শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

শহীদ আসাদের রত্নগর্ভা মা

বিমল সরকার

শহীদ আসাদের রত্নগর্ভা মা

আজ ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উত্থানপর্বে আইয়ুবশাহীর লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহীদ হন প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসাদ (২০ জানুয়ারি), শহীদ মতিউর (২৪ জানুয়ারি) ও শহীদ শামসুজ্জোহা (১৮ ফেব্রুয়ারি) এভাবেই আইয়ুবের পতন আর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বর্ধিষ্ণু ধানুয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪২ সালে আসাদের জন্ম। আসাদ ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত। স্কুল জীবনেই আসাদুজ্জামান ও মনিরুজ্জামান দুই ভাই ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নিজ উপজেলা শিবপুর ও নরসিংদীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এলাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান আসাদ। অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ, শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ এবং মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। আসাদের বাবা এম এ তাহের ছিলেন শিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আর মা মতিজাহান খাদিজা খাতুন নারায়ণগঞ্জ শহরের খ্যাতনামা আইটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষিকা। তাঁদের সুপরিসর বাড়িটি এলাকায় ‘মিয়াজিবাড়ি’ নামে সমধিক পরিচিত। আসাদের বাবা এম এ তাহের ছিলেন খুবই পণ্ডিত ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে তিনি ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। তাহের-মতিজাহান দম্পতি এমনই পরম সৌভাগ্যবান যে, সেরা সেরা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাশেষে ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে সবাই তাঁরা যার যার কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে দেখে যেতে পেরেছেন। এই দম্পতি তাদের আটটি সন্তানের নাম রাখেন (ক্রমানুসারে): কে এম খুরশীদুজ্জামান খলিলুল্লাহ মোহাম্মদ খুরশীদুজ্জামান, এন এম মুরশীদুজ্জামান (নাসরুল্লাহ মোহাম্মদ মুরশীদুজ্জামান), এফ এম রশীদুজ্জামান (ফয়জুল্লাহ মোহাম্মদ রশীদুজ্জামান), এ এম আসাদুজ্জামান (আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান; গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ), এইচ এম মনিরুজ্জামান (হাবিবুল্লাহ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান), আনোয়ারা ফেরদৌসী, এ এম নূরুজ্জামান (আজিজুল্লাহ মোহাম্মদ নূরুজ্জামান) ও দেলোয়ারা ফেরদৌসী। শহীদ আসাদসহ তাঁদের দুই ছেলে (ইতিহাস বিভাগ) ও দুই মেয়ে (প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। দুই ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে পরবর্তীতে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। সবার বড় কে এম খুরশীদুজ্জামান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও তৃতীয় ছেলে এফ এম রশীদুজ্জামান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। খুবই গৌরবের কথা যে, আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও এর নকশা তৈরিতে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের সহযোগী হিসেবে দেশীয় প্রকৌশলী রশীদুজ্জামানেরও (শহীদ আসাদের পীঠাপীঠি অগ্রজ) অংশগ্রহণ রয়েছে। শহীদ আসাদের অনুজ এইচ এম মনিরুজ্জামান আনন্দ মোহন কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। আমি তাঁর গুণমুগ্ধ একজন ছাত্র। ফেসবুকেও স্যারের সঙ্গে আমার সংযোগ রয়েছে। ২২ জুন ২০২১ স্যারের দেওয়া একটি পোস্ট থেকে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। পোস্টটি মূলত স্কুলজীবন ও স্যারের প্রিয় দুজন শিক্ষককে নিয়ে লেখা। এতে আরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন স্যারের গর্ভধারিণী মা। পোস্টটি এমন : ‘‘সেটি পঞ্চাশ দশকের শেষদিককার কথা। স্কুলে উর্দু, সংস্কৃত, আরবি যে কোনো একটি বিষয় পড়তে হতো। সেভেন-এইটে পড়ার সময় শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্র চন্দ্র সেন আমাদের বাংলা পড়াতেন। তিনি ছিলেন সাধু চরিত্রের মানুষ। বিরতির সময় মুসলিম ছাত্ররা নামাজ পড়ত। এই ৪০ মিনিট সময় একটি নির্জন কক্ষে একাগ্রচিত্তে তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। বাড়ির বাইরে জলও স্পর্শ করতেন না। বীরেন্দ্র স্যারের ছোটভাই সুধীর চন্দ্র সেন বিএসসি ছিলেন একেবারে বিপরীত স্বভাবের, এমনকি তিনি গোমাংসও খেতেন। দুই ভাইকে নিয়ে নানারকমের গল্প প্রচলিত ছিল। বীরেন স্যার ছিলেন অনেক লম্বা, সুধীর স্যার অনেকটাই খাটো। স্কুলে আসার পথে একটি সাঁকো ছিল। সাঁকোটি ভেঙে যাওয়ায় নিচ দিয়ে যাতায়াত করার সময় পথচারীদের কাপড় ভিজে যেত। বীরেন স্যার একটা গামছা পরে জায়গাটা পার হতেন। কিন্তু আমাদের সুধীর স্যার বেশ নিঃসংকোচে সেই গর্ত পার হয়ে আসতেন, শুধু দাদার পেছনে হাঁটতেন। জামা কাপড় শুকনোই থাকত।

বীরেন স্যার ছিলেন শিশুর মতো সরল। ক্লাসে আমাদের বলতেন, “তোরা বল তো, সুধীর বেশি লম্বা নাকি আমি?” আমরা বলতাম, “আপনিই বেশি লম্বা স্যার।’’ “আচ্ছা বল তো, চাকদার ওই গর্তটি পার হতে গেলে আমার কাপড় ভিজে যায়, কিন্তু সুধীরের তো কখনো কাপড় ভিজে না।” বীরেন্দ্র স্যারকে খুব পছন্দ করতাম বলে তাঁর কাছে সংস্কৃত পড়তাম।

আমরা সব ভাই বাবার স্কুলে বীরেন স্যার ও সুধীর স্যারের ছাত্র ছিলাম। আমি তখন আনন্দ মোহন কলেজে শিক্ষকতায় আর মেজোভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায়। বীরেন স্যার খুব অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলেন। স্যারের চিকিৎসায় বড় সমস্যা দেখা দিল, তিনি বাইরের কোথাও কিছু খাবেন না। স্যার আমার বাবার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। বাবা একই স্কুলের হেডমাস্টার, বাবার অনুরোধও রাখলেন না। না খেয়ে তাঁর শরীর দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে।

আমার মা সব জেনে স্যারের জন্য খাবার, পথ্য তৈরি করে নিজে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। স্যারকে বললেন, “আপনার বোন নতুন বাসনপত্র কিনে, অন্যের কোনো স্পর্শ ছাড়া নিজ হাতে সব তৈরি করে নিয়ে এসেছে; আপনাকে তা খেতেই হবে।’’

মায়ের কথা শুনে স্যারের দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, শীর্ণ হাত দুটি দিয়ে আমার মায়ের হাত দুটি ধরলেন এবং বললেন- “বোন, আমি তোমার আনা, তোমার রান্না করা খাবার খাব; এ খাবার আমার জন্য অমৃত।” স্যার সে-বার সুস্থ হলেন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। স্যারের বয়স তখন ৮০-এর বেশি।

আমার জীবনে দেখা বীরেন স্যার প্রকৃতই একজন সাধু পুরুষ, দেবতুল্য মানুষ ছিলেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর