মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যার ছড়াছড়ি

তপন কুমার ঘোষ

সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যার ছড়াছড়ি

অধুনা সবার হাতে  সেলফোন। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করে নিয়ে যাওয়া যায় বলে ‘মোবাইল ফোন’ নামে এটা বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা যায় বলে অনেকে এ যন্ত্রটাকে মুঠোফোনও বলেন। ইন্টারনেটভিত্তিক স্মার্টফোন ছাড়া জীবন যেন অচল! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ‘ফেসবুক’ ও ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ খুবই জনপ্রিয়। প্রযুক্তির হাজারো ভালো দিক রয়েছে, যা এক মুখে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আগুন, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট- এ তিনটি যুগান্তকারী আবিষ্কার মানবসভ্যতার প্রসারে ব্যাপক অবদান রেখেছে। মুঠোফোন ও ইন্টারনেটের বদৌলতে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বিশ্বের এক প্রান্তে যা ঘটছে মুহূর্তে তা দেখা যাচ্ছে অন্য প্রান্তে। দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা বা ভাষা কোনো বাধা নয়। সবজান্তা ‘গুগল’ মুহূর্তের মধ্যে বার্তা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তর বা অনুবাদ করে দিচ্ছে। গোটা বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ; যেন একটাই গ্রাম! আবার গণমাধ্যমকে রীতিমতো টেক্কা দিচ্ছে সামাজিক মাধ্যম। পত্রিকাগুলো প্রিন্ট ভার্সনের পাশাপাশি অনলাইন ভার্সনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ছোটকালে আমার স্কুলশিক্ষক বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’। এখন আমরা ‘প্রযুক্তির দাস’।

সময় কাটানোর একটা সুন্দর মাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন অনেকে। ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে কেটে যায় অনেকটা সময়। ফেসবুকে আমরা অন্যকে জ্ঞান দিতে সদা ব্যস্ত। সবাই যেন সবজান্তা! সেলফোন-আসক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে মানুষে মানুষে স্বাভাবিক সম্পর্ক। এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও এখন কথাবার্তা কম হয়। ঘরে ফিরে যে-যার মতো ঘাড় গুঁজে মোবাইল ফোন ঘাঁটতে থাকেন। ক্রমেই ‘পারসোনাল’ ও ‘পাবলিকে’র সীমারেখা ঘুচে যাচ্ছে। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ফেসবুকে পাবলিক পোস্ট দেওয়া হয়। একটিবারও ভেবে দেখা হয় না, একজন মানুষের ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি বিষয়ে অন্য মানুষের আগ্রহ কতটুকু। সেলিব্রেটি হলে অন্য কথা। বন্ধু তালিকায় পরিচিত বন্ধুই বা কজন? সেলফোন-আসক্তি নিয়ে সমাজবিদরা বারবার সতর্ক করছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। হুঁশ ফিরছে না কিছুতেই।

ফেসবুকে হামেশাই বাজে মন্তব্য করা হয়। এতটাই কদর্য ভাষা ব্যবহার করা হয় যে, তা প্রকাশের অযোগ্য। কুরুচিপূর্ণ ভাষা ও ভুল বানানের ছড়াছড়ি দেখে বোঝাই যায় মন্তব্যকারীর রুচি ও বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় কত দূর। সেলিব্রেটিরা পড়েছেন বেকায়দায়। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও ট্রোলড হওয়ার আতঙ্কে থাকেন। রসিকতা কখনো কখনো শালীনতার সীমা অতিক্রম করে ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। নারীরা এখন নিন্দুকদের সহজ টার্গেট। কথায় কথায় কটাক্ষ করা হয়। ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে ভুক্তভোগী কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন, যা খুবই দুঃখজনক। আজ থেকে ৫০ বছর আগে মোবাইল ফোন আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার। কুপারের বয়স এখন ৯৪ বছর। এখন এই যন্ত্রের প্রতি মানুষের মোহ দেখে রীতিমতো ক্ষুব্ধ তিনি। তাঁর কথায়, মানুষ একটু বেশি মাত্রায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সারাক্ষণ তাকিয়ে মোবাইলের দিকে। শৌখিন কুপার নিজে ব্যবহার করেন আইফোনের নবতম সংস্করণ। তবে তিনি অকপটে স্বীকার করেন, ফোন তিনি বেশিটাই ব্যবহার করেন কথা বলার জন্য। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের অফিসে বসে একটি সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

মানুষ গল্প ভালোবাসে। সত্য ঘটনার চেয়ে সাজানো গল্প নাকি মানুষকে বেশি টানে। শিশুকালে মায়ের মুখে রূপকথা শুনে বড় হয়েছি আমরা। এখনো রূপকথা শোনানো হয়। মনগড়া গল্প বিশ্বাস করেন অনেকেই। যেমন এ যুগেও অনেকের বিশ্বাস ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া, তাবিজ-কবজে। নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে বানোয়াট গল্পের যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তো আর কথাই নেই।

‘যা রটে তার কিছুটা বটে’- এমন ধারণা অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল। এরা যুক্তিতর্কের ধার ধারেন না। তথ্যের উৎস ও উৎসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কোনো ভাবনাচিন্তা বা যাচাইবাছাই না করেই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন, অন্যের পোস্ট শেয়ার করছেন বা কমেন্ট করছেন। অনেক ক্ষেত্রে অন্ধবিশ্বাস বা অন্ধ আনুগত্য কাজ করে। একশ্রেণির মানুষের এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে মতলববাজরা।

সামাজিক মাধ্যম বা নিউ মিডিয়ায় মিথ্যার ছড়াছড়ি; যা কখনো কখনো ভাইরাল হয়ে যায়। মূলধারার দু-একটি সংবাদপত্রেও মাঝেমধ্যে অসত্য বা ভুয়া খবর ছাপানো হয়। ‘মিথ্যা বারবার বললে তা সত্য হয়ে যায়।’ এটা গোয়েবলসীয় থিওরি বা তত্ত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হিটলারের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন গোয়েবলস। তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে এ তত্ত্ব অচল হলেও কিছু লোক এ তত্ত্বে এখনো বিশ্বাস করে। তাদের ধারণা, দশ চক্রে ভগবানও ভূত হয়! মিথ্যা খবরের ভিড়ে অনেক ক্ষেত্রেই চাপা পড়ছে সত্য। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু কিছুসংখ্যক মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্ত করা গেলেও দিন শেষে কিন্তু সত্যটা বেরিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি আমাদের সহায় হয়েছে।

সামাজিক মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা ছড়িয়ে দেওয়ার এ প্রবণতা সমাজ ও দেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক। এটা আগুন নিয়ে খেলা করার শামিল। এটা রোধ করতে না পারলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা অনিবার্য। কক্সবাজারের রামু ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা এর জলজ্যান্ত উদাহরণ।

সামনে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে ও অপপ্রচার চালিয়ে ফায়দা লোটার অপচেষ্টা চালাতে পারে স্বার্থান্বেষী মহল। এ ব্যাপারে এখন থেকেই সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। দায়িত্ববানরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দিলে সামনে ঘোর বিপদ।

 

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

সর্বশেষ খবর