তরের গল্প, একজন আবুল হাসেম সাফল্যের অনন্য উচ্চতায় পৌঁছানোর গল্প- এ যেন ছিল যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার চেয়েও রোমাঞ্চকর। তিনি বলতেন, সততা, একনিষ্ঠতা, মেধা দিয়ে জীবনে যে-কোনো সাফল্য অর্জন করা যায়। বলতেন, দেশের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার মূলে হলো সততা ও নিষ্ঠার অভাব। বিপদে ধৈর্য না হারিয়ে পাহাড়ের মতো তিনি ছিলেন অটল, অবিচল। আজ হয়তো অনুভব করছি কারাজীবনে হতাশা থেকে মুক্ত থাকতে হাসেম ভাই কতটা সঞ্জীবনী শক্তির মতো অপরিহার্য ছিলেন।

১/১১-পরবর্তী প্রায় ১২ বছর হাসেম ভাইয়ের স্নেহ-মমতা থেকে কখনই বঞ্চিত ছিলাম না। হঠাৎ দুপুরে ফোন আসত খেয়েছি কি না, বলতেন চলে আসো, একসঙ্গে খাব। গিয়ে দেখতাম টেবিলে আরও ১০-১২ জন। নিজে খেতেন একেবারেই বাঙালি খাবার কিন্তু অন্যদের জন্য থাকত অনেক রকমের খাবার। হাসেম ভাই খুব ভালো রান্না করতে জানতেন। বিদেশে গেলে নিজ হাতে রান্না করতেন, বাইরের খাবার খুব একটা পছন্দ ছিল না। হাসেম ভাইয়ের মতো খাওয়াতে এত ভালোবাসেন আমার জীবনে এ রকম দ্বিতীয়জনকে দেখিনি।

হাসেম ভাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির সংখ্যা ৭৭টির বেশি। ৭৫ হাজার জনের বেশি কর্মচারী-কর্মকর্তা পারটেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর সঙ্গে গল্পের সময় দেখেছি কত কর্মকর্তা-কর্মচারী মারাত্মক ভুল করে ক্ষমা চেয়েছেন, তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমি যখনই যে-কোনো বিষয়ে তাঁর কাছে গিয়েছি কোনো দিন বিরক্ত হতে দেখিনি, কোনো দিন ফিরিয়ে দেননি। বস্তুত তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারলে কাউকে তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। এমন বিশাল হৃদয়ের মানুষ আজকের যুগে খুঁজে পাওয়া ভার। এক সফল জীবনের অধিকারী একজন এম এ হাসেম এবং বেগম সুলতানা হাসেম দম্পতির পাঁচ পুত্রসন্তান। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে বিশাল শিল্পসাম্রাজ্যের নেতৃত্ব ও দায়িত্ব নেওয়ার মতো করে সন্তানদের গড়ে তুলেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই যেমন উচ্চশিক্ষিত, তেমনি পিতার মতো অসামান্য মেধা, সততা ও প্রতিভা। মরহুম এম এ হাসেমের দ্বিতীয় প্রজন্মের সঙ্গে ইতোমধ্যে তৃতীয় প্রজন্মও শিল্পবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আমাদের প্রত্যাশা, তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে সবাই এম এ হাসেমের দেখানো পথ ও ঐতিহ্য ধারণপূর্বক প্রাগ্রসর চিন্তার মাধ্যমে নেতৃত্ব প্রদান করে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক শিল্পপতির স্বপ্ন সার্থক করবেন। যিনি ‘সাফল্যের অনন্য উচ্চতায়’ আরোহণের এক কিংবদন্তিসম ইতিহাস রচনা করে গেছেন।  এম এ হাসেমের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখক : সাবেক উপমন্ত্রী ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটি

সর্বশেষ খবর