বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী : আমার অভিজ্ঞতা

হোসেন আবদুল মান্নান

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী : আমার অভিজ্ঞতা

সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে’। এদের বিষয়ে তিনি জাতিসংঘের আন্তরিক সহযোগিতা চেয়েছেন। জাতিসংঘের একজন আবাসিক সমন্বয়কারীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এ বিষয়ে সার্বিক সহায়তা প্রত্যাশা করেছেন। মনে হয়, তাঁর ঔদার্য ও মানবিকতার সুযোগ নিয়ে এ  মুহূর্তে দেশের অভ্যন্তরে থাকা রোহিঙ্গারা নানাবিধ অপরাধ ও অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। আসলে এর শেষ কোথায়?

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ইতিহাস অনেক দিনের। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্র (বার্মা) মিয়ানমার শুরু থেকেই জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে আটকে পড়ে। তারা নিজেদের মাতৃভূমিতে সব ভূমিপুত্রকে সমানভাবে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়। অথচ বিশাল ভৌগোলিক ব্যাপ্তি নিয়ে একটা বহুবিধ শ্রেণি ও জাতিগোষ্ঠীর এক জনপদের নাম বার্মা বা আজকের মিয়ানমার। তারা বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় প্রায় ১৩৫টি জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে; যে তালিকায় রোহিঙ্গারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা হলো বাংলাদেশি এবং অধিকাংশই মুসলমান। তাদের নামও রাখা হয় আরবি ভাষায়। বর্তমান রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হলো রোহিঙ্গা। তাদের দাবি, আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা কেবল আরাকান রাজ্যেই বসবাস করছে। এবং মিয়ানমার সরকার বলে আসছে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে তাদের দেশে বসবাস করছে। যদিও ইতিহাস বলে, বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে রোহিঙ্গারা দেশের পশ্চিম-উত্তর অঞ্চলের এক আদি জনগোষ্ঠী। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতেই আরাকানে এ জনগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন হয়। এমনকি এক সময় আরাকান থেকে দেশটির জাতীয় সংসদে তাদের নিজেদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিও ছিল।

সুদীর্ঘ কালের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জ্বলন্ত নজির রয়েছে যে, জাতিগত দাঙ্গা হত্যা নিপীড়নের ষড়যন্ত্র বাধিয়ে রোহিঙ্গাদের বারবার নিজের জন্মভূমি থেকে উৎখাত করা হয়েছে। আর এসবের পেছনে সবসময় ইন্ধন দিয়েছে জান্তা সরকার। তারা সাম্প্রদায়িক কলহ-বিবাদ লাগিয়ে দিয়েছে আরাকানি বৌদ্ধ মৌলবাদীদের সরাসরি মদদ দিয়ে। এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার প্রজন্ম পরম্পরায় অমানবিক ও বৈরী আচরণ করে চলেছে। সরকার নানা সময়ে অদ্ভুত সব আইনকানুন, প্রবিধানমালা, প্রজ্ঞাপন জারি ইত্যাদি করে তাদের ভিটেমাটি থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করতে চেয়েছে। সব সরকারের মূল টার্গেট থাকে জাতি হিসেবে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে তাদের ব্যাপক হারে মাতৃভূমি ছেড়ে আসতে বাধ্য করা হলেও এর আগের ইতিহাসও কম নিষ্ঠুর নয়। ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯১-৯২, ২০১২, ২০১৬ ও সর্বশেষ ২০১৭ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কর্তৃক জ্বালাও-পোড়াও লুটপাট, এমনকি নৃশংস গণধর্ষণ ও গণহত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। উল্লেখ করা যায়, ২০১২ সালের দাঙ্গায় শতাধিক রোহিঙ্গা প্রাণ দেয়। সে সময়েও গৃহহীন হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ। সরকার পরিচালিত এমন নারকীয় তান্ডব সারা পৃথিবী দেখেছিল। যা আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক প্রকাশিত ও স্বীকৃত হয়েছে। এবং প্রতিবারই রোহিঙ্গারা সর্বস্ব হারিয়ে পার্শ্ববর্তী স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করেছে।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে একসঙ্গে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হলে তারা জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে ডিঙি নৌকায় বা সাঁতার কেটে টেকনাফের নাফ নদ অতিক্রম করে। মা তার মৃত শিশুকে বুকে নিয়ে প্রাণভয়ে মানুষের স্রোতে ভেসে আসেন। নবতিপর বৃদ্ধা মাকে খাঁচায় তুলে কাঁধে নিয়ে পালিয়ে আসে যুবক। অবুঝ শিশুদের হাত ছেড়ে দিয়ে অসহায় বেঁচে আসে বাবা। সেই দুঃসহ সময়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে আমি নিজে সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন বাস্তব ও প্রত্যক্ষ দৃশ্য অবলোকন করেছি। মানবতার জয়গান নিয়ে হাজির হয়েছি নিঃস্ব মানুষের পাশে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক ও সংবেদনশীল সিদ্ধান্তকে যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করি। তখন সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশ এবং সরকার প্রধানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ছিল। জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব, বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ প্রতিদিন পৃথিবীর কোনো না কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের আগমন ঘটেছে। এবং কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে তাঁদের সফরসঙ্গী হওয়ার অনন্য সুযোগ আমার হয়েছিল। সে সময় পৃথিবীর ১৭টি রাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করা হয়েছে। যার প্রত্যক্ষ গ্রহীতা ও বিতরণ কর্মে নিজেই নিয়োজিত ছিলাম। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আমাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস এবং উদ্দীপনার সীমা ছিল না যখন পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীও বিশ্বদরবারে দেশের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেছেন। ২০১৯ সালেই তিনি চীন, জাপান, ভারত সফর করেছেন। ইউনেস্কোসহ জাতিসংঘের আন্তরিক হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা কামনা করছেন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস, দেশি-বিদেশি শত শত এনজিও এবং বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ তথা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও আবাসন নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। উখিয়ায় ৩৪টি ক্যাম্প ও সমন্বয়ক অফিস নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করি। সরকারি সেবা প্রদানের নিমিত্ত চট্টগ্রাম থেকে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিষ্পেষিত নিষ্প্রভ একটি জাতিগোষ্ঠী। জন্মভূমিতে যাদের নিজস্ব কোনো বিশেষ পরিচয় নেই, তারা কখনো জাতীয় চরিত্র গঠনের সুযোগও পায়নি। প্রজন্মান্তরে তারা বেড়ে ওঠে মারাত্মক ট্রমার ভিতর দিয়ে। তাদের কোনো মধুর শৈশব-কৈশোর থাকে না। থাকে না শেকড়ছোঁয়া বিশেষ পারিবারিক শিক্ষা। তারা যেন অনিশ্চিত অচেনা গন্তব্যের পদযাত্রী। সবাই নিজ ভূমে পরবাসীর মতন।

