শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ছাত্রলীগ পরিচয় কি অযোগ্যতা

সৈয়দ বোরহান কবীর

ছাত্রলীগ পরিচয় কি অযোগ্যতা

কবির বিন আনোয়ার মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়ার খবরে আমি উল্লসিত হয়েছিলাম। ’৭৫-এর পর এই প্রথম সরাসরি ছাত্রলীগ রাজনীতি করা কোনো কর্মকর্তা সর্বোচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্ব পেলেন। ১১ ডিসেম্বর অপু ভাইয়ের (কবির বিন আনোয়ারের ডাকনাম) নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এ সময় আমি বিদেশ সফরের প্রস্তুতি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ভাবলাম দেশে ফিরে অপু ভাইয়ের অফিসে যাব। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের রুমে তার সঙ্গে আড্ডা দেব। কিন্তু দেশে ফিরতে ফিরতেই দেখলাম নতুন প্রজ্ঞাপন। কবির বিন আনোয়ারকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। গত ৩ জানুয়ারি তার বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হয়। বিগত মন্ত্রিপরিষদ সচিব দুই দফা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলেও কবির বিন আনোয়ারের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। মাত্র ১৯ দিনের জন্য তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এটি সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে দায়িত্ব পালনের নতুন রেকর্ড। এর আগে সবচেয়ে কম সময় ক্যাবিনেট সচিবের দায়িত্ব পালনের রেকর্ড ছিল চৈনিক বাম ড. কামাল সিদ্দিকীর। তিনি এক মাস চার দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কবির বিন আনোয়ারের আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি তার চাকরি জীবনের শেষপ্রান্তে এই দায়িত্ব পান। এরপর দুবার তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পুরস্কার পেয়েছিলেন। কবির বিন আনোয়ারকে যখন এই দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, তিনিও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাবেন। অন্তত আগামী নির্বাচনে তিনিই প্রশাসনের প্রধান কর্মকর্তা থাকবেন। কিন্তু আচমকাই তিনিই বিদায় নিলেন। কবির বিন আনোয়ার আওয়ামী পরিবারের সদস্য। সিরাজগঞ্জের রাজনীতির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সেখান থেকে ভবিষ্যতে নির্বাচন করবেন, এমন ইচ্ছার কথা তিনি প্রায়ই বলেন। কিন্তু এখন গণপ্রতিনিধি আদেশের যে বিধান, তাতে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। এক-এগারোর সময় ওই বিধান সংশোধন করা হয়। নতুন বিধান অনুযায়ী, অবসরে যাওয়ার দুই বছর অতিবাহিত না হলে কোনো সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। অনেক সরকারি কর্মকর্তাই এখন এই বিধানকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন। অপু ভাই তার প্রিয় দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন কি না ভিন্ন প্রশ্ন। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি না সেটি আইনগত বিষয়। অবশ্য তাকে অবসর দেওয়ার পর পরই নতুন দায়িত্ব দেওয়ার গুঞ্জন শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার কবির বিন আনোয়ার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে ফুলেল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের কক্ষে তার চেয়ারে তিনি বসেছিলেন। আওয়ামী লীগের মধ্যে গুঞ্জন আছে, এইচ টি ইমামের শূন্যপদের দায়িত্ব কবির বিন আনোয়ারকে দেওয়া হতে পারে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হতে পারেন এমন কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কবির বিন আনোয়ার কি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারতেন না? তাকে কি ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ হিসেবেই ক্যাবিনেট সচিব করা হয়েছিল? এমন নয় যে, সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় না। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এখন ডাল-ভাতের মতো। আবার অনেক সরকারি কর্মকর্তা অবসরের পর নানা কমিশনে নানা পদে চাকরি জুটিয়ে ফেলেন। অনেকটা পুনর্জন্মের মতো। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিবের কথাই ধরা যাক। মুখ্য সচিবের দায়িত্ব যখন শেষ তখন তিনি দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলেন। দুই বছরের চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই তিনি পেলেন বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব। সেটিও তিন বছরের জন্য। মুখ্য সচিবের পদমর্যাদায়। এমন সৌভাগ্যবান সরকারি কর্মকর্তা কজন আছেন? নিশ্চয়ই তিনি অসাধারণ মেধাবী। তিনি অবসরে গেলে এই রাষ্ট্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব নন, বহু সরকারি কর্মকর্তা যাদের অতীত জীবন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন, তারাও প্রশাসনে নিজেদের অপরিহার্য প্রমাণ করে চুক্তিতে ঝুলে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং পাচ্ছেন। তাহলে কবির বিন আনোয়ারের অযোগ্যতা কোথায়? তিনি ছাত্রলীগ করতেন, এটাই কি তার অযোগ্যতা? শুধু কবির বিন আনোয়ার নন, শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, এমন সরকারি কর্মকর্তাকে কেন যেন অযোগ্য মনে করা হয়। ধরেই নেওয়া হয়, তারা কম মেধাবী। আবদুল মালেক ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাকে বদলি করা হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার বিভাগে। কিন্তু সেখানে টিকতে পারেননি তিনি। পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ে তার চাকরিজীবন শেষ করেন। নুরুল ইসলাম তো ধর্ম সচিব থেকেই চাকরি শেষ করলেন। মেসবাহ উদ্দিন যুব ও ক্রীড়া সচিব হয়েছিলেন, এটাই যেন বিরাট অপরাধ। তার সচিব হওয়ার পর অনেক আমলা নাক সিটকে বলেছিলেন, ‘সচিব পদের আর মর্যাদা থাকল না।’ প্রশাসনে ছাত্রলীগ থেকে উঠে আসা কর্মকর্তারা কোণঠাসা কেন? তাও আবার আওয়ামী লীগ যখন টানা ১৪ বছর ক্ষমতায়। শুধু ছাত্রলীগ থেকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন, দুঃসময়ে কষ্ট করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য নিজের চাকরি ঝুঁকিতে ফেলেছেন-এমন কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের সুসময়ে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যান। এ তালিকা এত দীর্ঘ যে, এই লেখার জন্য সম্পাদক আমাকে যে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছেন তাতে সব নাম লেখা যাবে না। আমি দু-একটি উদাহরণ দিতে চাই। ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। আমার দেখা সিভিল প্রশাসনে অন্যতম সৎ, মেধাবী, পরিচ্ছন্ন এবং যোগ্য কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগের সব কঠিন সময়ে তিনি পাশে থেকেছেন। আবার সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি কোণঠাসা হয়েই বিদায় নিলেন। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়নি। অবসরের পর তিনি ‘আকর্ষণীয়’ কোনো চেয়ারও পাননি। এরকম বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। প্রশ্ন হলো কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগের পাশে থাকা কি অযোগ্যতা? সরকারি চাকরিতেই শুধু নয়, সর্বত্র ছাত্রলীগের প্রতি এক ধরনের উপেক্ষা এবং নাক সিটকানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কবির বিন আনোয়ার ভাগ্যিস বিসিএস দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হয়েছিলেন। সে কারণেই হয়তো তিনি ‘আমলা কোটায়’ আওয়ামী লীগের পদ-পদবি পেতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি রাজনীতিতে থাকতেন তাহলে তার কপালে কী জুটত, তা ভেবে দেখার বিষয় বটে। জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন ‘ছাত্রলীগ’। এই সংগঠনটি আওয়ামী লীগের ‘লাইফলাইন’ হিসেবে বিবেচিত হয়। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য সরকারি চাকরি নেননি। ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন করেননি। রাজনীতিতে কি তাদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে? ১৯৮১-৮৩ সালে ছাত্রলীগ কমিটির সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন অনেক কসরত করে এবার প্রেসিডিয়ামে জায়গা পেয়েছেন। পরের কমিটির (১৯৮৩-৮৫) আবদুল মান্নান অনাদরে-অবহেলায় চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। ওই কমিটির জাহাঙ্গীর কবির নানক বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। স্রোতের বিপরীতে লড়াই করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে কোনোমতে টিকে আছেন। আবদুর রহমান প্রেসিডিয়াম সদস্য বটে; কিন্তু গত নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত। ১৯৮৮-৯২ সালের ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক তাও এমপি। এর পরের অবস্থা কী? ১৯৯২ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন মঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী। শিক্ষিত, মেধাবী। তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর বেশ আলোচিত হয়েছিলেন। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাও তাহলে ছাত্রলীগ করে। তিনি এখন কোথায়? রাজনীতিতে মূলধারায় তিনি কি অযোগ্য? ’৯৪-৯৮ সালে ছাত্রলীগ সভাপতি হন এনামুল হক শামীম। সেই কঠিন সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন শামীম। চমৎকার সংগঠক। কর্মিবান্ধব। উপমন্ত্রী করে যেন তাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাই যেন তার জন্য যথেষ্ট। কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেই, এমপিও নন ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না। বাহাদুর ব্যাপারী, অজয় কর খোকন কোথায়? আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়ার কি কোনো যোগ্যতাই এদের নেই। এভাবে আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখার প্রত্যাশায় যারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, তারা এখন হতাশায় ডুকরে কাঁদেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রাজনীতি থেকে সযত্নে দূরে থেকে যারা নিজেদের ক্যারিয়ার গড়েছেন। মাখন-রুটি খেয়ে বড় হয়েছেন। ছাত্ররাজনীতির চেয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকছেন। তারা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগে এবং রাজনীতিতে। রাজনীতিতেও এখন ‘ছাত্রলীগ’ যেন এক অপরাধ। অযোগ্যতা।

’৭৫-পরবর্তী ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে এক সর্বব্যাপী প্রচারণা শুরু হয়। ছাত্ররাজনীতি দূষিত। ছাত্ররাজনীতি নষ্ট। পচা-দুর্গন্ধময় এমন একটি নীরব বার্তা শিক্ষার্থীদের কানে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। এটি এখনো চলমান। আগে তাও ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা বাম ছাত্র সংগঠন যারা করে, তাদের মেধাবী বলা হতো। এখন সেই রেওয়াজও উঠে গেছে। তুমি ভালো ছাত্র। বেশ, ছাত্ররাজনীতি থেকে নক্ষত্র দূরত্বে থাক। ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর। এমন একটি বার্তা সারাক্ষণ শিক্ষাঙ্গনে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছাত্ররাজনীতিতে যে পঙ্কিলতা, সুবিধাবাদ আর আখের গোছানোর প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়েনি, তা নয়। ছাত্ররাজনীতিকে কুৎসিত করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর। জিয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের ‘হিজবুল বাহার’ প্রমোদতরীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অস্ত্র। বিএনপিকে এবং তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলকে শিক্ষাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করতে অস্ত্র, টাকা আর পেশিশক্তির আমদানি ঘটিয়েছিলেন ছাত্ররাজনীতিতে। জিয়া যে কৌশলে শিক্ষাঙ্গন দখলে রাখতে চেয়েছিলেন, ঠিক একই কৌশলের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন আরেক সামরিক একনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ছাত্রদল আর নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ একই প্রক্রিয়ায় গঠিত। একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই সৃষ্টি। ’৭৫-পরবর্তী ছাত্ররাজনীতিতে যে দূষিত রক্তপ্রবাহ শুরু হয়, তা ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের মধ্যেও সঞ্চালিত হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, ছাত্ররাজনীতিকে ধ্বংস করার এক পরিকল্পিত নীলনকশার বাস্তবায়ন চলছে এখনো। এখন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি টিকে আছে কেবল জাতির পিতার আদর্শে গড়া ছাত্রলীগের জন্যই। নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি সমালোচনার পর ছাত্রলীগই এখনো ছাত্ররাজনীতির বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। তাই ছাত্রলীগকে যদি ধ্বংস করা যায় কিংবা এরকম একটি পরিস্থিতি যদি তৈরি করা যায়, ক্ষমতাসীন দলই ‘ছাত্রলীগ’কে উটকো ঝামেলা বা আপদ মনে করবে। ছাত্রলীগকে বিলুপ্ত করবে। তাহলে ষড়যন্ত্রের ষোলকলা পূর্ণ হয়। তাহলেই ‘ছাত্ররাজনীতি মুক্ত’ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে। আর এটি করা গেলেই বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার লক্ষ্য দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে। ইতোমধ্যে ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এই পথটা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারলেই সুশীল রাজত্ব কায়েমের পথ পরিষ্কার হবে। এবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও সুশীলদের উজ্জ্বল উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। শেখ হাসিনা-বিহীন আওয়ামী লীগ যে সুশীলদের দখলে চলে যাবে তার এক বার্তাও পাওয়া গেছে। ছাত্ররাজনীতিকে পুরোপুরি বস্তাবন্দি করতে না পারলে বিরাজনীতিকরণ ফর্মুলা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর ‘ছাত্রলীগ’কে নষ্ট না করতে পারলে ছাত্ররাজনীতিকে পুরোপুরি বাতিল করা অসম্ভব। তাই এখন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী প্রচারণা ও তৎপরতা চলছে। ছাত্রলীগ মানেই চাঁদাবাজ। ছাত্রলীগ মানেই ধর্ষক। ছাত্রলীগ মানেই অশিক্ষিত। এমন একটি প্রচারণা ’৭৫-পরবর্তী সময় থেকেই চলে আসছিল। এখন এই প্রচারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগে নাম লিখিয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। এখন ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। গণমাধ্যমে তাকে ছাত্রলীগ নেতা বানিয়ে লেখা হচ্ছে ‘ছাত্রলীগ নেতার ধর্ষণ’। ছাত্রলীগে ঢুকে কেউ টেন্ডারবাজি করছে। তাকে ছাত্রলীগের নেতা বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ভালো কাজগুলোকে আড়াল করা হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, ছাত্রলীগ দূষিত হয়নি। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগে ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পরিকল্পিতভাবে ছাত্রলীগে জামায়াত-বিএনপি ঢুকে নানা অপকর্ম করছে।’ আর এই অপকর্মগুলোকেই এখন সাইনবোর্ড হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। ছাত্রলীগ পরিচয়কে অযোগ্যতা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে সর্বত্র। ছাত্রলীগের কোনো ছেলেমেয়ে যদি মেধার জোরে সরকারি চাকরি পায়, তাহলে বলা হয় তদবিরে চাকরি পেয়েছে। প্রশাসন ছাত্রলীগে ভরে গেছে। ছাত্রলীগ সরকারি চাকরি কেন করবে? ছাত্রলীগের কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পান, তাহলে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে। ছাত্রলীগও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়-এমন আর্তনাদ শোনা যায়। ছাত্রলীগের রাজনীতি শেষ করে কেউ যদি ব্যবসা করে, তাহলে তো রীতিমতো ভূমিকম্প হয়। টেন্ডার বাণিজ্য করে ছাত্রলীগ লুটপাট করছে। আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতিতে ছাত্রলীগ ঠাঁই পেলেও সমালোচনা হয়। রাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার এমন চিন্তিত মন্তব্য করেন সুশীলরা। তাহলে ছাত্রলীগ করা একটি ছেলে বা মেয়ে কী করবে? কোথায় যাবে? এটি অবশ্য দীর্ঘদিনের প্রবণতা। ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী যত বড় চক্ষু বিশেষজ্ঞ হন না কেন, তিনি পণ্ডিত নন। কেন? তিনি তো ছাত্রলীগ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন সভাপতি ছিলেন। এ জন্য সারা জীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদক পাওয়ার যোগ্য নন। জাহাঙ্গীর কবির নানক যত ত্যাগ স্বীকার করুন না কেন, প্রতিমন্ত্রী হওয়াটাই তার বিরাট অর্জন। লেখাপড়া নেই। আর কত? ড. মিজান যত ভালো শিক্ষক হোন না কেন, তাকে শিক্ষকের মতো লাগে না। কেন? তিনি ছাত্রলীগ করেছেন। সুভাষ সিংহ রায় কোনো দিনই বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন না। কারণ ছাত্রলীগ। ফার্মাসিস্টরা তাকে বলে সাংবাদিক। আর সাংবাদিকরা বলে বহিরাগত। সদ্য ছাত্রলীগ সভাপতি হয়েছেন আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্র সাদ্দাম হোসেন। এই তরুণ যে উদ্দীপ্ত বক্তৃতা দেয়, তা যদি কোনো বাম-ঘরানার ছাত্রনেতা দিত, তাহলে দেশে হইচই পড়ে যেত। বলা হতো, মাহমুদুর রহমান মান্নার পর আরেকজন তুখোড় ছাত্রনেতার আবির্ভাব ঘটেছে ছাত্ররাজনীতিতে। সাদ্দাম ছাত্রলীগের নেতা। তার ওপর বাড়ি উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত জেলায়। কাজেই তার বক্তব্য জ্ঞানশূন্য। গভীরতাহীন। ছাত্রলীগ করা শাবান মাহমুদ যখন দিল্লিতে প্রেস মিনিস্টার হিসেবে সফল হন, তখন ভ্রু কুঁচকে কেউ বলে, ‘ও বিদেশে মিশনে চাকরি পায় কীভাবে। ও কি ইংরেজি জানে।’ ছাত্রলীগ করাটা কি এখন তাহলে অপরাধ হয়ে গেল? আওয়ামী লীগ নেতারাও ইদানীং ছাত্রলীগকে ইচ্ছামতো গালমন্দ করে মজা পান। আড়ালে-আবডালে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মন্ত্রী হতাশার সুরে বলেন, ‘ছাত্রলীগ আমাদের সব ধ্বংস করে দিল’। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, কিছু ছাত্রলীগ দুর্নীতি করে, ঠিকাদারিতে মাস্তানি করে। তাদের সব অন্যায় এক পাল্লায় দিলেও একজন মন্ত্রীর দুর্নীতির তুলনায় তুচ্ছ। একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া কেউই ছাত্রলীগের পক্ষে না। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউই ছাত্রলীগ থাকুক চায় না। ‘ছাত্রলীগ’কে আঁস্তাকুড়ে পাঠাতে যেন এক জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই জাতীয় ঐকমত্য আসলে বিরাজনীতিকরণের এক প্রকল্প। ছাত্রলীগ না থাকলে রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্বের রক্তপ্রবাহ বন্ধ হবে। তাহলেই রাজনীতিমুক্ত বাংলাদেশ তৈরি করা সম্ভব হবে। যে কারণেই ছাত্রলীগ এখন সবার টার্গেট। এ কারণেই ছাত্রলীগ পরিচয় এখন অযোগ্যতা।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

[email protected]

সর্বশেষ খবর