শনিবার, ২০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী স্মরণে কৃতজ্ঞ জাতি মনে রাখবে তাঁকে

এম নজরুল ইসলাম

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী স্মরণে কৃতজ্ঞ জাতি মনে রাখবে তাঁকে

১৯ মে ছিল সংবাদ-সাহিত্যের কীর্তিমান পুরুষ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। একটি কবিতা লিখেই বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া মানুষটি ১৯৫২ সালে কলম ধরেছিলেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করেছিলেন।  সেই প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। যখনই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে, দেশের অপরাজনীতি যখন অপপ্রচারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, তখনই প্রতিবাদী হয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালের পর থেকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে দেশে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলম প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। নিষিদ্ধ বাংলাদেশবিরোধী জামায়াতিদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা হয়েছে; প্রতিবাদী হয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রতিবাদে কলম ধরেছেন। প্রবাসী সরকারের মুখপত্র জয়বাংলা পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি লিখেছেন অসাধারণ এক একটি কলাম। যুদ্ধের মাঠে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। ক্যাম্পে মডারেটর হিসেবে কাজ করেছেন। আর এ সবকিছুই তিনি করেছেন দেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে। দুই চোখজুড়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এ মানুষটি আজ কেবলই স্মৃতি। অনন্য সাধারণ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ইতিহাসের সাক্ষী শুধু নন, সঙ্গীও।

তাঁর নামের সঙ্গে পরিচয় শৈশবে, যখন থেকে একুশের প্রভাতফেরিতে যাচ্ছি, তখন থেকেই। সামনাসামনি জানাশোনা আমার প্রবাস জীবনের শুরু থেকে। তখন থেকেই তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে আসছি। তিনি লন্ডনে, আমি ভিয়েনায়। ব্রিটেন ও অস্ট্রিয়া, ইউরোপের দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব যতই থাক না কেন, দিনে দিনে আমাদের নৈকট্য বেড়েছে। একুশের প্রভাতফেরির গানের রচয়িতা, খ্যাতিমান সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে অপরিচয়ের দূরত্ব ঘুচে যেতে সময় লাগেনি। এক সময় যাঁকে খুব দূরের বলে মনে হতো, তিনি আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন অপত্য স্নেহে। তাঁর স্নেহ-সাহচর্যে আমি ঋদ্ধ হয়েছি। আজ এত বছর পর পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, আমাদের গাফ্ফার ভাই ছিলেন সহজ-সরল এমন একজন মানুষ, যিনি সবাইকে আপন করে নেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা রাখতেন। তাঁর সঙ্গে দেশের ভালোমন্দ, রাজনীতির বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হতো, এ ছিল আমার অনেক বড় পাওয়া। লন্ডনে গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করা ছিল আমার নিত্য রুটিন। বিদেশেও অনেক জায়গাতে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে। ভিয়েনায় এসেছিলেন তিনি। আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন, এ আমার অনেক বড় পাওয়া। মনে আছে, ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের প্রদর্শনী হয়েছিল ভিয়েনায়। হলভর্তি দর্শক বিস্ময়-বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছিল নাটকটি। বোধহয় সেটাই ছিল লন্ডনের বাইরে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী।

ইতিহাসের সাক্ষী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। সঙ্গীও। ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের জন্ম, এই ইতিহাসের অনেক কিছুরই সাক্ষী তিনি। জন্মেছিলেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে, ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেস কমিটি ও খেলাফত কমিটির বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি প্রয়াত হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী তাঁর বাবা, মা জোহরা খাতুন। উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসা ও উলানিয়া করোনেশন হাই ইংলিশ স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। স্কুলজীবনেই নিয়েছিলেন রাজনীতির পাঠ। ছাত্রজীবনেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত মাসিক সওগাত পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫২ সালে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ছাত্রজীবনেই। ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন যোগ দেন দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায়। ১৯৫১ সালে যোগ দেন খায়রুল কবীর সম্পাদিত দৈনিক সংবাদের বার্তা বিভাগে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন ১৯৫৬ সালে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কলমযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। জয়বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মডারেটরের ভূমিকাও পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।

বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম সোপান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন স্পর্শ করেছিল তাঁকে। লিখেছিলেন এক অমর কবিতা। অমর সুরকার আলতাফ মাহমুদের সুরে তা আজ গীত হয় বিশ্বজুড়ে একুশের প্রভাতফেরির গান হিসেবে। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এভাবেই নিজেকে যুক্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। বাঙালি চিরদিন স্মরণ করবে এ গানটি। আর স্মরণ করবে এই গানের গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকেও। যতদিন বাঙালি জাতি টিকে থাকবে, একুশের প্রভাতফেরি হবে। প্রভাতফেরিতে গীত হবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। এ গানটির ভিতর দিয়ে স্মরণ করা হবে তাঁকে। আজ সারা বিশ্বে গানটি গাওয়া হয়। বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে গানটি। গাওয়া হয়েছে। বেরিয়েছে রেকর্ড। বাঙালির জন্য এ এক অনন্য সম্মান। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে এই অনন্য সম্মান এনে দিয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।  কৃতজ্ঞ জাতি তাঁকে ভুলবে না। চিরদিন মনে রাখবে তাঁকে।

লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি

[email protected]

সর্বশেষ খবর