মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

মা আমার মা

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মা আমার মা

রবিবার ২ এপ্রিল জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির ছিল পবিত্র ইফতার মাহফিল। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এবং যুগ্ম দফতর সম্পাদক মাহমুদ আলম ভীষণ পীড়াপীড়ি করছিলেন তাদের ইফতারে যেতে। গিয়েছিলাম। ভালোই লেগেছে। একটা বিষয় খুবই চোখে পড়েছে তাহলো দলমতনির্বিশেষে প্রায় সবাই গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের বিপ্লব বড়ুয়া, মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, শেখ শহীদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, সালমা ইসলাম, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, বিএনপির খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মনিরুল হক চৌধুরী এমনতর অনেকেই ছিলেন। সেখানে হঠাৎই কথা উঠেছিল এই সেদিন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নূরে আলম সিদ্দিকী ইহলোক ত্যাগ করেছেন। কে যেন বললেন তাঁকে নিয়ে তেমন আলোচনা হলো না। উত্তরে একজন বললেন অনেক দিন রাজনীতি থেকে একটু দূরে ছিলেন তাই। হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। কেউ রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেই এত বড় একজন জাতীয় নেতার মৃত্যুতে দেশে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হবে না তা তো ভাবা যায় না। চার ছাত্রনেতার মধ্যে আবদুল কুদ্দুস মাখন অনেক আগে আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। তারপর শাজাহান সিরাজ। একেবারে শেষে গেলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। এখন বাকি জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনিও এ ইফতার মাহফিলে এসেছিলেন। সরকার এবং আওয়ামী লীগ ইফতার মাহফিল করছে না। তাই কিছুটা ঢিমেতালে রাজনৈতিক ইফতার মাহফিল চলছে। র‌্যাডিসনে আয়োজিত জাতীয় পার্টির ইফতার মাহফিল সুন্দর হয়েছে, সার্থক হয়েছে। পরম করুণাময় আল্লাহ জাতীয় পার্টির ইফতার মাহফিল কবুল ও মঞ্জুর করুন।

আজ আমার মায়ের ১৯তম পবিত্র মৃত্যুবার্ষিকী। মানব জীবনের সবচাইতে প্রিয় সবচাইতে আপন হলো মা। মা বিনে জগৎ সংসার অন্ধকার। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ একবার, দুবার নয় পরপর তিনবার। সর্বশেষ বলেছেন, ‘বাবার পায়ের নিচেও।’ তার পরও আমরা কেন যেন নারীসমাজের প্রতি পুরোপুরি বা যথাযোগ্য মর্যাদা দিই না বা দিতে পারি না। পুরুষ-নারী সবাইকেই মায়ের পেট থেকে জন্ম নিতে হয়। সেখানে প্রতাপশালী কোনো পুরুষই বলতে পারে না যে, সে কোনো মায়ের পেট থেকে জন্ম নেয়নি। তাই প্রত্যেকের নারীর প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকা উচিত। অনেক ক্ষেত্রেই তা যখন দেখি না বড় কষ্ট হয়। এখন দেশে নারীর জয়জয়কার। প্রায় সর্বক্ষেত্রে নারী। রাজনীতিতে নারী, সরকারে নারী, অফিস-আদালতে নারী। কোনো কোনো জায়গায় নারীরা তেমন ভালো করতে না পারলেও অনেক জায়গায় খুবই ভালো করছেন। তার পরও কেন যেন সমাজ-সংসারে নারীর খুব একটা মর্যাদা নেই। তাদের কাজের স্বীকৃতি নেই। যারা অফিস-আদালতে চাকরি করেন তেমন নারীর বাড়িঘরে যে মর্যাদা, যে চাকরি করেন না ঘর সামলান তাদের তেমন খুব একটা মর্যাদা নেই। আমরা প্রায় সবাই মনে করি বাড়ির কাজ সেটা তেমন কোনো কাজই না। কিন্তু একজন গৃহবধূ দিনরাত সংসারের জন্য যে কি গাধার খাটুনি খাটেন তা যাদের উপলব্ধি আছে তারাই শুধু বুঝতে পারেন। অনেকে মনেই করে না, রান্নাবান্না ঘরদুয়ার সামলানো কোনো কাজের কাজ। অথচ এ সংসারে এমন বহু মানুষ আছে একবার বাড়ির বউ রান্না না করলে পেট পুরে খেতে পারে না। দূরে যাব কেন, মায়ের রান্না ছাড়া আমার বাবা এক বেলা খেতে পারতেন না। আমরাও ভাইবোন প্রায় সবাই খেতে বসে ১০টা তরিতরকারির মধ্যে মা কোনটা রান্না করেছেন অবলীলায় বলে দিতে পারতাম। মার শেষ বয়সে টাঙ্গাইলের বাসায় বাবার সঙ্গে ছয়-সাত জন খেতে বসেছিলাম। মা তখন তেমন চলাফেরা করতে পারতেন না। আমরা সবাই তাকে রান্নাঘরে যেতে বারণ করেছিলাম। ইচ্ছেমতো চলাফেরা ছাড়া কোনো কাজ করায় নিষেধ ছিল। মা যে সব সময় নিষেধাজ্ঞা মানতেন, তা নয়। তবু আমরা সবাই নিষেধ করতাম, বাবা করতেন। এক দুপুরে খেতে বসেছিলাম। টেবিলে বেশ কয়েকটি ব্যঞ্জন ছিল। মাছ-মাংসসহ সাত-আটটি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকে আমি মাছ খাই, মাংস খাই না। তাই অনেক রকমের মাছ থাকে আমার খাবার সময়। হঠাৎই কি একটা তরকারি মুখে দিয়েই বাবা বললেন, ‘বজ্র এটা খেয়ে দেখ তো।’ ছোট ভাইয়ের বউ নীহার সেদিন রেঁধেছিল। তাকে অন্যেরা সাহায্য করেছে। সব এক রকম, একটা অন্য রকম। আজাদ, মুরাদ কেউ বলে বসল মা কথা শোনে না। নিশ্চয়ই এটা মা রান্না করেছে। বড় ভাই সেখানে ছিলেন না। তাই বাবার পর আমিই ছিলাম বড়। মা বললেন, আমি রান্নাঘরে যাইনি রে বজ্র। বললাম তাহলে সব তরকারি এক রকম আর এটা অন্য রকম হলো কী করে? মা তখন একেবারে অপরাধীর মতো বললেন, ‘আমি ওটাতে তেল-নুন মেখে দিয়েছি।’ এই ছিল আমার মায়ের রান্না। আমার আজও মনে পড়ে ’৬৯-এ জেলে গিয়েছি আমরা তিন-চার জন। আমি, আল মুজাহিদীর ছোট ভাই শামীম আল মামুন আর খোদাবক্স মোক্তারের ছেলে আনোয়ার বক্স। সন্ধ্যায় মা খাবার পাঠিয়ে ছিলেন। মাছ-মাংসসহ আলু ভর্তা। অমন সুস্বাদু আলু ভর্তা কখনো খাইনি। রুই মাছ, জিওল মাছ, মুরগির মাংসের মধ্যে জিওল মাছের তরকারি ছিল অসম্ভব সুস্বাদু। এমনি অনেক ঘটনা আছে মাকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুসহ আরও কয়েকজন সেই ’৬২ সালে আমাদের বাড়িতে খাবার খেয়ে বাসাইলে আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নির্বাচনে গিয়েছিলেন। আর সেই ’৬৯-এর গণ আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়ে টাঙ্গাইলের আশপাশে কোথাও গেলেই যেভাবেই হোক খবর পাঠাতেন মার হাতের রান্না