শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্ব ইজতেমা : বিশ্বমঞ্চে অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ

আবদুল্লাহ আল মামুন আশরাফী

বিশ্ব ইজতেমা : বিশ্বমঞ্চে অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ

শুরু হলো প্রাণের ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমা। করোনা ভাইরাসজনিত অস্থিরতা শেষে দুই বছর পর আবার বসল ইমানের মেলা। কহর দরিয়াখ্যাত টঙ্গীর তুরাগ তীরে লাখ লাখ ইমানদার মুসলমানের গণজমায়েতে চারদিকে উৎসবের আমেজ। দলে দলে পঙ্গপালের মতো ছুটছে সবাই টঙ্গীর দিকে। নির্ধারিত সময়ের আগেই কানায় কানায় ভরে গেছে মাঠ। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তাবলিগ জামাতের অন্যতম একটি কর্মসূচি হলো ইজতেমা। তাবলিগ শব্দটি আরবি। এর অর্থ প্রচার করা, পৌঁছে দেওয়া। আর তাবলিগ জামাত মানে প্রচার দল, প্রচার সংঘ। আর ইজতেমাও আরবি শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে- একত্রিত হওয়া। বস্তুত মহান আল্লাহ বিশ্বমানবতার কল্যাণে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে যে ধর্ম প্রবর্তন করেছেন, এর প্রচার-প্রসারের নাম হচ্ছে তাবলিগ। যে কোনো ধর্ম ও আদর্শকে বেঁচে থাকতে হলে প্রচার ও দাওয়াতের বিকল্প নেই। ইসলাম তার ঊষালগ্নেই পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছে- আকাশের উদারতা সমুদ্রের গভীরতা আর জীবন্ত নদীর বহতা নিয়েই এসেছি আমি। আল কোরআনে মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘হে রসুল! আপনার প্রতিপালকের কাছ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা আপনি তাবলিগ করুন, পৌঁছে দিন। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর বার্তা পৌঁছালেন না।’ (সুরা আল মায়িদাহ, আয়াত ৬৭) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ প্রদান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০)

কোরআন-সুন্নাহর আলোকে তাবলিগ বা ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার করা একটি ফরজ কাজ। যুগ-যুগান্তরে মুসলিম উম্মাহ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে এই মহান দায়িত্ব পালন করে আসছে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ভারতের উত্তরপ্রদেশে এক বিশেষ পদ্ধতিতে দাওয়াতি কার্যক্রম ও ইসলামের প্রচার-প্রসার প্রবর্তন করেন। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এ পদ্ধতি ব্যাপক সাড়া জাগায়। সর্বস্তরে তা সমাদৃত হয়। পর্যায়ক্রমে এ পদ্ধতিতে ইসলামের প্রচার-প্রসার ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। বিশ্ববাসীর কাছে এ মিশন ‘তাবলিগ জামাত’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ জামাত প্রসঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় প্রখ্যাত গবেষক সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) লেখেন, যেখানে মসজিদ দেখা যেত না, তাবলিগ জামাতের মেহনতের ফলে সেখানে মসজিদ তৈরি হয়, মুসল্লির আগমন ঘটে।

মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। সমাজের চিহ্নিত অপরাধীরা খোদাভীরু হতে থাকে। এ জামাত পুরো বিশ্বে এমন এক বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করে, যার উদাহরণ ইসলামের স্বর্ণযুগের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাবলিগ জামাতের বিভিন্ন দাওয়াতি কার্যক্রমের বিশেষ একটি কাজ হলো, ইজতেমা। এর উদ্দেশ্য হলো, বেশি পরিমাণে লোক একত্র করে তাদের তাবলিগের কাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং বেশি বেশি জামাত তাবলিগের কাজের জন্য প্রস্তুত করা। শুধু বয়ান শোনানো তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। কেননা বয়ানের মাধ্যমে ধর্মীয় কাজের বাস্তব প্রশিক্ষণ হয় না। বরং এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। মেহনতের প্রয়োজন। আর এই সময় লাগানোর জন্য মানুষকে প্রস্তুত করার উন্মুক্ত সুযোগ হলো ইজতেমা। ইজতেমা শুধু বাংলাদেশেই হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ইজতেমা হয়। কোথাও পুরো দেশ নিয়ে, কোথাও কয়েকটি দেশ মিলে, কখনো একটা দেশের প্রদেশ বা অঞ্চলেরও ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন জেলায় ইজতেমা হয়। চল্লিশের দশকে বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কাজ শুরু হয়। ১৯৪৬ সাল থেকে কাকরাইল মসজিদকেন্দ্রিক তা চলতে থাকে। সে সময় বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের আমির ছিলেন মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)। ওই বছর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দুই বছর পর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে দ্বিতীয়বারের মতো ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তার ১০ বছর পর ১৯৫৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ ও বিশ্বে বিভিন্ন দেশের তাবলিগ সাথীদের সমন্বয়ে টঙ্গীর ১৬০ একর জায়গায় বিশাল মাঠে এ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়; যা বিশ্বব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে এ ইজতেমায় বিশ্বের শতাধিক দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশগ্রহণ করে। মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পাকিস্তান, ভারত ও ইউরোপীয় দেশসমূহসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ থেকে মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করেন বিশ্ব ইজতেমায়। আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বিশ্ব ইজতেমার মাঠে প্রবেশের জন্য প্রায় ১৭টি প্রবেশপথ রয়েছে। এ ছাড়া তুরাগ নদের ওপর সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি ভাসমান ব্রিজ তৈরি করে। ইজতেমার মাঠের ভিতরে থাকে প্রায় আড়াই শ মোকাব্বির মঞ্চ। যেখান থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আজান দেওয়া হয়। বয়ান শোনার জন্য মাঠজুড়ে স্থাপন করা হয় প্রায় ১৫ হাজার ছাতা মাইক। এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আরও কয়েক মাইল পর্যন্ত মাইকের ব্যবস্থা করে থাকেন। আগের তুলনায় ইজতেমার মাঠকে অনেক উন্নত করা হয়েছে। মাঠের চার পাশে বেশ কিছু বহুতল বাথরুম তৈরি করা হয়েছে। বাঁশের খুঁটির ওপর চট লাগিয়ে মাঠে ছাউনি তৈরি করা হয়। এরপর বিভিন্ন জেলা থেকে আগত লোকদের জন্য জেলাভিত্তিক খিত্তা নম্বর এবং খুঁটি নম্বর দিয়ে ভাগ করা হয়, যাতে আগত মুসল্লিরা নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারেন।

লেখক : খতিব- আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর