বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের নাম-ব্যক্তিত্বের প্রভা বিচারালয়ের চার দেয়ালের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রগাঢ় মানবতাবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি। যুদ্ধোত্তর (১৯৪৩) ব্রিটিশ-ভারতে মানবতার সেবায় ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’ সংস্থাটির মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। দেশভাগের আগে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও দাঙ্গা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ-সংক্ষেপে এস এম মোরশেদ। ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাতা আফজালুন্নেছা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ভগ্নি। বাবা সৈয়দ আবদুস সালিক ছিলেন তৎকালীন বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস)। এক সময় বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৯২৬ সালে রাজশাহী বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৩০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ অনার্স পাস করেন। পর্যায়ক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এলএলবি উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডন যান। এ সময় তিনিই একমাত্র ভারতীয় ছাত্র ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালীন কলেজ সংকলনের সম্পাদক ছিলেন তিনি। কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক।
চল্লিশের দশকে একজন মননশীল লেখক হিসেবে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিখ্যাত ‘গার্ডেন’ পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর প্যালেস্টাইন এবং আরব-বিশ্বে তিনি বিশেষভাবে প্রশংসিত হন। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ‘কায়েদে আজম’ সম্পর্কে সমালোচনাও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ২১-দফা কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা হাই কোর্টে বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৬২-৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের এডহক বিচারক নিযুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। বিচারিক জীবনে তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং প্রজ্ঞার পরিচয় সর্বজনবিদিত। তাঁর বিচক্ষণসম্পন্ন মামলাসমূহের মধ্যে রয়েছে মন্ত্রী সংঘটিত মামলা, সমাবর্তন মামলা ও মাহমুদ মামলা। এসব মামলা ইতিহাসখ্যাত মামলা বলে বিবেচিত। মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার মন্তব্য রেখেছিলেন যে, তিনিই একমাত্র বলিষ্ঠ ন্যায়বিচারক ও পাকিস্তানে নির্ভরশীল উদার এবং উচ্চমানের বিচারক। ১৯৬৭ সালের ১১ নভেম্বর আইয়ুব সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। যা ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ১৯৫৪ সালের ২১ দফা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা-যা ২১ দফারই সারাংশ আবার ঊনসত্তরে ছাত্রদের উত্থাপিত ১১-দফার প্রতিপাদ্য বিষয় যে একই সূত্রে গাঁথা ইতিহাস-বিশ্লেষকদের তাও দৃষ্টি এড়ায়নি। এসব দাবি প্রণয়নে তাঁর মেধা এবং মননশীলতার কারণেই তিনি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের ‘ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। কবি শামসুর রাহমান এ সম্পর্কে বলেন, আজ হয়তো অনেকেই জানেন না, সেই উৎসব কী পরিমাণ বিপজ্জনক ছিল আমাদের পক্ষে। পাকিস্তানি প্রভুদের নাখোশ করে আমরা রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালন করেছিলাম সেদিন। বিচারপতি মোরশেদ সেদিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন মনে পড়ে। সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান, স্টেজে তিনি সভাপতির ভাষণ পাঠ করছিলেন। সেই বক্তব্য ছিল কুৎসিতের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ঔদার্যের প্রতিবাদ। এখনো মনে পড়ে তার সেই ঋজু দীর্ঘ দন্ডায়মান মূর্তি, সেই প্রগাঢ় উচ্চারণ! মনে হয় এখনো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে, সেই আলোকময় মন্ডপে-‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যদের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলে বিচারপতি মোরশেদ তাঁর পক্ষ সমর্থন করেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাঁর কৌঁসুলি হিসেবে নিযুক্ত হন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদ স্যার উইলিয়ামস। প্রথম সাক্ষাতে টম উইলিয়ামসকে বিচারপতি মোরশেদ বলেছিলেন : আমি আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাব। জবাবে স্যার টম উইলিয়ামস বলেছিলেন : একজন প্রধান বিচারপতি সব সময়ের জন্যই প্রধান বিচারপতি।
বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তিনি সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারকে মূল্য দিয়েছিলেন বলেই স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে অসংখ্য মানুষের অকুণ্ঠ সম্মান, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা লাভ করেছিলেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছিল আইয়ুব সরকারের। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। আর এদেশের জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বরণ করেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোপায় ভূষিত করে। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ শুধু একটি নাম নয়, ইতিহাসের কিংবদন্তি অবিস্মরণীয় নাম। নতুন প্রজন্মকে তাঁর সম্পর্কে জানার আহ্বান জানাই এ কারণে যে, তাঁকে জানার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস জানা যাবে? তিনি আমাদের বাতিঘর। তিনি রেখে গেছে অনুকরণীয় জীবনাদর্শ। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। এই মহান ব্যক্তিত্ব ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। কিন্তু তিনি আছেন শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়। হৃদয় থেকে হৃদয়ে। তাঁর স্মৃতি ও আত্মার প্রতি নিবেদন করছি অনন্ত শ্রদ্ধা।
লেখক : কবি সেক্রেটারি : মোরশেদ স্মৃতি সংসদ