বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা : আমার কিছু কথা

বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহ

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা : আমার কিছু কথা

মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস। মার্চ হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের মাস। শুরুতেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সব শহীদের ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি।

১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম ভবিষ্যতে একজন আইনজীবী হিসেবে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে  বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে অ্যাডভোকেট হিসেবে সনদ প্রাপ্তির পর বাংলাদেশের বৃহত্তম ঢাকা আইনজীবী সমিতির ১৮৫৭ নম্বর সদস্য পদ গ্রহণ করে অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে ঢাকা বারের খ্যাতিমান আইনজীবী এ কে এম রেজাউল করিমের জুনিয়র হিসেবে আইন পেশা শুরু করি। উল্লেখ্য, তিনি বিচারপতি শহিদুল করিমের পিতা। আইনজীবী হিসেবে হাতেখড়ি দেওয়ার সময় একজন নবীন আইনজীবীর যে রকম পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকার কথা, অনেকের মতে কাজে আমার আগ্রহ ও নিষ্ঠার জন্য তার চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু আইনজীবী হিসেবে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না।

১৯৮১ সালের শুরুতে  BCS Judiciary-তে মুন্সেফ পদে নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে আমার সিনিয়র আমাকে দরখাস্ত দাখিল করতে উৎসাহিত করতে থাকেন এবং এর ধারাবাহিকতায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ০১.১২.১৯৮১ তারিখে মুন্সেফ পদে বরিশালে যোগদান করি। বিচারক হিসেবে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদে ১৫ বছর ১০ মাস ১৪ দিন চাকরি করার পর ২১/১০/১৯৯৭ তারিখে জেলা জজ পদে পদোন্নতি পেয়ে ময়মনসিংহে নারী ও শিশু কোর্টে যোগদান করি। অতঃপর জেলা জজ হিসেবে নরসিংদী, বিচারক, জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রাম, পুনঃ জেলা জজ পদে পিরোজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, মহানগর দায়রা জজ পদে চট্টগ্রাম ও সর্বশেষে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০১০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ঢাকা মহানগর দায়রা জজ পদে কর্মরত ছিলাম। আমি নিম্ন আদালতে মোট ২৮ বছর ৪ মাস ১৫ দিন কাজ করেছি এর মধ্যে জেলা জজ হিসেবে বিভিন্ন কোর্টে ১২ বছর ৬ মাস কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।

আমাদের দেশের আইনজীবীগণ এবং সচেতন জনগণ বিভিন্ন কোর্টের বিচারক বা জজদের কর্মপরিধি ও এখতিয়ার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। একটি জেলায় জেলা জজ, বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে বিচার ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। একজন জেলা জজের তার নিজ কর্মস্থলে অনেক ভালো কাজ করার সুযোগ আছে। আমি জেলা জজ থাকাকালীন কোর্ট ম্যানেজমেন্টের আওতায় পুরনো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা-সহ, শুনানি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আদেশ প্রদান, কোনো বিলম্ব ছাড়া কোর্টের আদেশ ও নথি সংশ্লিষ্ট স্থানে প্রেরণসহ দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছি এবং সে লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।

আমি ২০১০ সালে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ১৮.০৪.২০১০ তারিখ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে হাই কোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করি এবং দেখতে দেখতে এখানে প্রায় ১৩ বছর (অর্থাৎ ১৩ বছর হতে মাত্র ১৮ দিন কম) অতিবাহিত হতে চলল। অধস্তন আদালতের বিচারকদের স্বপ্ন থাকে হাই কোর্টে বিচারক হিসেবে কাজ করার। আল্লাহর অশেষ রহমতে ও বাবা-মায়ের দোয়ায় আমার সেই লালিত স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে আজও শুকরিয়া আদায় করছি। প্রায় ১৩ বছর বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ৩০ মার্চ, ২০২৩ তারিখে মোট ৪১ বছরের বিচার কাজ শেষে বিদায় নিতে যাচ্ছি।

বাংলাদেশে যে কোনো শ্রেণির মানুষই বিভিন্ন কারণে মামলায় জড়িত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে মামলার পক্ষদের মূল সমস্যা হচ্ছে বিলম্বিত বিচার ও অনেক ক্ষেত্রে কোর্টের আদেশ ও নথি দ্রুত সময়ে সংশ্লিষ্ট স্থানে না পৌঁছা। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারি সংসদে প্রদত্ত ভাষণে বিচারে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে সবচেয়ে মূল্যবান ও হৃদয়গ্রাহী উক্তি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তা এখানে হুবহু তুলে ধরলাম- “একটা কোর্টে বিচার গেলে একটা যদি সিভিল মামলা হয়; আপনি তো উকিল, স্পিকার সাহেব। আল্লাহর মর্জি যদি একটা মামলা সিভিল কোর্টে হয়, ২০ বছরেও সে মামলা শেষ হয় বলতে পারেন আমার কাছে? বাপ মরে যাওয়ার সময় বাপ দিয়ে যায় ছেলের কাছে। আর উকিল দিয়ে যায় তার জামাইয়ের কাছে সেই মামলা। আর ক্রিমিনাল কেস হলে এই লোয়ার কোর্ট, জজ কোর্ট-বিচার নাই। জাসটিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড-উই হ্যাভ টু মেইক এ কমপ্লিট চেইঞ্জ এবং সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ যাতে সহজে বিচার পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার পায়। ব্যাপক পরিবর্তন দরকার।”

বঙ্গবন্ধুর উপরিউক্ত সুন্দর ও সাবলীল উক্তি থেকে দেখা যায় কীভাবে এ দেশে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচারের অপেক্ষায় বছরের পর বছর পড়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের নাড়ির স্পন্দন বুঝতেন, তাইতো তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু একই ভাষণে বলেছিলেন, মানুষকে বিলম্বিত বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে জুডিশিয়াল সিস্টেমের অনেক পরিবর্তন দরকার। কিন্তু আমরা কি গত ৫০ বছরে বিচার বিভাগে গণমুখী কোনো পরিবর্তন করেছি? এমনকি বিচারে কেন বিলম্ব ঘটে এবং তার প্রতিকারই বা কী সে সম্পর্কে কোনো রিসার্চ করেছি? বঙ্গবন্ধুর ওই উক্তির পরে বিলম্বিত বিচারের স্বপক্ষে আর কোনো প্রমাণ বা দলিলের প্রয়োজন নেই। দেশের সর্ব প্রান্তে ১৫-২০ বছরের শত শত পুরনো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে।

আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হয়েছে নিম্ন আদালতে দেওয়ানি মামলায় যে পক্ষ মেরিটে অসুবিধাজনক অবস্থায় থাকে, সে বিলম্বিত বিচারের জন্য যা কিছু করা দরকার সবই করে থাকে। এ অন্যায় পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করতে বিচারকদের যে দৃঢ় মনোভাব দরকার তার যেমন অভাব আছে, তেমনি বিচারকের সংখ্যা মামলার তুলনায় কম বিধায় প্রয়োজনীয় তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে, সুযোগ সন্ধানীরা দেওয়ানি মামলার বিচারে বিলম্ব ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে দুষ্ট লোকের এ অপতৎপরতা তো কোর্টকেই রুখতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই, বিচার প্রক্রিয়ায় যে কোনো অপতৎপরতা রোখার প্রাথমিক দায়িত্ব কোর্টের। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবীদের এক্ষেত্রে নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলে ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ১টি মামলা বিচারাধীন ছিল। অপরদিকে আজ যখন আমি এ বক্তব্য রাখছি ৩০.০৩.২০২৩ তারিখে তখন নিম্ন আদালতে ২০৫৯ অনুমোদিত কোর্টের বিপরীতে ১ হাজার ৮১০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ বিচার বিভাগে কাজ করে যাচ্ছেন। সুতরাং, প্রতিটি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার ভাগে গড়ে মাথা পিছু ২ হাজার ২২টি মামলা পড়ে। আমার মনে হয় একজন বিচারকের পক্ষে এতগুলো মামলা সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয় বিধায়, দুষ্ট লোকেরা বিচারকের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে মামলার বিচারে বিলম্বের ফাঁদ পেতে সফল হচ্ছে।

অপরদিকে ফৌজদারি মামলার বিচারে বিলম্ব ঘটার একমাত্র ও মৌলিক কারণ সাক্ষীর অনুপস্থিতি। ফৌজদারি মামলায় কোর্টে সাক্ষী আনার দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশ এ দায়িত্ব পালন করে না এ কথা যেমন বলা যাবে না, আবার তেমনি এটিই বাস্তব সত্য যে, পুলিশ যে হারে সাক্ষী উপস্থিত করছে তা দ্রুত বিচারের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত ও সহায়ক নয়। হয়তো পুলিশের তরফে এর জন্য অনেক কারণ থাকতে পারে কিন্তু বাস্তব সত্য হলো সাক্ষীর অনুপস্থিতির জন্য ফৌজদারি মামলার বিচারে বিলম্ব হচ্ছে।

কোর্টের বিচারকেরা দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার মধ্যে ফৌজদারি মামলার বিচার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ দেওয়ানি মামলার চেয়ে ফৌজদারি মামলার বিচার করা তুলনামূলকভাবে সহজ। বিচারকদের কারণে ফৌজদারি মামলার বিচারে বিলম্ব ঘটেছে এমন নজির বের করা বেশ কষ্টকর। এখন প্রশ্ন হলো, পুলিশ কেন ফৌজদারি মামলায় যথাযথভাবে সাক্ষী উপস্থিত করছে না। এর সহজ উত্তর, যেহেতু সাক্ষী আনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে তার কোনো জবাবদিহিতা নেই, তাই সে এ ব্যাপারে মনোযোগী নয়।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২) ধারায় বলা হয়েছে যে সাক্ষীদের কোর্টে উপস্থিত করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে পুলিশ উদাসীন হলে বা ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে পুলিশ সাক্ষী উপস্থিত করার ব্যাপারে চিরাচরিতভাবে উদাসীন। কিন্তু এ বিধানের কিছু ব্যতিক্রম দু-একটি আইনে আছে। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী উপস্থিত করার দায়িত্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার। কিন্তু পুলিশ সাক্ষীর সমন ও ওয়ারেন্ট কার্যকরী করতে ইচ্ছাকৃত গাফিলতি করলে এটাকে অদক্ষতা হিসেবে চিহ্নিত করে কোর্ট তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিতে পারবেন। এ আইনে এ রকম একটি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা থাকার ফলে পুলিশ ঠিকই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় সাক্ষীদের উপস্থিত করে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ আদালতগুলো ফৌজদারি মামলার বিচার করে থাকে। বেশির ভাগ ফৌজদারি মামলাতে সাক্ষীর অভাবে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। আপনি যদি যে কোনো একটি ফৌজদারি আদালতে মামলার নথি পর্যবেক্ষণ করেন, দেখবেন অসংখ্য মামলা সাক্ষীর অভাবে বিচার কার্য শেষ হচ্ছে না। ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা একটি মামলায় এরকম বিলম্বিত বিচারের ঘটনা প্রকাশ করেছে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে একজন ব্যক্তি রাজশাহী থেকে দোকানের মাল কিনতে ঢাকা এসেছিল, সে ১৯৯৮ সালের ১৮ মার্চ সন্ধ্যার সময় রাজশাহী যাওয়ার জন্য গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বসা ছিল। গাবতলী বাস টার্মিনালের পুলিশ ওই ব্যক্তির কাছাকাছি স্থানে একটি সিগারেটের প্যাকেটে হেরোইন পায়। পুলিশ ওই হেরোইনের জন্য ওই ব্যক্তিকে দায়ী করে মামলা দায়ের করে। মামলাটি যখন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য ধার্য ছিল তখন ২৪ বছর পর ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একজন সাক্ষীকে পরীক্ষা করা হয়। মামলাটিতে প্রতি ২-৩ মাস অন্তর তারিখ ধার্য হতো। এ মামলার আসামি দোষী কি নির্দোষ তা বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। কিন্তু রাজশাহী থেকে একজন ব্যক্তির ২-৩ মাস পর ঢাকায় এসে হাজিরা দেওয়া কতটা অমানবিক, কষ্টকর ও অর্থনৈতিক টর্চার করে তা কেবল একজন ভুক্তভোগীর পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব।

আমরা যারা বিচারক ও আইনজীবী, বিচারের এই মহান দায়িত্বে আছি তারা মানুষের এ সীমাহীন দুর্ভোগের দায় দায়িত্ব এড়াতে পারি না। আলোচিত মামলাটিতে যদি পুলিশ দায়েরের পর নিয়মিত সাক্ষী উপস্থিত করত নিশ্চয়ই এত দিনে বিচারকাজ শেষ হয়ে যেত। একটি মামলার আসামিকে যদি ২৫ বছর কোর্টে আসতে হয়, একটি প্রাথমিক রায়ের জন্য এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? যে কোনো মামলার বোঝা একজন ব্যক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং অন্য কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে মানসিকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এটা ঠিক যে, এসব কষ্টের কারণে নাগরিকদের ফৌজদারি অপরাধ সংঘটন থেকে সব সময়ই দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যদি কোনো কারণে কেউ মামলায় জড়িয়ে যান, সে ক্ষেত্রে বিচারের আগেই তাকে এভাবে অর্থাৎ আর্থিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো অমানবিকতা আর কিছু হতে পারে না। বিচারে যদি দোষ প্রমাণিত হয় অবশ্যই তাকে সাজা খাটতে হবে সেটা ভিন্ন কথা।

