সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

পোলট্রি খাত বাঁচাতে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

এ এইচ খান রতন

পোলট্রি খাত বাঁচাতে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

দেশে ব্রয়লার মুরগির দাম এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ডিমের দাম বাড়ছে স্পুটনিক বেগে। দাম বাড়লেও লোকসানের শিকার হয়ে এক বছরে ৪০ শতাংশ  পোলিট্র ফার্ম বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ পোলট্রি ফিডের দাম বেড়েছে অবিশ্বাস্যহারে।  এর পেছনেও রয়েছে সিন্ডিকেটের হাত। বিশাল বিনিয়োগের পোলট্রি সেক্টরে সিন্ডিকেটের বিধ্বংসী থাবা এখন সারা দেশে আলোচ্য বিষয়। বিষয়টি এখন মাঠ ছাড়িয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। পোলট্রি সেক্টরের অস্থিরতা ঠিক কোন কারণে শুরু এ পর্যন্ত প্রকাশিত অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা, টিভি টকশো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও গবেষকদের তথ্য বাস্তবভিত্তিক বলে ভুক্তভোগীরা কেউ মেনে নিতে পারছে না। কারণ সঠিক তথ্যনির্ভর সমস্যা চিহ্নিত করতে না পারার ব্যর্থতা। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা পৃথিবীতে সাশ্রয়ী মূল্যে আমিষ প্রাপ্তি ও সহজলভ্যতা স¦াভাবিকভাবেই পোলট্রি সেক্টরকে গুরুত্বপর্ণ করে তুলেছে। ডিম ও মুরগির মাংসের নানাবিধ জনপ্রিয় রেসিপি শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবার কাছেই উপাদেয়। অথচ হনুমানের লেজে আগুন লাগার পরও এ সেক্টর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সাবধান না হওয়ার কারণে সেক্টরটিকে অহরহই অপবাদ ছুড়ে মারছে দেশের মানুষ। যদিও বাস্তব ও তীর্যক এসব মন্তব্যকে হর্তাকর্তারা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। বরং পোলট্রি সেক্টরে পাহাড়সম সমস্যাকে কোনো সমস্যা নেই এবং এটি খুব সাধারণ বিষয় বলে সগর্বে বলে বেড়াচ্ছেন। যা রীতিমতো খামারিদের সঙ্গে তামাশার শামিল। সমস্যাটি সাম্প্রতিক সময়ে সবার দৃষ্টিতে পড়লেও এর শুরুটা কয়েক বছর আগে থেকেই। ভুক্তভোগীরা যখন সাধ্যানুযায়ী বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতরের নজরে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল, তখন কর্তাব্যক্তিদের সম্বিৎ ফেরেনি। ক্রমান্বয়ে লেজের আগুন দেহে উত্তাপ শুরু করায় কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। কারণ পোলট্রি সেক্টরে মূল সমস্যা সাতটি। যথাক্রমে- ১. পুলেট সিন্ডিকেট ২. ফিড সিন্ডিকেট ৩. ডিম সিন্ডিকেট ৪. ওষুধ সিন্ডিকেট ৫. ভুয়া ওষুধ সিন্ডিকেট ৬. চিকিৎসক সিন্ডিকেট ৭. হাতুড়ে চিকিৎসক সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেই। কাজেই সমস্যা সমাধানের কোনো আশাও নেই। যেসব বিষয় নিয়ে বিজ্ঞজনেরা তাদের মতামত ও পরামর্শ দিচ্ছেন, মাঠের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তার মিল নেই। হয়তোবা তারা ধরে নিয়েছেন কিছুদিন হইচই করে খামারিরা এমনিতেই চুপসে যাবে। কিন্তু এর পরিণতিতে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। কারণ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় ১৫ লাখ লোকের জীবিকা। চলার পথে অসংখ্য পোলট্রি শেড অহরহই এখন চোখে পড়ে। যেখানে ছিল অবিরাম প্রাণচাঞ্চল্য, সেখানে এখন নিষ্প্র্রাণ ভুতুড়ে পরিবেশ। জনগণের করের শত শত কোটি টাকা পোলট্রি সেক্টর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লোপাট হচ্ছে। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে ১৩৭ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। খামার প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত নিরাপদ পানি ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশ, যা সরকারি উদ্যোগে বাধ্যতামূলক শর্ত হওয়া উচিত, সেখানে খামারিদের প্রশিক্ষিত করার জন্য চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাধ্যতামূলক কর্মসূচিতে নেই, অথচ এটি অপরিহার্য। মিটফোর্ডের খোলাবাজারে শাকসবজির মতো কেমিক্যাল ক্রয় করে, বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের চটকদার নামে প্যাকেটজাত করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভুয়া কোম্পানিগুলো। খোলা বাজারের এ অ্যান্টিবায়োটিক মুরগির দেহে প্রবেশের ফলে মুরগি ইমিউনিটিলেস হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রকৃত ওষুধও মুরগির দেহে অকার্যকর হয়ে পড়ে। অথচ যে কয়েকটি রোগের ওপর ভিত্তি করে ভুয়া ওষুধবাণিজ্য চলছে এবং খামারিরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তার ৮০ ভাগ নিরাময়যোগ্য শুধু পরিবেশ ও পানির ওপর সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে। প্রতি উপজেলায় প্রশিক্ষিত টিম গঠন করে ভ্রাম্যমাণ কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূল খামারিদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। কারণ, তৃণমূল পর্যায়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরিবারের সবাই মিলে খামার পরিচালনা করে থাকে। পোলট্রি সেক্টরের এটিই বাস্তবচিত্র। রোগ ও ঝুঁকিমুক্ত খামার বাস্তবায়নে বাস্তবভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই, যা বাস্তবায়ন করলে বাঁচবে খামারি আর খামারভিত্তিক অর্থনীতি। প্রয়োজন অতি দ্রুত আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া, যেখান থেকে পিছিয়ে আছি আমরা বহুদূর। বাংলাদেশের পোলট্রি সেক্টর সরকার কিংবা বড় কোনো শিল্প উদ্যোক্তার আশীর্বাদের ফসল নয়। প্রায় তিন যুগ আগে নিতান্ত পারিবারিক বেকারত্বের অভিশাপমুক্ত হতে প্রান্তিক পর্যায়ের মহিলাদের হাতে ১০-২০টি মুরগির বাচ্চা প্রতিপালনের মাধ্যমেই এ সেক্টরের ভিত্তি রচিত হয়। যা আজ জিডিপির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের উচিত এ সেক্টরকে রক্ষায় সর্বাত্মক মনোযোগী হওয়া। দুর্বল ভিত্তির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, পোলট্রি সেক্টরের ন্যূনতম নীতিমালা ঠিক না করে এ খাতে জনগণের করের টাকা ব্যয় করা অপচয়ের শামিল।

একটা সময় ছিল দেশের ৭০ ভাগ মানুষ বছরে ১০-১৫টি ডিম ও পাঁচটি মুরগি খাওয়ার কথা ভাবতেও পারত না। গরুর মাংস খাওয়ার কথা তো বিশেষ কোনো পার্বণ ছাড়া চিন্তাও করত না। আজ তারাই এসব পণ্যের উৎপাদক হওয়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে বিত্তশালী সবার জন্য ডিম ও মুরগির আমিষ প্রাপ্তির সহজলভ্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে পোলট্রি খাত। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবার কাছে পণ্য দুটির চাহিদাও শীর্ষে।  কাজেই সরকার ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর দায়িত্ব বিশৃঙ্খল এ সেক্টরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে খামারভিত্তিক অর্থনীতিকে সচল রাখা।  দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের সরকারের কাছে এ মুহূর্তে এমনটিই প্রত্যাশা।

                লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

সর্বশেষ খবর