সোমবার, ২২ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

অসুস্থ রাজনীতি, অন্ধকার ভবিষ্যৎ

মহিউদ্দিন খান মোহন

অসুস্থ রাজনীতি, অন্ধকার ভবিষ্যৎ

এবার ঈদে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। এর নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রচন্ড গরম এবং শারীরিক অসুস্থতাজনিত সমস্যা অন্যতম। যদিও রাজধানীর নিকটবর্তী হওয়ায় মাসে অন্তত দুবার যাওয়া হয় গ্রামে। যেতে খুব একটা সময় লাগে না এখন। যাত্রাবাড়ী থেকে যাত্রা করলে বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই আমার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে পৌঁছে যাওয়া যায়। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ঠিক পাশেই আমার গ্রাম মাশুরগাঁও। একটা সময় ছিল, গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, বাড়ি যেতে আমাদের সময় লাগত ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। সে সময় যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল লঞ্চ। রাজধানী ঢাকা থেকে ১৮-২০ মাইল দূরত্বের শ্রীনগর তখন ছিল যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকার। একটি সড়ক বা মহাসড়কের জন্য আমরা চাতকপাখির মতো তাকিয়ে ছিলাম।

আমাদের সে দীর্ঘ প্রতীক্ষার আকাশে প্রথম সূর্যকিরণ ছড়ায় ১৯৭৮ সালের ১৪ মার্চ। সেদিন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান লৌহজং উপজেলার মেদিনীমন্ডল গ্রামে মাটি কেটে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ঢাকা-মাওয়া অংশের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। মহাসড়কটি চালু হয় ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে। উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ। তখন বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীতে তিনটি ফেরি পেরিয়ে আমাদের যাতায়াত করতে হতো। সময় লাগত ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। তারপর পর্যায়ক্রমে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীতে সেতু তৈরি হওয়ার পর যাতায়াতের সময় এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে সীমিত হয়ে আসে। এখন সে মহাসড়কটি আট লেন-সমৃদ্ধ এক্সপ্রেসওয়ে। নাম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’। এটা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের অন্যতম মাইলফলক নিঃসন্দেহে। মহাসড়কটিতে উঠলে একটি অনির্বচনীয় আনন্দে মন ভরে যায়। এমন দৃষ্টিনন্দন সড়কও যে আমাদের দেশে নির্মাণ সম্ভব, কিছুদিন আগেও তা চিন্তার অতীত ছিল। সেই সঙ্গে প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর সেতু পুরো দৃশ্যপটই বদলে দিয়েছে বিক্রমপুরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের। এ এক বিস্ময়কর অগ্রগতি! মাত্র চল্লিশ বছরের ব্যবধানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে আমরা বিক্রমপুরবাসী এগিয়েছি ১০ গুণ। আগের পাঁচ ঘণ্টার জায়গায় এখন আধা ঘণ্টা। এই এক্সপ্রেসওয়ে বা পদ্মা সেতু বানাতে কত খরচ হয়েছে বা কত অপচয় হয়েছে, সেসব প্রশ্ন অন্তত আমার কাছে অবান্তর। আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির বিষয় হলো, গ্রামের সঙ্গে আমার বন্ধন নিবিড় করতে এর ভূমিকা।

এখন আমার এলাকার অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ঢাকায় যাতায়াত করে অফিস করেন, ব্যবসা করেন। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের দিকে তাকালে আমাদের জাতীয় অগ্রগতি প্রশ্নে কূটতর্কের কোনো অবকাশ থাকে না। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রশ্নে সংকীর্ণতা বর্জন অত্যন্ত প্রয়োজন। অন্তত জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে যার যতটুকু অবদান, তা স্বীকার করার মতো উদারতা বোধকরি আমাদের থাকা উচিত। আমাদের আজকের যে জাতীয় অগ্রগতি, এর মূল স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই বিগত পাঁচ দশকে আমরা আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছি। গত ২৮ এপ্রিল শুক্রবার গিয়েছিলাম গ্রামে। গ্রামে গেলেই মুরব্বি, বন্ধুবান্ধব, ছোট ভাই-ব্রাদারদের সঙ্গে গল্প-আড্ডা খুব খারাপ জমে না। সেদিন গ্রামের মাথার বাস স্টপেজে নামতেই ছোট ভাইয়েরা একরকম ছেঁকে ধরল। কেন ঈদে বাড়ি যাইনি সে কৈফিয়ত দিতে হলো। তারপর অবধারিতভাবে এসে গেল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়। ওরা জানতে চায় আসলে কী হতে যাচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে কি না, সরকার বিএনপির দাবি মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেবে কি না ইত্যাদি। ওদের প্রশ্নের তেমন সন্তোষজনক কোনো জবাব দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কেননা, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে পর্যায়ে এখন পর্যন্ত আছে এবং দুই পক্ষের অনমনীয় মনোভাবের যে বহিঃপ্রকাশ কথাবার্তায় প্রতিভাত হয়ে উঠছে, তাতে সমস্যা বা সংকটের কোনো সহজ সমাধানের আলোকরেখা এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। গ্রামের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে যেটা বুঝলাম, তাদের মনে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি শঙ্কা বাসা বেঁধেছে। এদের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। কেউ কেউ সম্পৃক্ত। তবে সবাই চান একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। তাদের কথা একটিই- সরকারে কে এলো সেটা ব্যাপার নয়। আমরা চাই একটি নির্বাচিত সরকার; যে সরকারের বৈধতা নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না।

তাদের মনে শঙ্কা, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনো অরাজক অবস্থার মধ্যে পড়ে কি না। বলাবাহুল্য, গ্রামের মানুষের এসব প্রশ্নের কোনো সহজ-সরল জবাব আমি দিতে পারিনি, দেওয়া সম্ভবও ছিল না। কারণটি খোলাসা করে না বললেও কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যে সমস্যা বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে তার সমাধান কী তা নিয়ে প্রশ্ন সবার মনেই। আমাদের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সে উপায়ের কথা বাতলেও দিয়েছেন। সম্প্রতি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির চেম্বারে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘সরকার ও বিরোধী দল যার যার অবস্থান নিয়ে আছে। কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, আবার কেউ কেউ না-ও নিতে পারে বা এর মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। সংকট তো আছেই একটা। আলোচনাই একমাত্র সমাধান। আর কোনো পথ খোলা নেই। আলোচনা না হলে তো কিলাকিলি। তাই সরকারি ও বিরোধী দলকে আন্তরিক হতে হবে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ এপ্রিল ২০২৩)। সাবেক রাষ্ট্রপতির এ মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আলোচনার যে বিকল্প নেই তা অস্বীকার করবে কে? কিন্তু আমাদের রাজনীতির নিয়ন্ত্রকরা সে পথে হাঁটবেন কি না সেটাই প্রশ্ন। যদি তারা আলোচনা-সমঝোতার পথে না হাঁটেন, তাহলে ফলাফল হবে সংঘাত; যেটাকে ‘কিলাকিলি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি।

বলা হয়ে থাকে, সমঝোতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় গণতন্ত্রকে পত্রপল্লবে বিকশিত করে সুশোভিত করতে ব্যাকুল। অন্তত বক্তৃতা-বিবৃতিতে তারা সেরকমই বলে থাকেন। কিন্তু গণতন্ত্রকে সুষমামন্ডিত করার প্রথম যে পূর্বশর্ত সেদিকে মোটেই পা বাড়াতে চান না। অর্থাৎ সমঝোতার পথে পা ফেলতে নারাজ। তাদের পরস্পরের প্রতি এই যুদ্ধংদেহি মনোভাব আমাদের গণতন্ত্রকে সময়ে সময়ে বিপর্যস্ত করেছে। আর গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাজনৈতিক দল ও এর নেতা-কর্মীরাই। সে তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তারা কেন একই ভুল বারবার করেন তা এক বিস্ময়কর প্রশ্ন।

বিষয়টি নিয়ে একদিন কথা বলেছিলাম প্রবীণ রাজনীতিক ও মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ শিষ্য মো. শামসুল হকের সঙ্গে। স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া অশীতিপর এই রাজনীতিক বললেন, এটা রাজনীতি ও রাজনীতিকদের মনমানসিকতার অসুস্থতার লক্ষণ। রাজনীতি এখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ফলে সব দলই চায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিতে। কেউ চেয়ার আঁকড়ে থাকতে চায় যে কোনো মূল্যে। আর কেউ যে কোনো পন্থায় সে চেয়ার দখলে নিতে বদ্ধপরিকর। ফলে সংঘাত হয়ে ওঠে অনিবার্য। আর এ সংঘাতের ফলে রাজনীতির ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন।

গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে মুখোমুখি হলাম আরেক পরিস্থিতির। সেখানে ইমাম সাহেব তাঁর বয়ানে বিয়েশাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে নাচ, গান, ডিজে-পার্টি জাতীয় ‘অনৈসলামিক’ কাজের বিরুদ্ধে কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে ওসব থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানালেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু মাঝখানে একটি কাগজ সরবরাহ করা হলো সবার স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য। তাতে আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বরাবর লেখা দরখাস্তে বলা হয়েছে, ইদানীং গ্রামে বিয়েবাড়ি বা গায়েহলুদ, সুন্নাতে খতনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে গানবাজনা, নৃত্য, এমনকি মদ-বিয়ার সেবন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাকে অনুরোধ করা হয়েছে এসব কর্মকান্ড বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণের। কাগজটি পড়ে আমি স্বাক্ষর না করে বললাম, এ ব্যাপারে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে আমি আমার মতামত দেব। একটু পরেই চেয়ারম্যান মুন খান এলো। সে আমাদেরই গ্রামের ছেলে, সম্পর্কে আমার ভাতিজা। বয়সে তরুণ এ চেয়ারম্যান অত্যন্ত ভদ্র, নম্র এবং কর্মঠ। ছাত্রজীবন থেকেই সে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল। বর্তমানে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। আমি ওকে অত্যন্ত ¯ন্ডেœহ করি। বলতে দ্বিধা নেই, নির্বাচনে আমি ওকে সর্বান্তকরণে সমর্থন দিয়েছিলাম রাজনৈতিক মতাদর্শের বৈপরীত্য সত্ত্বেও। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, অত্যন্ত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে মুন খান বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছে। চেয়ারম্যান হওয়ার পরও ওর আচরণ-কথাবার্তায় কোনো অহমিকা বা হামবড়াভাবের দেখা এখন পর্যন্ত পাইনি। আশা করি সে সুনাম রক্ষা করে এগিয়ে যাবে। তো চেয়ারম্যানকে বললাম, বিষয়টি সহজ মনে হলেও জটিলতা দেখা দিতে পারে। তুই বরং এক কাজ কর, গ্রামের সবাইকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলাপ কর। তাদের বল, এসব কাজ অনৈতিক। আনন্দ অবশ্যই করবেন। তবে তা শালীন, ধর্মীয় অনুশাসনসম্মত এবং রাষ্ট্রীয় আইনসিদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। চেয়ারম্যান আমার সঙ্গে একমত হয়ে বলেছে, শিগরিগরই সে উদ্যোগ নেবে।

গ্রামের কেউ কেউ জানালেন, ইদানীং সেখানে মাদকদ্রব্যের আশঙ্কাজনক প্রসার ঘটেছে। এসব পার্টিতে মদ বিয়ারসহ নানা ধরনের মাদক সেবন করে একশ্রেণির বখাটে তরুণ-যুবক। তাদের কারণে গ্রামের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, ভালো ছেলেদেরও বিপথে যাওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আমি তাদের বলেছি, সমাজকে সুশৃঙ্খল রাখা এবং অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। যেহেতু সমাজটা আমাদের, তাই অবক্ষয় থেকে একে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে তা করতে হবে রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামোর ভিতরে থেকে; যাতে এ নিয়ে সমাজে কোনো দ্বিধাবিভক্তি বা সংঘাত না দেখা দেয়।  চেয়ারম্যান মুন খানকে বলে এসেছি, এ বিষয়ে যে কোনো প্রয়োজনে আমি তাদের পাশে থাকব।  বিকালে ঢাকায় ফেরার পথে বাসে বসে ভাবছিলাম, কোথায় যাচ্ছি আমরা? রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে যে রাজনীতি, তা চলেছে অনিশ্চিত গন্তব্যে। অন্যদিকে মাদক ও উচ্ছৃঙ্খলতার জোয়ারে ভেসে যেতে বসেছে আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। তাহলে কি আমাদের সামনে কেবলই ঘোরতর অন্ধকার বিরাজ করছে?

          ♦  লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

 

 

সর্বশেষ খবর