শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

এক মানবতার ফেরিওয়ালার গল্প

ড. সঞ্চিতা গুহ

নির্মল রঞ্জন গুহ। বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদ্যপ্রয়াত সংগ্রামী সভাপতি। কর্মগুণে যিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে। ১৯৬৭ সালের ২১ জানুয়ারি ঢাকা জেলার অন্তর্গত দোহার উপজেলার পানকুণ্ডু গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন সবার প্রিয় নির্মল রঞ্জন গুহ। তাঁর পিতার নাম নিখিল রঞ্জন গুহ এবং মাতার নাম অনুভা গুহ। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। যে গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন সেটির অবস্থান সুবিশাল পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে। পদ্মার উন্মত্ত রূপের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই কেটেছে তাঁর দুরন্ত শৈশব ও কৈশোর। বারবার এই পদ্মাই কেড়ে নিয়েছে তাঁর জমিদার পূর্ব-পুরুষের বসতভিটা, তবুও হাল ছাড়েননি তিনি। পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবারই তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন নব দৃঢ়তায়। চাইলেই তখন তিনি সপরিবারে সরে যেতে পারতেন অন্যত্র অথবা ঢাকা শহরে। কিন্তু পদ্মাপুত্র কি পারেন পদ্মার মায়া ত্যাগ করতে! পারলেন না তিনি এই বন্ধন ছিন্ন করতে। হয়তো পদ্মার ধ্বংসাত্মক রূপের চেয়ে পদ্মার বিশালতার রূপটিই তাঁকে অধিক আকর্ষণ করত! পদ্মার ন্যায় বিশাল ছিল তাঁর হৃদয়, পদ্মার মতোই গভীর ছিল তাঁর অনুভব, পদ্মার ক্ষিপ্রতা তাঁকে সাহসী করেছিল সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রতিটি মিছিলে। তাই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সব প্রান্তিক জনপদে স্বেচ্ছাসেবার আলো জ্বালিয়ে বারবার তিনি ফিরে এসেছেন এই পদ্মাপাড়ে, যে মাটিতে তাঁর নাড়ি পোঁতা। নির্মল রঞ্জন গুহের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয় নিজ পরিবারেই। পূর্বপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে তিনি বিমোহিত হয়ে ভাসতে শুরু করেন স্বপ্নের নৌকায়। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এবং নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কাউন্সিলে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ অনুসরণকারী এক প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, যাঁকে তিনি সম্বোধন করতেন, ‘ধন্য পিতার ধন্য কন্যা’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ভ্যানগার্ড। প্রাণপ্রিয় নেত্রীর প্রশ্নে তিনি ছিলেন সতত আপসহীন। রাজনীতির মাঠে আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সব সময় পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। নেত্রীর প্রতি অবিচল নিষ্ঠা এবং দলের প্রতি গভীর আনুগত্যই ছিল তাঁর আন্দোলন-সংগ্রামের হাতিয়ার। বিরোধী দলে থেকে ছাত্ররাজনীতি করার সময়ে জগন্নাথ হলে থেকে অন্যান্য নেতা-কর্মীর সঙ্গে মিলে নিয়ন্ত্রণ করেছেন ছাত্রলীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম, খেটেছেন জেল, সহ্য করেছেন অপরিসীম জুলুম। কিন্তু ভেঙে পড়েননি, হাল ছাড়েননি। অদম্য সাহসে এগিয়ে গেছেন। ২০০৩-০৪ সালেও করেছেন কারাবরণ। ১/১১ এর কঠিন সময়েও বঙ্গবন্ধুকন্যার মুক্তির জন্য তিনি পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। নেত্রীর মুক্তির প্রথম পোস্টারটিও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিপ্লবী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ভাইয়ের নির্দেশে নির্মল রঞ্জন গুহ প্রকাশ করেন। নেত্রীর প্রতি তাঁর এই অবিচল নিষ্ঠা, সততা বৃথা যায়নি। মূল্যায়ন করেছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী তাঁকে, নির্বাচিত করেছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হিসেবে।

সংগঠনকে শক্তিশালী করতে চষে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা দলকে সুসংগঠিত করেছে। আর সেই সুসংগঠিত দলকে নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশের উন্নয়নে। ২০২০ সালের মার্চে ভয়াল কভিড-১৯ এর থাবায় যখন জনজীবন লণ্ডভণ্ড, ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তিনি আর্ত-মানবতার সেবায়। তিনি বলতেন, ‘সবাই ভয়ে ঘরে বসে থাকলে সাধারণ মানুষের মুখে খাবার তুলে দেবে কে?’। তিনি নিজের জীবনের পরোয়া করেননি, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। আশ্বস্ত করেছেন সবাইকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আছেন আপনাদের সঙ্গে, আপনাদের পাশে। তিনি নিজেও হয়েছেন করোনা আক্রান্ত, সুস্থ হয়েই ফিরে গেছেন আবার ত্রাণ কার্যক্রমে। দেশের যে প্রান্তেই দুর্ঘটনা ঘটেছে, ছুটে গেছেন তিনি মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে।

কিন্তু বিধিবাম! নিয়তির অমোঘ নিয়মের কাছে পরাজিত হলেন পদ্মাপাড়ের এই আজন্ম যোদ্ধা! ২৫ জুন যখন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছিল, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন মানবতার ফেরিওয়ালা। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে শোনাচ্ছিল উদ্বোধনের গল্প। ২৯ জুন ২০২২ বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টা ৫ মিনিটে মানবতার স্বপ্ন হৃদয়ে ধারণ করে পারি জমালেন তিনি অনন্তলোকে।

৩০ জুন ২০২২ বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে সন্ধ্যা ৬টায় মানবতার ফেরিওয়ালা নিথর দেহে অবতরণ করেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। পরদিন সকালে টিএসসি ও ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয় হয়ে লাখো মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর ভালোবাসায় মোড়ানো আজন্ম সখ্যতার দোহারের সেই পদ্মাতীরে এবং যথাযোগ্য বিধি অনুযায়ী সেখানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এক দিন যে নামটিতে ছিল শুধু উচ্ছ্বাস আর আনন্দের ছোঁয়া, আজ সেই নামটিই হয়ে গেছে ব্যথা আর কষ্টের আধার! মানবতার ফেরিওয়ালা নির্মল রঞ্জন গুহ থাকবেন অগণিত মানুষের অন্তরে ধ্রুবশিখা হয়ে। আমাদের বকুলের মালা শুকিয়ে গেছে, তবুও ছড়িয়ে যাচ্ছে সুরভি। এই সুরভিই হোক আমাদের পাথেয়। হে মানবতার ফেরিওয়ালা, হে পদ্মাপুত্র! এ তোমার মৃত্যু নয়, দেহত্যাগ মাত্র! তোমার আদর্শ, তোমার মানবতা চির জাগরূক থাকবে আমাদের অন্তরে, আমাদের মননে!

বরি তোমায়, স্মরি তোমায় শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়...

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর