একাত্তরের ১১ এপ্রিল ছিল গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, পাশবিকতা, লুট, ধর্ষণ, যুদ্ধ আর নারকীয়তার বিপরীতে বাঙালি জাতির জাগরণের, উত্তরণের, প্রতিরোধের, প্রতিশোধের, শত্র“হননের এক রক্ত-বারুদে মাখা দিন। দখলদার পাক হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে এক দিন আগে ১০ এপ্রিল বাঙালি বংশোদ্ভূত পাকিস্তানবাদীদের সমন্বয়ে ‘শান্তি কমিটি’ নামক গেস্টাপো বাহিনী গঠন করে। তাদের সহায়তায় পাকিস্তানিরা দেশব্যাপী ধরপাকড়, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ড সংঘটনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর এই ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়া সীমান্তে গঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং তার প্রথম সরকার। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী এমএনএ ও এমপিএদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে। এ বৈঠকে রাষ্ট্র ও সরকার গঠন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করা হয়। বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং এর নেতৃত্বে নয়া রাষ্ট্রকে শত্র“মুক্ত করতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংবাদ প্রচারিত হয়। বিশ্ববাসী সেদিন জেনে যায়, ‘যুদ্ধ ক্ষেত্রাস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালি জাতি জন্ম নিল।’ আর এর এক দিন পর ১১ এপ্রিল জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এ ভাষণটি আকাশবাণী প্রচার করেছিল, স্বাধীন বাংলা বেতারের বরাত দিয়ে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ভাষণের অনুলিপি সাংবাদিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। আর এ ১১ এপ্রিল ঢাকায় দখলদার পাকবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার পদে দায়িত্ব নেন খুনি জেনারেল নিয়াজি। আর ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকবাহিনী তার নেতৃত্বে।
বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত সেদিন জেনেছিল বাংলাদেশ নামক এক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের কথা। বিশ শতকে ঘোষণা দিয়ে স্বাধীন হওয়া দেশটিতে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমর্থনে সরকার গঠিত হয়। যে সরকারের রাষ্ট্রপতি হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি তাঁর দেশবাসীকে হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে গ্রেফতারের আগে স্বাধীনতার ঘোষণা জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য তিনজনকে মন্ত্রী করে গঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ১০ এপ্রিল গঠিত এ সরকার ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিক শপথ নেয় বলে ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিতি পায়।
একাত্তরের ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় রামগড় সীমান্তে অবস্থিত এবং শর্টওয়েভে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (দ্বিতীয় পর্যায়) থেকে প্রচারিত পূর্ব রেকর্ড করা ভাষণটি ছিল বাংলায়। প্রথম সরকারের প্রথম ক্যাবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম সেদিনের ভাষণের উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে সকলকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে কেন দেশকে শত্র“মুক্ত করার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো তার আনুপূর্ব বর্ণনা দেন। কোন কোন সেক্টরে কার অধীনে যুদ্ধ চলছে তার বিবরণও তুলে ধরেন তিনি। তাঁর সুদীর্ঘ ভাষণে বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি দস্যুদের গণহত্যার উল্লেখ করে তিনি পৃথিবীর সব দেশের কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান। যুদ্ধের সময় শত্র“কে সহযোগিতা না করার আহ্বান জানিয়ে সম্মিলিত মনোবল ও অসীম শক্তি নিয়ে দেশবাসীকে যুদ্ধে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিতে নির্দেশ দেন।’ এ ভাষণে বাঙালি জাতির প্রথম সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার পথ ও প্রক্রিয়া নির্দেশিত ছিল। ১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত বধ্যভূমিতে পাক হানাদারদের গুলিতে শহীদ হওয়ার আগে যে যুবকটি শেষ আর্তনাদ উচ্চারণ করেছিল ‘জয় বাংলা’- সেই রণধ্বনিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণের মধ্য দিয়ে। সে এক সময় ছিল। জীবনমরণ আশা-নিরাশার দোলাচলে এক কঠিন কঠোর ক্রান্তিকালের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি তার সহস্র বছরের ঘুম শেষে সটান জেগে উঠেছিল। প্রবল প্রতাপে রক্ত আর জীবন দান করার সেই এক কালজয়ী, দুঃখজয়ী সময় এসেছিল ৫৫ হাজার বর্গমাইলের বদ্বীপ অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনে। তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল অসম এক যুদ্ধ। অদম্য সাহস আর মনোবল নিয়ে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ সেদিন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আর এর মধ্য দিয়ে গঠিত হয় এই প্রথম বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র, স্বাধীন দেশ। একাত্তরে নতুন এক বাঙালি জাতি জন্ম নেয়। আর এ জন্ম এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমেই ঘটে। বিশ শতকে বাঙালিই একমাত্র জাতি যে ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে বাংলার জনগণ বিপুল ভোটে ছয় দফার পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে। বাংলায় প্রতিদ্বন্দ্বী দল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের সমস্ত প্রার্থীর পরাজয় ঘটে। ৯০ ভাগ জামানত হারায়। নির্বাচনের পর শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের নামে শুরু হয় পাকিস্তানি সামরিক চক্র ও তাদের দোসরদের নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে তা স্থগিত করায় একাত্তরের মার্চের ১ তারিখেই বাঙালি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঢেউ জাগে। বাঙালি জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। আর সেই ১ মার্চ থেকে বাংলাদেশ কার্যত পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন সত্তার আকার ধারণ করে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দিকনির্দেশনাপূর্ণ ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। বাঙালি জাতি কঠিন সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে শুরু করে ৭ মার্চ থেকে। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ও দেশকে শত্র“মুক্ত করার আহ্বান জানান। তার এ নির্দেশ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা তথাকথিত সামরিক আদালতে বিচারের নামে প্রহসন করেছিল।প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম ভাষণে জাতিকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, ‘আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস; কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে।’ বাংলাদেশে গণহত্যা ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার নিন্দায় তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দূরদর্শী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে স্থির বিশ্বাসের পাশাপাশি আশঙ্কাও করেছিলেন, যা বাস্তব হয়েছিল। বলেছিলেন, ‘আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেওয়ার আগেই শত্র“রা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে।’ সেজন্য এপ্রিলের ১১ তারিখে জনগণকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে বলেছিলেন, ‘পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।’
তাজউদ্দীন আহমদ ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক পাকবাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর তিনি সীমান্ত পাড়ি দেন। একাত্তরের ১ এপ্রিল গভীর রাতে তিনি নয়াদিল্লি পৌঁছেন। ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এবং পরে ইন্দিরার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কাছে অস্ত্রসহ সাহায্য কামনা করেন। সেই সঙ্গে পাকবাহিনীর নির্যাতনে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, আশ্রয় সহায়তাও চেয়েছেন। বৈঠকে তাজউদ্দীন উপলব্ধি করেন দ্রুত সরকার গঠন করা হলে সরকারিভাবেই সাহায্য-সহায়তা মিলবে ভারতসহ বিশ্ববাসীর কাছ থেকে। ৫ এপ্রিল দিল্লিতে বসে প্রফেসর রেহমান সোবহান ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সহায়তায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক বিবৃতি ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করেন। এর বাংলা ও ইংরেজি ‘ভার্সন’ তৈরির কাজটিও একই সঙ্গে করা হয়। ৮ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে সরকার গঠন সম্পর্কিত তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি রেকর্ড করা হয়। যা আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১০ এপ্রিল প্রচার করা হয়। সে সুবাদে বিশ্বের অন্যান্য গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। সরকার গঠনের ঘোষণার পর তাজউদ্দীনের ভাষণটি ওই দিন রেকর্ড করা হয়। যা ১১ এপ্রিল প্রচারিত হয়।
স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, গুরুত্বপূর্ণ এই ভাষণ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিশ্লেষিত হয়ে জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়নি বলে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আজও তৈরি করা হচ্ছে; যা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের গঠন ও তার সনদপত্র এবং সংবিধানকে অবমাননা শুধু নয়, একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধকে হেয় প্রতিপন্ন করে স্বাধীনতার শত্র“দের মনোবাঞ্ছাকে সামনে আনা। তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিলের ভাষণেই বলেছেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’ এ ভাষণের আগের দিন গণপরিষদের বৈঠকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অনুসমর্থন দান করেন গণপরিষদের সদস্যরা। সেই ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।’ পরিষদের সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।’ বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন তাই জেনে এসেছে। কারণ জনগণ দীর্ঘ নয় মাস অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ গণহত্যার শিকার হয়েছে। আর তা সহ্য করেছে বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বানে, যা তিনি ৭ মার্চের পর ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। এবং তা করেন জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচনে বিজয়ী দলের প্রধান এবং যার হাতে দেশের ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কারণ স্বাধীনতার ঘোষণার বৈধ অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই ছিল। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার যে ঘোষণা পাঠ করেন, তা বঙ্গবন্ধুর নামেই করেছিলেন। আর ২৬ মার্চের ১৫ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণার আনুষ্ঠানিক বৈধতা দিয়েছিলেন গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা। এ বৈধতা কেবল তাদেরই ছিল জনগণের পক্ষ থেকে।
সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাংলাদেশের সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে শামিল হতে এবং স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ঐতিহাসিক প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে চিরাচরিত রাজনৈতিক গণ্ডির ঊর্ধ্বে রাখার জন্য আহ্বান ও আবেদন দুটোই জানান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। তবে তিনি সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত এবং গণহত্যার পর পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশকারীদের তার ভাষণে সতর্ক করে দেন, ‘হানাদার শত্র“বাহিনীর সাথে কোনো প্রকার সহযোগিতা করা বা সংস্রব রাখা চলবে না। বাংলাদেশে আজ কোনো মিরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্র“সেনার ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গোর থেকে গাত্রোত্থান করতে চায়, যাদের গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা যদি এ সুযোগে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তারা সাড়ে ৭ কোটি বাংলাদেশবাসীর রোষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে।’ (চলবে)