শাবান মাসকে বলা হয় রমজান মাসের বার্তাবাহক। এ মাসেই মুমিনরা রমজানের রোজার প্রস্তুতি নেয়। আল্লাহ রমজানকে নিজের মাস হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন। রমজানের মর্যাদা এবং পবিত্রতার পরিধি যে অপরিসীম সেটি উপলব্ধি করা যায় ওই বিশেষ মর্যাদার জন্য। শাবান মাসকে বলা হয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাস। রসুল (সা.) এর আগমন ঘটেছিল মানব জাতিকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে নেওয়ার পথ প্রদর্শক হিসেবে। রসুল (সা.) এমন একটি মাসকে নিজের মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন যা আল্লাহর প্রিয় মাস রমজানের বার্তাবাহকের ভূমিকা পালন করে।
মহানবী (সা.) শাবানে অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন। হজরত উসামা বিন জায়িদ (রা.) বলেন, ‘আমি একদিন মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম হে আল্লাহর রসুল! আমি আপনাকে শাবানের মতো অন্য কোনো মাসে এত অধিক রোজা রাখতে দেখিনি। উত্তরে তিনি বললেন, এ মাসের ব্যাপারে মানুষ বড়ই উদাসীন। অথচ এ মাসে মানুষের আমল মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা হয়। আর আমি চাই আমার আমলগুলো (আল্লাহর দরবারে) এমন অবস্থায় পেশ করা হোক যখন আমি রোজাদার’ (নাসায়ি, বায়হাকি)।
শাবান মাসে পবিত্র কাবা মুসলমানদের কিবলার মর্যাদা লাভ করে। মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। মিরাজের রাতে নামাজ ফরজের পর মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন। রসুল (সা.) হৃদয় দিয়ে চাইতেন, কাবাঘর হোক মুসলমানদের কিবলা। বিশ্বাসীদের আদিপিতা ইবরাহিম (আ.)-এর বানানো আল্লাহর ঘর হোক সেজদার লক্ষ্যস্থান। এ জন্য মুহাম্মদ (সা.) নামাজে দাঁড়িয়ে বারবার আকাশের দিকে তাকাতেন।নামাজ ফরজ হওয়ার ১৬ মাস পর বায়তুল মুকাদ্দাসের বদলে কাবাঘর কিবলা হিসেবে ঘোষিত হয় পবিত্র শাবান মাসে। কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে এভাবে, ‘বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমন্ডল আবর্তন আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি। সুতরাং কাবার দিকে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করে দেব, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব আপনি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ঘোরান। তোমরা যেখানেই থাক না কেন, ওই দিকেই মুখ ফেরাও।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৪)
রজব ও শাবান আগমন করলেই রসুলুল্লাহ (সা.) ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান এ দোয়াটি বেশি পাঠ করতেন, অর্থ হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শাবানকে বরকতময় করে দিন এবং আমাদের হায়াতকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন’ (নাসায়ি)।
মহান আল্লাহ শাবান মাসের ১৫তম রজনীকে অত্যন্ত বরকতময় ও মহিমান্বিত করেছেন। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘শাবানের মধ্য রাতে (১৫ শাবান) আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং প্রতিটি (মোমিন) বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তবে পরশ্রীকাতর ও মুশরিক ছাড়া।’ কিতাবুস সুন্নাহ, শরহুস সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ফেরেশতারা প্রতিদিন এবং রাতে পালাবদল করে তোমাদের (মানুষের) কাছে আসে। আসরের সময় এবং ফজরের সময় তারা একত্রিত হয়। অর্থাৎ আসরে একদল আসে আরেক দল চলে যায়। আবার ফজরের সময় একদল আসে আর আরেক দল চলে যায়। এভাবে ফেরেশতারা দৈনন্দিন ভিত্তিতে মানুষের আমল সকাল-বিকাল আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করে থাকে। আল্লাহ তাআলা তো বান্দার সব অবস্থাই জানেন। তারপরও তিনি সকাল-সন্ধ্যার এসব ফেরেশতাকে তিনি প্রশ্ন করেন- তোমরা আমার বান্দাদের কী অবস্থায় রেখে এসেছ? তখন ফেরেশতারা বলেন, আমরা সকাল-সন্ধ্যায় গিয়ে দেখেছি বা দেখে এসেছি, তারা নামাজ পড়ে।
আর সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মানুষের আমলনামাগুলো প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আল্লাহর কাছে পৌঁছানো হয়। আর বাৎসরিক ভিত্তিতে শাবান মাসে মহান আল্লাহর কাছে মানুষের আমলনামাগুলো পৌঁছানো হয়।
হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে, তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়ো, দিনেরবেলা রোজা রাখো। নিশ্চয় আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন, আমার কাছে কোনো গুনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত মুক্তি পেতে চায় কি? আমি তাকে মুক্তি দেব। আছে কি এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮)
আল্লাহ লাইলাতুল বরাত বা শবেবরাতে অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। হাদিসে বিধৃত হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একরাতে রসুল (সা.)-কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে তাকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয়, আল্লাহ এবং তার রসুল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? আয়েশা (রা.) বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। রসুল (সা.) তখন বললেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রাত আসে, আল্লাহ পৃথিবীর আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাদের ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৯) মহান আল্লাহ আমাদের মাহে শাবানের গুরুত্ব অনুধাবনের ও এ মাস থেকেই মাহে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের তৌফিক দান করুন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ।