মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

‘স্যার’, ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন নিষিদ্ধ হোক

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

‘স্যার’, ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন নিষিদ্ধ হোক

‘স্যার’, ‘মাই লর্ড’, ‘মিলর্ড’-এসব সম্বোধন আমাদের জন্য নৈতিক বাধ্যবাধকতা নয় বরং মানব জাতির আত্মমর্যাদাকে আহত করে, বিপর্যস্ত করে, ক্ষুণ্ণ করে, বিভাজন করে, পার্থক্য করে। কান্টের নীতি দর্শন হচ্ছে, মানুষ সর্বদাই নিজের স্বীয় মূল্যে মূল্যবান। এটাই আত্মভিত্তিক নীতি। মানুষের স্বীয় মূল্য গণ্য করে সব কাজ করতে হবে, তা তুমি নিজে হও বা অন্য কেউ হোক। মানুষকে স্বীয় মূল্যে মূল্যবান বলে মেনে নিতেই হবে। যার মাঝে মানুষ বিরাজমান আমরা তাকে কখনই খর্ব করতে পারি না বা তার ক্ষতিসাধন করতে পারি না অথবা নিহত করতে পারি না। আত্মহত্যা, দাসপ্রথা এসব নীতি এ কারণে অনৈতিক যে, প্রথম ক্ষেত্রে আপনার মাধ্যমে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অন্যের মাধ্যমে মানবতাকে শুধু অস্ত্র বা পন্থা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, স্বমূল্যে মূল্যবান উদ্দেশ্য বলে গণ্য করা হচ্ছে না। মানুষের ওপর প্রভুত্বমূলক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অসম্মানজনক ঔপনিবেশিক রীতিনীতি এখনো আমরা পরিত্যাগ করতে পারিনি। প্রভুভক্তির প্রতিমূর্তি আজও আমাদের হৃদয়-কোঠরে প্রতিস্থাপিত। জনগণ কর্তৃক ‘স্যার’, ‘মেম’, ‘সাহেব’ কিংবা বিচারালয়ে বিচারককে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে একেবারেই সংগতিবিহীন, অযথার্থ। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কোনোক্রমেই জনগণের ওপর প্রভুত্ব বা কর্তৃত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে পারবে না। কারণ আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। আর সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।

‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ বলতে সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকারসংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলিয়া ঘোষিত হতে পারে। সুতরাং একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী থেকে শুরু করে সচিব বা আইজিপি বা জেনারেল বা বিচারপতি সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত এবং তাঁরা সবাই সরকারি কর্মচারী হিসেবে চিহ্নিত হবে। সংবিধান নির্দিষ্ট করেছে প্রজাতন্ত্রের কর্মে বেতনাদিযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত বা কর্মরত কোনো ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী হিসেবে অভিহিত হবে। সুতরাং আমাদের প্রজাতন্ত্রে প্রভুত্ব বিস্তার বা দাসত্ব গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। ইউরোপের কোনো কোনো দেশে সেখানকার জমিদার বা সামন্ত প্রভুদের প্রজাগণ ‘স্যার’ সম্বোধন করে অর্থাৎ slave I remain, বা servant I remain (sir) এই উচ্চারণে তার দাসত্বের স্বীকৃতির পুনরাবৃত্তি করত। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অধীন ১২৯৭ সালে রাজতন্ত্রের বিশেষ অবদানের জন্য ‘নাইট’ খেতাব চালুর সঙ্গে স্যার শব্দটি চালু করা হয়। আভিজাত্য প্রকাশে, কর্তৃত্ব প্রকাশে, প্রভুত্ব প্রকাশে, শাসকদের প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে এসব অনাকাক্সিক্ষত শব্দের প্রচলন শুরু হয়। ব্রিটিশদের আভিজাত্য ছিল আমাদের সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা এবং ভৃত্যদের প্রতি অবিচার ও শ্রেণিবিদ্বেষে পূর্ণ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো জমিদার নেই, কোনো প্রভু নেই আর কোনো প্রজাও নেই। প্রভু আর ভৃত্যের সম্পর্কও সমাজে অনুপস্থিত। ঔপনিবেশিক মনোভাব, হাবভাব বা আচরণ কোনোটাই কারও জন্যই মানবিক মর্যাদাকে সুরক্ষা দেয় না। মুক্তিসংগ্রামে একসাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ঔপনিবেশিক মানসিকতার রাষ্ট্র বহাল রাখা বা নির্মাণের জন্য নয়, জনগণের ওপর নানাভাবে প্রভুত্বপূর্ণ সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ জারি রেখে জনগণকে পদানত রাখার জন্য নয়। আত্মদান করে বিদেশি প্রভুকে তাড়ানো হয়েছে দেশি প্রভুর আবির্ভাবের জন্য নয়। পদপদবি বা শক্তির জোরে বা বলপ্রয়োগ করে কাউকে নিজের অনুগত বা পদানত রাখা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রযোজ্য হতে পারে না। এডওয়ার্ড সাইদ তাঁর কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম গ্রন্থে বলেছেন, অধিকৃত দেশের জনগণের মধ্যে এমনভাবে শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা কর ও বিকাশ ঘটাও, যার ফলে তারা বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শাসক শক্তিকে নিজেদের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজনীয় মনে করে এবং স্বেচ্ছায় তাদের অধীন থাকে।

মেকলের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের এমন শিক্ষা দেওয়া যাতে শারীরিক দিক দিয়ে তারা ভারতীয় হলেও চিন্তাভাবনা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে আর ভারতীয় থাকবে না, তারা হবে তাদের পশ্চিমা শাসকদের মতোই।

সুতরাং প্রভুত্ব বা দাসত্বের সহায়ক সব সম্বোধন এবং যা ‘নৈতিকভাবে মূল্যহীন’ তা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। ব্রিটিশ প্রশাসক বা ইংরেজ বিচারকদের মাই লর্ড, মিলর্ড বা ইওর লর্ডশিপ সম্বোধনে সম্বোধিত করার পেছনে বাংলার প্রজাদের ওপর ব্রিটিশ শাসক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাই যে মূল উদ্দেশ্য ছিল তা বলা বাহুল্য। এসব সম্বোধন জনগণ বা আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থী কারও জন্যই স্বাধীন দেশে প্রযোজ্য নয়, এসব সম্বোধনে পরাধীনতাবোধ অনুভূত হয়।

সম্বোধনের ক্ষেত্রে My Lord, MiLord বা Your Lordship বলার কোনো আইনি বিধানও নেই। যেখানে দেশের প্রধান ব্যক্তি রাষ্ট্রপতিকে my Lord বলা হয় না, সেখানে বিচারপতিদের কেন বলা হবে? স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা ঔপনিবেশিকতার ভয়ংকর জাল ছিন্ন করতে পারিনি, প্রজাদের নাগরিক বানাতে পারিনি। বাংলাদেশে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মচারীদের জনগণ কর্তৃক ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন নিয়ে ইদানীং প্রায়ই জটিলতা হচ্ছে। আমলারা রুষ্ট হচ্ছেন, শাস্তিবিধানের হুমকিও দিচ্ছেন। স্যার অর্থের সঙ্গে যেখানে ‘দাস’ বা ‘চাকর’ জড়িত সেখানে তা উচ্চারণ করাই অবমাননাকর। এটা স্রেফ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রথা, ব্রিটিশদের প্রভুত্ব ও বাঙালির দাসত্বের সর্বশেষ পদচিহ্ন। ভারতের অনেক রাজ্যে হাই কোর্টের বিচারপতিরা ঔপনিবেশিক দাসত্বের সম্বোধনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশেও ঔপনিবেশিক দাসত্বের সম্বোধন বা রীতি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। ঔপনিবেশিক লিগ্যাসি বহন করা স্বাধীন দেশের কর্তব্য নয়। বার কাউন্সিল অব ইন্ডিয়াও ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশে এসব প্রস্তাব কবে উত্থাপিত হবে?

 

লেখক : গীতিকবি

[email protected]

সর্বশেষ খবর