খেতে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর ২৪ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধুর পায়ের সামনে কাদেরিয়া বাহিনীর সমস্ত অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন ওয়াপদা বিল্ডিং থেকে বঙ্গবন্ধু আমাদের বাড়ি যেতে চেয়েছিলেন। মাকে আগেই রেঁধে রাখতে বলেছিলেন। মা রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে রেখেছিলেন। অস্ত্র নেওয়ার সমস্ত অনুষ্ঠান শেষ করে ওয়াপদা ডাকবাংলোয় যেখানে আমি থাকতাম। সেই ডাকবাংলোয় গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিচে নামতে নামতে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি নিয়ে রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে ফোমিন এসেছিলেন। তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সার্কিট হাউসে যান। সেখানে রাষ্ট্রদূতকে পাশে বসিয়ে খাইয়েছিলেন। দু-তিন শ মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কয়েকজনকে নিয়ে মার রান্না খেয়েছিলেন। সঙ্গে এও বলেছিলেন, ‘কাদের-লতিফের মায়ের মতো তোমাদের ভাতও হয়নি। এমন রান্না খুব বেশি পাওয়া যাবে না।’ সেই মায়ের আজ মৃত্যুবার্ষিকী। কেমন যেন খালি খালি সুনসান। আমাদের নানাবাড়ি মির্জাপুরের বানিয়ারা। টাঙ্গাইল শহরে নানার প্রচুর জমিজমা ছিল। নানা খুব মিষ্টি খেতেন। কারও কারও দোকানে মিষ্টি খেতে খেতে দু-চার টাকা হলেই জমি লিখে দিতেন। এভাবে করতে করতে নানা দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। দেউলিয়া মানে যার শহরে দু-তিন শ একর জমি ছিল, সে মারা যাওয়ার সময় খুব বেশি হলে ২৫-৩০ ডিসিমাল জমির মালিক ছিলেন। তিন ছেলে তিন মেয়ে ওয়ারিশ। টুকরো টুকরো হতে হতে পাঁচ-ছয় ডিসিমালের বেশি কারও ভাগে জোটেনি। নানির বাড়ি ছিল কালিহাতী উপজেলার বাংড়া। তাদের রান্নাও অপূর্ব আলোচনা করার মতো। বাবা একসময় টাঙ্গাইলে থেকে পড়াশোনা করতেন। সে সময় নানার বাড়িতেও কিছুদিন ছিলেন। বিয়ের পর মা ছাতিহাটি গ্রামের বাড়ি চলে যান। কীভাবে যে অত বড় সংসার সামলেছিলেন জানি না। বাবা একজন নীতিমান মানুষ ছিলেন। তবে তাঁর মেজাজ ছিল ভীষণ কড়া। পান থেকে চুন খসলেই লঙ্কাকান্ড বাধিয়ে দিতেন। আমরা অনেক ভাইবোন। আমাদের দুই মা। একসময় পর্যন্ত অন্তত আমি বুঝিনি যে আমাদের দুই মা। কোনো দিন কোনো ঠুকাঠুকি ছিল না। আমরা তখন পাঁচ-ছয় জন দুনিয়ার আলোয় এসেছি। তার মধ্যে আমি ছিলাম সবচাইতে অচল। স্বাস্থ্যের দিক থেকে সবচাইতে দুর্বল। আমার বড় ভাই হিটলার আর বড় বোন বুড়ি তারপর মা-বাবার প্রথম সন্তান আরজু বা লতিফ সিদ্দিকী। আমার যখন ছয়-সাত বছর তখন বড় ভাই হিটলার মারা যান, বোন বুড়ি আমার জন্মের আগেই মারা যান। কী করে যেন আমার বড় ভাই হিটলার মারা যাওয়ার পর আমার হুপিংকাশি হয়। দিনরাত শ্বাসকষ্ট হতো। রাতের দিকেই কষ্টটা বেশি বৃদ্ধি পেত। মা মাথার কাছে বসে থাকতেন। হাতে-পায়ে চুন তেল মাখতেন আর জারজার হয়ে কাঁদতেন। অনেক রাতে মার চোখের পানি আমার কপালে পড়ত। ছোট মানুষ তাই খুব একটা বুঝতাম না। মা কাঁদতেন আর আল্লাহর কাছে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! বজ্রর কষ্ট বজ্রের অসুখ আমাকে দাও, ওকে ভালো করে দাও।’ যেমনটা মুঘল সম্রাট বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুনের জন্য করেছিলেন। সত্যিই দু-তিন বছর পর ধীরে ধীরে আমি ভালো হয়ে উঠেছিলাম আর মা শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানিতে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। বাবাকে আমরা খুবই কঠিন মানুষ হিসেবে জানতাম। কিন্তু ১৯৫৮-’৫৯ সালে বাবা মাকে নৌকা করে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। সমস্ত কাজকর্ম বাদ দিয়ে অনেক স্বামীই তার স্ত্রীকে নিয়ে দু-আড়াই মাস হাসপাতালে পড়ে থাকতেন না। যখন মা কুমুদিনী হাসপাতালে ছিলেন তখন সেই সকালে বাবা হাসপাতালে যেতেন সারা দিন সেখানে থাকতেন আর মাকে সাহায্য করতেন। আমি আর রহিমা নৌকায় থাকতাম। নৌকার পাশে খোলা মাঠে খেলাধুলা বা ছোটাছুটি করতাম এটা প্রায় প্রতিদিনই করতাম। একদিন হঠাৎ রহিমাকে দেখছি না। নৌকার দিকে তাকিয়ে দেখি ছোট্ট ছোট্ট দুটি পা নাড়াচাড়া করছে। ছুটে গিয়ে পা ধরে টেনে ওঠাবার চেষ্টা করি। কিন্তু পেরে উঠছিলাম না। চিৎকার করায় সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ছুটে এসে এক ঝটকায় রহিমাকে তুলে ফেলে। আর ৩০-৪০ সেকেন্ড পানির নিচে থাকলে হয়তো রহিমা বাঁচত না। আল্লাহর দয়ায় সেবার ওকে ফিরে পেয়েছিলাম। হাঁপানি রোগ খুব একটা ভালো হওয়ার নয়। ৫০-৬০-এর দশকে আরও ছিল না। তবু হাসপাতালে থেকে অনেকদিন পানি হাতাহাতি না করায় মা কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। মার সারা জীবনের ওষুধ ছিল বেটমিসল আর এন্থালিন। মনে হয় বেটমিসল শ্বাসকষ্টের আর এন্থালিন শরীর থেকে পানি কমাবার জন্য। এ দুই ওষুধ মা প্রায় ৫০ বছর খেয়েছেন। এ দুটো ওষুধে তিনি একটু সুস্থবোধ করতেন। কিন্তু এর জন্য কিছুটা পাশর্^প্রতিক্রিয়াও হতো। শরীরের নানা জায়গায় চাকা চাকা দাগ পড়ত। কখনো আবার মিলিয়ে যেত। মার সৌন্দর্য মার কর্মক্ষমতা সবকিছুই দুরারোগ্য হাঁপানি রোগে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবু তিনি দমবার পাত্রী ছিলেন না। আমাদের একপাল সন্তানকে তিনি মানুষ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর কী যে কষ্ট করেছেন তা বলার মতো না। স্বাধীনতাযুদ্ধে টাঙ্গাইলে হানাদাররা তিনটি বাড়ি ধ্বংস করেছিল। তার একটি বদিউজ্জামান খান এমপি, অন্যটি আসাদুজ্জামান খান তৎকালীন জয়েন সেক্রেটারি আর লতিফ সিদ্দিকী এমপির বাড়ি। গৃহহারা অবস্থায় প্রথমে গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটি, তারপর সেখান থেকে ধানগড়া নাদু ভাই, সিরাজ, হামিদদের বাড়ি। কিছুদিন পর সেখান থেকে আরও গভীর জঙ্গলে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সুরীরচালা খামারবাড়িতে কাটিয়েছিলেন। কোনো