গত ছয় বছরে বাংলাদেশের জল সীমানাঘেঁষা একটা উপজেলায় অবস্থানরত এক মিলিয়নের কাছাকাছি (দশ লাখ) এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা স্থানীয় জনগণের চেয়ে সংখ্যাধিক্যে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের অবাধ বিচরণে স্থানীয় আদিবাসীরা বরং ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা কৃষি ব্যবসা-বাণিজ্যে সর্বত্র তারা এখন প্রচ্ছন্ন হুমকির সম্মুখীন হয়ে আছে।

এদের মধ্যে প্রতিনিয়ত দলাদলি, রণকৌশল ও পথের ভিন্নতা নিয়ে মতদ্বৈততা, খুনাখুনি, মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যাওয়া, পাসপোর্ট ও ভোটার আইডি কার্ডের দালাল চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত হওয়া, ‘আরসা’ বা আরাকানি নানা সংগঠনের এজেন্ট হয়ে গোপনে কাজ করার বিচিত্রসব তথ্য পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব রাজনীতির পরিমন্ডলে মানবিকতার যে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা সত্যিই বিরল। একসঙ্গে ১০ লাখ বিদেশি মানুষকে স্বভূমিতে আশ্রয় দেওয়ার মতো ঝুঁকি সহজে কেউ নেবে না এবং ভবিষ্যতেও এমন নজির পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

শুধু তা-ই নয়, সরকার রোহিঙ্গাদের উন্নততর পরিবেশ ও জীবিকার উদ্দেশে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কক্সবাজারের উখিয়ার ঘনবসতি, অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি ঢাল থেকে সরিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষকে ব্যয়বহুল উন্নত আধুনিক আবাসনে প্রেরণের মহতী আয়োজন করেছে। এটাও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমিও একাধিকবার ভাসানচর পরিদর্শন করেছি এবং সেখানে রাতযাপন করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। তথ্য মতে, ভাসানচরের আয়তন ১৬ হাজার একর। দৈর্ঘ্য ৮ কি.মি. এবং প্রস্থ ৪.৬ কি.মি.। ইতোমধ্যে ১৩ হাজার একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে শরণার্থী আশ্রয় কেন্দ্র। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রকৌশলীদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সেখানে ১২০টি ক্লাস্টারে ১, ০৩, ২০০ জন রোহিঙ্গার বসবাস উপযোগী আশ্রয় কেন্দ্রের (Shelter House) দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোতে চমৎকারভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। যেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সাইক্লোন শেল্টার, বনায়ন, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার, খেলার মাঠ, তথ্যকেন্দ্র সবই হাতের নাগালের মধ্যে রয়েছে। যা সরেজমিন দেখে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রদূতরা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

বলাবাহুল্য, এমন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর খুব অনায়াসে হচ্ছে না। তারা নানামুখী তৎপরতায় জড়িত থেকে এখনো স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ প্রকাশ করছে না। সরকারকে উদ্বুদ্ধ করে আনতে হচ্ছে। জানা যায়, এ যাবৎ মোট ৮০০০ পরিবারের মাত্র ৩২,৫০০ রোহিঙ্গা সদস্য ভাসানচরে এসে অবস্থান করছে।  যদিও তাদের আগমন পর্যায়ক্রমে চলমান আছে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন সবার মুখে মুখে ফিরে-

* বাংলাদেশে আগত ক্রমবর্ধমান এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মহল বা দাতা সংস্থা থেকে আর কতকাল লালন পালন করা হবে?

* সরকারের অসংখ্য কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা ও অতিরিক্ত দায়িত্বের কবে অবসান হবে?

* এই বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে অলস না রেখে পোশাক শিল্পের আওতায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অধীনে আনা যাবে কি না তাও  জাতিসংঘের মাধ্যমে ভাবা যায়!

* আইডি কার্ডসমেত দৈনিকভিত্তিক কাজ কি ছোটখাটো নিত্য-নৈমিত্তিক অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না?

 

                লেখক : সাবেক সচিব ও গল্পকার, প্রাবন্ধিক।

সর্বশেষ খবর