রবিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশের অগ্রগতিতে পোশাকশিল্প

মো. খসরু চৌধুরী

দেশের অগ্রগতিতে পোশাকশিল্প

অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি শিল্প খাত। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক-শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ খাত শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারকেই সমৃদ্ধ করেনি, একই সঙ্গে নিশ্চিত করেছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান। পোশাকশিল্পের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোয় প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে সামনের সারিতে বাংলাদেশ। এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে পোশাকশিল্প। বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সারা পৃথিবীতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাতি দিয়েছে এ পণ্য। শ্রমঘন এ শিল্পটি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। আশির দশক পর্যন্ত মোট রপ্তানির ৫০ শতাংশ ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। এরপর পাটকে পেছনে ফেলে পোশাকশিল্পের যাত্রা। ১৯৮২ সালে কারখানা ছিল ৪৭টি, বর্তমানে এ সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৩ দশমিক ৮৯ ভাগ। কিন্তু গত ১০ বছরের গড় হিসাবে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসছে এ খাত থেকে। এ খাতের হাত ধরেই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিকাশ হয়েছে। গার্মেন্টস দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পরে তারা অন্যান্য শিল্পে রূপান্তর ঘটিয়েছে। আর বর্তমানে রাজস্বের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই আসছে বেসরকারি খাত থেকে। অন্যদিকে পোশাকশিল্পের বিকাশে নারীর ক্ষমতায়নসহ বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও তৈরি পোশাকশিল্পে ২৫ লাখের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছে। এতে শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।

স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে পোশাকশিল্প দেশকে অনেক দিয়েছে। কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশাল অবদান এ খাতের। আজকের যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, তার পেছনে পোশাকশিল্পের অবদান অন্যতম। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ৩০টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশকে ধরা হয়।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিরূপ অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকার জন্য যে দুটি খাতকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় তার একটি হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। রপ্তানি বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখা এ শিল্প কেবল দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডের ভূমিকাই রাখছে না, নারীর ক্ষমতায়নেও বিপ্লবের সূচনা করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রপ্তানি থেকে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এর মধ্যে কেবল তৈরি পোশাক খাত থেকে ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ৮১.৮১%। বিপুল অঙ্কের এ রপ্তানির পেছনে রয়েছেন গ্রাম থেকে উঠে আসা লাখ লাখ নারী।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছে। বর্তমানে বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গত বছর ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে, ২০৩০ সালে যা ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। বাংলাদেশ এখন চাহিদা মোতাবেক যে কোনো পরিমাণ পণ্য যথাসময়ে সরবরাহের সক্ষমতা অর্জন করেছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্প কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পণ্যের মান ও ডিজাইন আধুনিক করা হচ্ছে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পে কিছু বিদেশি দক্ষ কর্মী ছিল, এখন আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কর্মীরাই কাজ করছে। শিল্প বিকাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০ স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। অনেকটির কাজ এখন শেষ পর্যায়ে।

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিশ্বমানের ও আধুনিক তৈরি পোশাক তুলনামূলক কম দামে সরবরাহ করতে সক্ষম। সরকারের সহযোগিতায় তৈরি পোশাকশিল্পসহ দেশের অর্থনীতির চাকা চলমান ছিল। একসময় বাংলাদেশের মসলিন ও জামদানি ছিল ভুবনবিখ্যাত। কিন্তু উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের ফলে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে এ শিল্প তার মর্যাদা হারায়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প বিকাশের মাধ্যমে বস্ত্র ক্ষেত্রে তার হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পোশাকশিল্প নতুন সম্ভাবনাময় সংযোজন। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে এ খাত থেকে। বেকার সমস্যা সমাধান, বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার পেছনে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান অনস্বীকার্য।

পোশাকশিল্পের উৎপাদিত পোশাকের মধ্যে শার্ট, পায়জামা, জিন্সপ্যান্ট, জ্যাকেট, ট্রাউজার, গেঞ্জি, সোয়েটার, পুলওভার, ল্যাবরেটরি কোর্ট, খেলাধুলার পোশাক, শীতকালীন নানা ধরনের গরম কাপড়ের তৈরি পোশাক, নাইট ড্রেস, মেয়েদের ব্লাউজ প্রভৃতি বিশ্ববাজারে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে।

বর্তমান বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্পসংশ্লিষ্ট তৈরি পোশাকশিল্পের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় পোশাকশিল্পের প্রসারের পথে বিরাজমান যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে এ শিল্পের উত্তরণে এগিয়ে আসা সংশ্লিষ্ট সবার অন্যতম দায়িত্ব। আর এ লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা, সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সমন্বিত পদক্ষেপ এখানে ১০০% সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

লেখক : সিআইপি। পরিচালক বিজিএমইএ

সর্বশেষ খবর