অবশেষে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সমাবর্তনের যবনিকাপাত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সদাশয় উপস্থিতি  এবং শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে সিরিয়াস আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে স্বভাবসুলভ রসালো অথচ অর্থপূর্ণ তির্যক মন্তব্য উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে আমোদিত করে। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর গুরুগম্ভীর ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা শিক্ষার্থীদের হয়তো ঠিক ওভাবে আনন্দের জোগান দিতে পারেনি, কিন্তু রাষ্ট্রের দুই দিকপালের যুগপৎ উপস্থিতি এ অনুষ্ঠানকে যে একটি ভিন্নমাত্রা দিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান গুরুত্বের দিক থেকে যেমন বিশেষ মর্যাদা বহন করে, এটা সফলভাবে আয়োজন কর্তৃপক্ষের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জও বটে। এদিক থেকে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এবারের সমাবর্তন জাবি কর্তৃপক্ষের জন্য ছিল এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শতাধিক শিক্ষকের জন্য গাউনসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা, তাদের বসার জন্য বিশাল প্যান্ডেল তৈরি ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা, সর্বোপরি রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির মতো দুজন অতি উচ্চমার্গের অতিথির যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মোটেই কোনো সহজ কাজ ছিল না। এ বিশাল কর্মযজ্ঞের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় জাবি কর্তৃপক্ষ কতটুকু পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছেন সে বিচার অভ্যাগতরা করবেন, তবে বড় কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়া অনুষ্ঠানটি যে শেষ করা গেছে তজ্জন্য কর্তৃপক্ষকে তাদের প্রাপ্য ধন্যবাদটুকু দিতেই হবে।

সমাবর্তন অনুষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের ডিগ্রির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির উপলক্ষই কেবল নয়, এটা যেন তাদের জন্য এক মিলনমেলা। এখানে একসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পড়াশোনা করা বন্ধু-বান্ধবদের যেন মেলা বসে। সবার মধ্যে অনেক দিন পর তৈরি হয় একরকম পিকনিকের আমেজ। নেচেগেয়ে হইহুল্লোড় করে চারদিক মাতিয়ে তোলার এ যেন এক মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই সঙ্গে তাদের জন্য উপরি পাওয়া হয়ে দেখা দেয়, এ ডিগ্রি অর্জনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যে শিক্ষাগুরুরা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছেন, শেষবারের মতো গাউন পরে তাদের আশীর্বাদ নেওয়ার দৃশ্য ফ্রেমবন্দি করার বিরল সুযোগ। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষার্থীর যে আগ্রহ ও আকুতি দেখা যায় তা সত্যিই অতুলনীয়।

উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ফি বছর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে স্বল্প পরিসরে ছিমছাম ও গোছানো পরিবেশে অনেক কম চাপ নিয়ে আয়োজন সমাপ্ত করা যায়। শিক্ষার্থীদের প্রতি অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া সম্ভবপর হয়। আমাদের দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যেভাবে বেশ কবছর পর পর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় তাতে একদিকে যেমন খরচ বেড়ে যায়, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের প্রতিও যথোচিত মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য কোনো হলঘর বা অডিটরিয়ামে স্থান সংকুলান না হওয়ায় খোলা মাঠে বড় অঙ্কের অর্থের শ্রাদ্ধ করে প্যান্ডেল টাঙাতে হয়। গাউন সংগ্রহ ও প্রত্যর্পণ এবং প্রভিশনাল সার্টিফিকেট জমাদান ও মূল সার্টিফিকেট উত্তোলনে বিশাল লাইন পড়ে যায়। তা ছাড়া এত বিপুল সংখ্যক লোকের জন্য খাবার-দাবারের আয়োজন করাও (তা যত স্বল্পই হোক) এক এলাহি ব্যাপার। ফলে সমাবর্তনের বিপুল উচ্ছ্বাসের সঙ্গে এসব বিড়ম্বনার মিশেলে পুরো আয়োজনটি কিছুটা হলেও ম্রিয়মান হয়ে পড়ে।

কাজেই সময় এসেছে একটু ভিন্নভাবে ভাবার। ফি বছর না হোক, এক বছর অন্তরও যদি সমাবর্তনের আয়োজন করা যায়, আরও কম খরচে কম আয়াসে এবং অপেক্ষাকৃত পরিপাটিভাবে এ আয়োজন সম্পন্ন করা যাবে। অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম ফি নিয়ে শ্রেয়তর পরিষেবার জোগান দেওয়া যাবে। তখন পুরো আয়োজনজুড়ে থাকবে কেবলই আনন্দ  আর উচ্ছ্বাস। সমাবর্তন হয়ে উঠবে এক অবিমিশ্র আনন্দের প্রাণবন্ত উৎসব।

লেখক : অধ্যাপক ও সভাপতি ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়