শনিবার, ২০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাছ চাষে বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক খাতের পরিবর্তে কৃষি খাতের দাবি

শাইখ সিরাজ

মাছ চাষে বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক খাতের পরিবর্তে কৃষি খাতের দাবি

আমার কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠানে এ বছরের শেষ ও চতুর্থ আয়োজন ছিল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। বিশ্বে মাছ উৎপাদনে শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহ জেলার অবদান সবচেয়ে বেশি। জেলায় বছরে প্রায় ৪ লাখ টন মাছ উৎপাদন হয়। এ ছাড়াও কৃষি খাতে ময়মনসিংহ বিভাগের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ।  নতুন বিভাগ হিসেবে কৃষি খাত নিয়ে এ অঞ্চলের কৃষকদের ভাবনাটা কী? এবারের বাজেটে তাদের প্রত্যাশার জায়গাটি বোঝার জন্য এ জেলায় আয়োজন করা হয় এবারের একটি পর্বের। এ আয়োজনে প্রায় ৩ হাজার কৃষকের উপস্থিতি ছিল। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। এ ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের সূচনায় মতামত জানতে চাওয়া হয়, ভর্তুকি মূল্যে সার কিনতে পারছেন কি না? উপস্থিত ৮০ ভাগ কৃষক জানালেন কিনতে পাচ্ছেন। তবে কৃষকরা নানা বিষয় নিয়ে তাদের মতামত ও দাবির কথা উল্লেখ করেন। তাদের মতামত ও দাবিসমূহ নিম্নরূপ :

* সরকার সেচে ভর্তুকি দেয় কিন্তু আমরা কৃষক সেই ভর্তুকি পাচ্ছি না। ভর্তুকি পায় সেচ পাম্পের মালিক।

* এই এলাকায় বহু জমি পতিত রয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী চান এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। আমরা সেচের কারণে পতিত জমিগুলো আবাদ করতে পারছি না। এখানে একটা গভীর নলকূপ ছিল, যা দিয়ে আমরা সেচ দিতাম। কিন্তু কিছু লোক অপরিকল্পিত পুকুর খনন করে পানি আসা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আমরা আর আবাদ করতে পারছি না।

* ডিপ-টিউবওয়েলের ভাড়া একেক জায়গায় একেক রকম। অথচ সরকার তো নির্ধারণ করেছে একই রকম। তাহলে কেউ নেয় ৩০ টাকা আবার কেউ নেয় ৬০ টাকা; কেন?

* সরকার সারে এত টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে কিন্তু কৃষক অতিরিক্ত সার ব্যবহার করার কারণে এই খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সুষম সার ব্যবহার করা গেলে সরকারের খরচ কমে আসত। তাহলে সরকারের কি একটা গাইডলাইন থাকা দরকার না, যে কীভাবে সুষম সার ব্যবহার করতে হবে?

* জামালপুরের ইসলামপুরের মুন্নিয়া চরে পর্যাপ্ত সার যায় না। স্থানীয় ডিলার না থাকায় এই সংকট হচ্ছে। ফলে ফসলের চাষাবাদে আমাদের ঝামেলা হচ্ছে।

* সঠিক সময়ে বীজ পাওয়া যায় না।

* চরের মানুষ বহু ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। চরের লোক সরকারের দফতরে গেলে বলে, ‘চরের লোক পরে আসো’। সেচ থেকে ঋণ কোনো কিছুই ঠিকমতো পাই না। চরের জন্য আলাদা ভর্তুকি চালু করা দরকার।

* মাছ চাষ করি কিন্তু কৃষি ঋণ দেয় না। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও লোন দেওয়া হয় না।

* চরের মানুষকে ব্যাংক ঋণ দিতে অনেক বেশি হয়রানি করে। কৃষি ও ব্যবসা করে সাফল্য আনছি কিন্তু ব্যাংকের কাছে বিশ্বস্ত হতে পারছি না। শুধু এনজিওর কাছে কিছু ঋণ পাওয়া যায়।

* সরকার দেশে ৫ হাজার কৃষককে প্রণোদনার টাকা দিলেও উপস্থিত কেউ পায়নি বলে মত জানায়।

* আবহাওয়াসহ নানা রকম তথ্যই আজকাল কৃষক মোবাইলে জানাতে পারে। এর কোনটা মেলে আবার কোনটা  মেলে না।

* রোগবালাই প্রতিরোধক বিষয়ে জানতেও কেউ কেউ স্মার্ট মোবাইলের মাধ্যমে তথ্য জেনে তা প্রয়োগ করছেন। উপস্থিত প্রায় ৬০ শতাংশ কৃষক স্মার্ট মোবাইল ব্যবহারকারী। তাদের দু-একজন এমন তথ্য দিলেন।

* ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈবসারের ব্যবহার বাড়ানো দরকার- এ ব্যাপারে সরকারের তৎপরতা বৃদ্ধিকরণ প্রয়োজন।

* কৃষিতে, সেচে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমরা মাছ চাষ করছি কিন্তু আমাদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক বিল নেওয়া হচ্ছে। এ বৈষম্য কেন?

* আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা চরের মানুষ। আমার ২০-২৫টি মহিষ আছে কিন্তু ঠিকমতো দুধের মূল্য পাই না। স্থানীয় কৃষি বিভাগও খোঁজখবর নেয় না।

* খাদ্যের মূল্য যেভাবে বাড়ছে, মৎস্য খাতে বিদ্যুতের মূল্য যেভাবে নেওয়া হচ্ছে সব মিলে মাছ চাষিদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। মাছ চাষিদের নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। যদি না থাকে তাহলে এ শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। অথচ এখন সময় এসেছে আমাদের মাছ বিদেশে রপ্তানি করার। সরকার মাছ চাষিদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি করবে এমনটাই আমরা উদ্যোক্তারা প্রত্যাশা করি।

* মাছ চাষ শিল্পের সঙ্গে প্রায় পৌনে ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৬০ ভাগও আসে এই মৎস্য সেক্টর থেকে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটি আজ ধ্বংস হওয়ার পথে। কারণ মাছ চাষিরা আজ মাছ চাষ লাভবান হতে পারছে না। মাছের খাবারের দাম প্রতি মাসে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কিন্তু মাছের দাম সেই অনুসারে বাড়ছে না। সরকার ধানের খাদ্য ইউরিয়াতে ভর্তুকি দিচ্ছে তাহলে মাছের খাদ্যে কেন ভর্তুকি দেওয়া হয় না?

* দুধ উৎপাদন করছি অথচ দুধের যে দাম তাতে খরচ উঠছে না। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ তার বক্তব্যে বলেন, সরকারের ভোজ্য তেল আমদানি কমানোর জন্য দেশে সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধির যে উদ্যোগ নিয়েছে সে ব্যাপারে আমার এলাকায় তিন গুণ সরিষা আবাদ করতে সক্ষম হয়েছি। এবার ১১০০ হেক্টর হয়েছে। আগামীতে আমাদের লক্ষ্য কমপক্ষে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের। এ ছাড়াও দেশের অনেক স্থানে সূর্যমুখী চাষ হয় কিন্তু আমাদের এখানে হয় না; সেটা ভেবে আমি আমার নিজের জমিতে আবার সূর্যমুখী চাষ করেছি। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বললেন, দেশে কোথাও এক ইঞ্চি অনাবাদি জায়গা রাখা যাবে না, কার কার জমি পতিত আছে তালিকা করা হোক। সেচের পানির বিদ্যুৎ বিল আর মাছ চাষের পানির বিদ্যুৎ বিলের যে অভিযোগ তার একটা সমন্বয় হওয়া দরকার। পানির প্রচুর অপচয় হয় মাটির ড্রেনের কারণে। এটাকে বারিড পাইপের মাধ্যমে দেওয়া গেলে পানির কম অপচয় হতো এবং সাশ্রয়ও হতো। আমরা মুক্তাগাছাকে কৃষির একটি মডেল করতে চাই। সরকার আমাকে যে বরাদ্দ দেয় তার বেশির ভাগই আমি কৃষিতে ব্যবহারের চেষ্টা করি যেন কৃষকরা একটু স্বস্তিতে থাকে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষিবান্ধব, তিনি নিজেও যেভাবে কৃষি চর্চা করেন তা যেমন আমরা চ্যানেল আইতে দেখেছি এতে দেশের কৃষক সত্যিই অনুপ্রাণিত হয়েছে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আমি জানি, স্থানীয়ভাবে সেচের মূল্য উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মিলে ঠিক করে দেন। সরকার একটি দাম বেঁধে দেন যেন স্থানীয় সেচ মালিকরা নিজের ইচ্ছামতো দাম ধরতে না পারে। পোলট্রির উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে বলে মাংসের দাম বেড়ে গেছে। ঋণ পেতে তো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সরকার ৮ হাজার কোটি টাকা মাত্র ৪ শতাংশ হারে ঋণ দিচ্ছে। ৩৭টি ব্যাংককে বলা হয়েছে, গ্রামে ঋণ দিতে হবে। তারপরও যদি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সমস্যা হয়, তাহলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন মিলে আপনার এলাকার ব্যাংকে গিয়ে আলোচনা করলে আমার মনে হয় সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিয়ে কথা হয়। এটা আসলে কোনো বছর বা এলাকায় অধিক উৎপাদন হলে এমনটা হয়। তবে আমাদের যেটা করা উচিত, কৃষি পণ্যকে রপ্তানির ব্যাপারে উৎসাহিত করা। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর উৎসাহিত করা। এর জন্য সরকার এখন ২০ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে।  এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট ২০২৩-২০২৪ এর চতুর্থ আয়োজন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব 

[email protected]

সর্বশেষ খবর