মানুষকে এ হয়রানির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। আমি যখন সিলেটে জেলা জজ এবং চট্টগ্রামে ও ঢাকায় মহানগর দায়রা জজ পদে কর্মরত ছিলাম তখন পুরনো মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। এ উদ্যোগ বা পরিকল্পনার আওতায় সব ধরনের মামলা থেকে সবচেয়ে পুরনো ১০টি মামলা চিহ্নিত করে সেই নথির ওপর ওই মর্মে একটি স্টিকার লাগিয়ে দিতাম। বারের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছিলাম এসব পুরনো ও নির্বাচিত মামলায় কোনো মূলতবি দেওয়া হবে না। এ পরিকল্পনার আওতায় অতি পুরনো মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

জেলায় একজন জেলা জজের বদলি হলে তার ধ্যান ধারণারও বদলি হয়ে যায়। আমার বদলির পর ওই পরিকল্পনা মতো আর পুরনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। আশার কথা, নিম্ন আদালতের মামলা নিষ্পত্তিসহ সার্বিক কাজকর্ম তদারকি করার জন্য বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী মহোদয় সাতটি বিভাগে সাতজন বিচারপতির নেতৃতে সাতটি মনিটরিং কমিটি গঠন করেছেন এবং এ কমিটি আমার জানা মতে নিম্ন আদালতের কাজকর্ম দেখাশোনা করে যাচ্ছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এ উদ্যোগের সুফল ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। ২০২২ সালে নিম্ন আদালতে ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৭টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং তার বিপরীতে ১৩ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির হার ৯৪% অর্থাৎ দাখিলকৃত মামলার শতকরা ৯৪ ভাগ মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে। দায়েরের সমপরিমাণ মামলা বা তার চেয়ে বেশি মামলা নিষ্পত্তি করতে পারলে মামলাজট কমে যাবে। আমার বিবেচনায় এ অগ্রগতি মূলত মনিটরিং ব্যবস্থার জন্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। মনিটরিং কমিটির জন্য নিম্ন আদালতের বিচারকেরা যেমন তাদের অভাব অভিযোগগুলো সহজে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নোটিসে আনতে পারবেন, তেমনি তাদেরও একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যেখানেই জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে সেখানেই আপনি কিছু দায়িত্বশীল আচরণ ও কাজ আশা করতে পারেন।

এবার উচ্চ আদালত নিয়ে কিছু কথা বলি, যেখানে আমি বিগত ১৩টি বছর বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছি। উচ্চ আদালতের নাম মূলত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আমাদের সংবিধানের ৯৪ নম্বর আর্টিক্যাল অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের সংবিধান ০৪.১১.১৯৭২ তারিখে গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে তার আগে কি স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট ছিল না? অবশ্যই ছিল। অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২, তারিখ ১১ জানুয়ারি এর ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ওই তারিখেই বাংলাদেশ হাই কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ওইদিনই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে বাংলাদেশ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন এবং ১২ জানুয়ারি শপথ প্রদান করেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য ওই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এটা সর্বজন বিদিত যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন এবং কী রকম জনসমুদ্র তাকে সংবর্ধিত করেছিল তা আমরা দেখেছি ও জানি। বাংলাদেশে পদার্পণের পর তাঁর কী রকম ব্যস্ততা থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ওই রকম তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও কোনো বিলম্ব না করে পরদিন ১১ জানুয়ারি তিনি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ প্রণয়ন এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ এবং তার এক দিনের মধ্যে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। এসব কিছু তার প্রশাসনিক সক্ষমতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কের চরিত্রের সামান্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে স্থগিত মামলাসমূহের বিচারের জন্য ১৬ আগস্ট, ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ হাই কোর্টে আপিল বিভাগ গঠন করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু উদ্বোধনী ভাষণে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ও বাংলা ভাষায় রায় প্রদানের ওপর জোর দেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজও আমরা অধিকাংশ রায় বাংলা ভাষায় দিতে পারিনি। উক্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম উপস্থিত ছিলেন।  ইদানীং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী দিবসকে স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালন করা হয়। (চলবে)

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্ট বিভাগের বিচাপতি

সর্বশেষ খবর