শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা মঙ্গলবার্তা দেয়

আফরোজা পারভীন

নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা মঙ্গলবার্তা দেয়

মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করতে আইনি নোটিস দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। নোটিসটি তিনি তিনটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও চারুকলা ইনস্টিটিউটের ডিন বরাবরে প্রেরণ করেছেন। তিনি করতেই পারেন। আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার দেশের জনগণের আছে।  এ অধিকার সংবিধান তাদের দিয়েছে। শোভাযাত্রা বন্ধ না করলে হাই কোর্টে রিট করবেন বলেও নোটিসে উল্লেখ করেছিলেন আইনজীবী। রিট করেও ছিলেন। এ অধিকারও তার আছে।

নোটিসে তিনি যা উল্লেখ করেছেন তার সারবত্তা হলো, বাংলা নববর্ষ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালি একাত্ম হয়ে পালন করে।  এখানে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট, বেআইনি ও অসাংবিধানিক বিষয় জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই শোভাযাত্রায় পশুপাখি প্রাণীজুড়ে দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয় এবং সেটা পালিত হয়ে আসছে। তখন মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে কিছু ছিল না। তিনি ধর্মানুভূতিতে আঘাত সম্পর্কিত সংবিধান ও দন্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাও উল্লেখ করেছেন।

মঙ্গল শব্দটিকে শুভ বা শান্তির প্রতীক হিসেবে আমরা জানি। এ শব্দের সঙ্গে হিন্দু মুসলিম কারও কোনো বিরোধ নেই। হিন্দু যেমন বলেন, ‘মঙ্গল কামনা করি’, ‘মুসলিমও বলেন মঙ্গল কামনা করি’। এটি শুভকামনা করার জন্য সর্বজনীনভাবে ব্যবহৃত একটা শব্দ। নববর্ষের প্রথম দিন মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় এই প্রত্যাশায় যাতে সারা বছর সর্বমঙ্গল হয়। আরও একটা কথা, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ যেমন স্রষ্টার সৃষ্টি, তেমনি পশুপাখি নানান প্রাণীও স্রষ্টারই সৃষ্টি। স্রষ্টার সৃষ্টিকে আমরা অস্বীকার করব কী করে!

বাংলা সন গণনার আদিতে মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না এটা সত্যি। কিন্তু আদিতে তো কত কিছুই ছিল না। সময় যেমন নিয়ত পরিবর্তনশীল, মানুষের চাওয়া, রুচি, আকাক্সক্ষাও পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতা থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎপত্তি। প্রথমে শুরু হয়েছিল যশোরে। তারপর ঢাকার চারুকলা এটি শুরু করে। তখন অবশ্য নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। এখন সারা দেশ এ দিনটি এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য মুখিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে এ শোভাযাত্রা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছে।

রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানও তো আদিতে ছিল না। এটারও সৃষ্টি হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। পান্তা-ইলিশও ছিল না। বাঙালির প্রিয় ইলিশ তাদের ভালো লাগা থেকেই যুক্ত হয়েছে পয়লা বৈশাখে। আর গ্রামীণ সংস্কৃতিকে বজায় রাখার জন্য এসেছে পান্তা। অবশ্য সরকার এখন পান্তা ইলিশ নিরুৎসাহিত করছে। কারণ এ সময়টা জাটকা ইলিশের বড় হওয়ার। ইলিশ সম্পদ রক্ষায় সরকারের এই নিরুৎসাহিতকরণ।

রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান ও মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু ছিল এক ধরনের প্রতীকী প্রতিবাদও। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত নিপীড়িত জনগণ পশ্চিমা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছিল বাঙালি সংস্কৃতির উদ্বোধনের মাধ্যমে। আর স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। এগুলো সংস্কৃতির মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবাদ।

একইভাবে আগে অনেক কিছু ছিল যা এখন নেই। ছেলেবেলায় সারা বছর আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম হালখাতা আর বৈশাখী মেলার জন্য। চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে ব্যবসায়ীদের সমস্ত দেনা শোধ করার রেওয়াজ ছিল। বৈশাখের প্রথম দিন নতুন একটা খাতা খুলে ব্যবসায়ীরা খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করাতেন। সেই মিষ্টি খেয়ে কেউ পয়সা দিত, কেউ দিত না। তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের কোনো আক্ষেপ ছিল না। সেদিন সব দোকান সুন্দর করে সাজানো হতো। এই সাজানোর কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হতো কলাপাতা। এখন যদি আমরা বলি কলাপাতা হিন্দুদের কাজে লাগে, ওদের বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ কলাপাতা আমপাতা, বেলপাতা, ধান, দূর্বা তাহলে তো এগুলোকেও জীবন থেকে বাদ দিতে হয়। হিন্দু বধূবরণে কলার ছড়া, নানারকম ফল, প্রদীপ, কুলো ব্যবহার করা হয়। তাহলে এগুলোও মুসলমানের জীবন থেকে বাদ দিতে হয়। বাদ দিতে হয় দই খই পান আগুন, মুড়ি, মুড়কি, নাড়ুসহ আরও অনেক কিছু। হিন্দুদের জীবন থেকেও বাদ দিতে হয় সেসব জিনিস যা মুসলমানরা ব্যবহার করে। তাহলে আর সম্প্রীতি রইল কোথায়?

এখন তো দেশ থেকে ধার দেওয়ার, নেওয়ার সংস্কৃতি উঠেই গেছে। জানি না প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো হালখাতা প্রচলিত আছে কি না। শুনেছি পুরান ঢাকার কতিপয় স্বর্ণকার এখনো হালখাতা করেন। জেনে ভালো লাগে। মনে পড়ে আব্বার পাঞ্জাবির কোনা ধরে হালখাতা খেতে যাওয়ার আনন্দ! হালখাতার জন্য প্রাণ কাঁদে! অতীতে হালখাতার মতো বৈশাখী মেলাও ছিল বড়ই আনন্দের! মেলার অপেক্ষায় পয়সা জমাতাম আমরা। বৈশাখের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে কয়েক দিন চলত এই মেলা। মেলায় পাওয়া যেত নানারকম কারুপণ্য, মাটির জিনিস, নানা রকম পুতুল, আম, জাম, পাখা, চরকা, কাঁপুনে বুড়ো আরও কত কি। টাটকা পাপড়ের গন্ধে মম করত চারদিক। বিক্রি হতো কদমা, গজা, মুড়কি, হাওয়াই মিঠাই। কোনো কোনো মেলায় সার্কাস, যাত্রা, পুতুল নাচও হতো। সার্কাস, পুতুল নাচ, চরকা ঘুরানো ছিল আমাদের ভীষণ প্রিয়। যাত্রা দেখত মা-চাচিরা। নাগরদোলায় চড়ায় ছিল প্রচ- শিহরণ! কতদিন মেলা থেকে ফিরতে কালবৈশাখী ঝড়ে পড়েছি। আজ সে মেলার সংস্কৃতি চলে গেছে। এখনো মেলা হয় কিছু। কিন্তু সেগুলো নাগরিক মেলা। সেখানে প্রাণের স্পর্শ তেমন নেই।

এ অবস্থায় নববর্ষের প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রার রঙ রূপ বৈচিত্র্য ছেলে বুড়ো সবাইকে টানে। তাই ঢাকার বিভিন্ন কোনা থেকে শোভাযাত্রা দেখতে হাজির হয় অসংখ্য মানুষ। তারা স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে শোভাযাত্রা উপভোগ করে। বিদেশ থেকেও আসে অনেক মানুষ। আবহমান বাংলার রুচি সংস্কৃতি কৃষ্টিকে তুলে ধরার চেষ্টায় নেওয়া হয় এই শোভাযাত্রা। বাংলার পশুপাখি মাছ ফুল ফল পাখির প্রতীক যেমন এই শোভাযাত্রায় সংযোজিত হয় তেমনই সময়ের প্রয়োজনে সংযোজিত হয় ভিন্ন কিছু। যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচারের চূড়ান্ত সময় সংযোজিত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের মুখোশ। রাস্তাজুড়ে আঁকা হয় আলপনা। সঙ্গে থাকে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, গানবাজনা আর নানান পোশাকে সজ্জিত নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ।

সপ্তাহের সাত দিনের একদিন মঙ্গলবার। এটা নিয়েই বা কি করব আমরা। এই বারটাও তো পাল্টে অন্য কোনো নাম রাখা দরকার। গ্রিক পুরাণে Ares নামে একজন দেবতা আছেন। রোমান ভাষায় তাকে বলা হয় Mars| Mars মানে মঙ্গলগ্রহ। স্যাক্সনদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তাদের দেবতা Tiu । সেখান থেইে ইংরেজি Tuesday মঙ্গলবারের উৎপত্তি। দেব-দেবী, গ্রহ নক্ষত্রের নাম থেকে আসা এই নাম। হিন্দুরা দেব-দেবী, গ্রহ-নক্ষত্র, কাল তিথি বেশি মানে। এই নামও তো তাহলে রাখা ঠিক নয়।

বাংলাদেশে বহু বছর ধরে চলে আসছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পশ্চিমবাংলায় কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুনছি এবারও নাকি কলকাতায় হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রার আয়োজকরা আবার ভিন্ন এক দাবিতে সোচ্চার। তারা বলছেন, সম্রাট আকবর নয়, গৌড়ের রাজা শশাঙ্কর আমল থেকে শুরু হয়েছে বাংলা সন গণনা। এ বিষয়ে অনেক দিন ধরে তারা প্রচারণাও চালাচ্ছেন। তাদের মঙ্গল শোভাযাত্রার আঙ্গিক ভিন্ন। তারা সাপ মাছ পেঁচা বাদুড়ের প্রতীক বাদ দিচ্ছেন। ঢোল, খোল, করতাল, কবিতা, কীর্তন-পটের গান, গৌড়ীয় নৃত্য দিয়ে তারা সাজিয়েছেন শোভাযাত্রার ধরন। তারা একটা হিন্দুয়ানী চিত্র আনার চেষ্টা করছেন তাদের মঙ্গল শোভাযাত্রায়। ইচ্ছা করেই তারা ঢাকায় ব্যবহৃত প্রতীকগুলো বাদ দিয়েছেন। অবশ্য এটার বিরোধী লোকজনও আছেন। তারা মনে করেন মঙ্গল শোভাযাত্রা হওয়া উচিত সর্বজনীন। এই শোভাযাত্রায় কোনো সাম্প্রদায়িক চিত্র উপস্থাপিত হওয়া ঠিক না। তারা এটাও বলছেন, ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রা তার অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য বারবার মৌলবাদীদের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। আর এই অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের জন্যই ঢাকায় ব্যবহার করা হয় সাপ পেঁচা বাদুড়ের প্রতীক। শোভাযাত্রায় সাম্প্রদায়িক চিত্র আনলে সেটার নাম আর যাই-ই হোক, মঙ্গল শোভাযাত্রা হতে পারে না।

আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি নববর্ষে রমনার বটমূলে বোমা হামলার কথা! ভুলে যাইনি রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেওয়ার প্রচেষ্টার কথা! ভুলে যাইনি আমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে পরাভূত করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কথা!

সারা বছর ধরে বছরের প্রথম দিনটির জন্য মানুষের প্রত্যাশা থাকে। দিনটিকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের পোশাক বানায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাধ্যমতো নতুন পোশাক পরে। মেয়েরা খোঁপায় গোঁজে বেলিফুলের মালা। লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে এক একজন হয়ে ওঠে অনন্যা। তাদের সঙ্গে মিলিয়ে লাল পাঞ্জাবি পরে পুরুষরা। উৎসবে মেতে ওঠে গোটা দেশ। গৃহকর্মীরা ছুটি চায় এই দিনটি উদযাপন করার জন্য।  এটা বাঙালির জীবনে এক বিশেষ উৎসব, যার নেই কোনো ধর্মীয় চরিত্র। সরকার এই উৎসব উপলক্ষে বৈশাখী ভাতাও চালু করেছে।

এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গটি নিয়ে এবার সবাই চিন্তিত। মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে কি হবে না এটা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।  হলে তার ফল কী হবে এটাও সবাইকে ভাবাচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অন্তর্ভুক্ত করে নববর্ষ পালনের অনুমতি দিয়েছে। সবাই অপেক্ষায় আছে নববর্ষের মঙ্গল সকালের।

                লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্মসচিব

সর্বশেষ খবর