দিন খেয়ে কোনো দিন না খেয়ে থেকেছেন। তার পরও মুরগির বাচ্চার মতো আমাদের সবকটি ভাইবোনকে আগলে রেখেছেন। সেই অবস্থায়ও বাবার যাতে কোনো কষ্ট না হয়, খেতে-পরতে কোনো অসুবিধা না হয় তার ষোলো আনা দেখাশোনা করতেন। ১৬ আগস্ট ধলাপাড়ার মাকরাই যুদ্ধে হাতে পায়ে গুলি লাগলে আমার পরিবার দুই ভাগ করে ফেলা হয়। এক ভাগ ঢাকায়, আরেক ভাগ আমি নিয়ে চলি আসামের মানকার চরে। মা ও ভাইবোনদের ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল ডা. শাহজাদা চৌধুরী, ড. নুরুন্নবী ও বেহুলা লখিন্দরের আবুল কাশেম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে সবাই বেঁচেছিলেন। স্বাধীন দেশে আমরা বিজয়ের হাসি হেসেছিলাম। সে স্বস্তি এবং শান্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশের পিতা বঙ্গবন্ধু উচ্ছৃঙ্খল কয়েকজন সেনার হাতে নির্মমভাবে নিহত হলে তার প্রতিবাদে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম। সেখানেও মা তার আন্ডাবাচ্চা নিয়ে দারুণ কষ্ট করে আগরতলা পৌঁছেছিলেন। স্বামী, সন্তান-সন্ততি নিয়ে আগরতলা পৌঁছা খুব একটা ছেলেখেলা ছিল না।

প্রথম শিলিগুড়ির হাকিমপাড়া, পরে বর্ধমানের সদরঘাট রোডে বসবাস করেছি। ১৯৮২-৮৩ সালে দু-তিনবার দেশে আসেন। আবার বর্ধমানে যান। এরপর ’৯০ এ আমি দেশে ফিরে আসি। তখন মা-ই ছিল আমাদের সবার আশ্রয়। মাকে ঘিরেই আমাদের সকাল-বিকাল, মাকে ঘিরেই রাতদিন। সেই মা ২০০৪ সালে অনেকদিন বাবর রোডে ছিলেন। মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘বজ্র, আমার বড় বেশি টাঙ্গাইল যেতে ইচ্ছে করে। স্বামীর ঘরে যেতে চাই।’ আমরা মাকে টাঙ্গাইল নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আর দু-চার দিনের মধ্যেই নিয়ে যেতাম। মাকে টাঙ্গাইল নিয়ে গেলে আমার স্ত্রীর সেখানে থাকতেই হবে। তাই দু-এক দিন দেরি হচ্ছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন মার শরীর খারাপ হয়ে যায়। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ডা. নাজির আহমেদ রঞ্জুকে ডেকে আনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে রঞ্জু কাদেরিয়া বাহিনীতে ছিল। খুবই ছোট ছিল। কিন্তু দুর্দান্ত সাহসের সঙ্গে ছিল। রঞ্জু আমাদের সব কাজে শরিক হয়েছে। মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। সেখানে তিন-চার দিন ছিলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। তিন-চার দিন পর আজকের দিনে মা চলে যান। তাকে ৪ এপ্রিল বাদ আসর কালিহাতী উপজেলার ছাতিহাটি আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। মার দাফন কাফন করে সবাই চলে এসেছিল। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। আমি সেখানেই পড়ে ছিলাম। আজ তাঁর মৃত্যুদিন। বড় বেশি বুকে বাজে। মায়ের মতো শ্রেষ্ঠ সম্পদ সন্তানের জন্য আর কিছু নেই। প্রিয় পাঠক, দোয়া করবেন আমার মায়ের জন্য; পরম দয়ালু আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর