বুধবার, ২৪ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

এ কেমন স্ববিরোধিতা!

খায়রুল কবির খোকন

এ কেমন স্ববিরোধিতা!

আমাদের সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক পদে হ্যাটট্রিক অর্থাৎ পরপর তিন টার্ম পদ-পাওয়া ওবায়দুল কাদের ভাই অবিরাম রাজনীতির কথাবার্তা বলতে বলতে আবারও চমৎকার একটা ‘রাজনৈতিক বাণী’ দিয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভালো লোকেরা এখন আর রাজনীতিতে আসতে চায় না। রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট রাজনীতি নষ্ট মানুষের জন্ম দিচ্ছে’। খুবই সত্য কথা, কাদেরভাই।  আপনি একটা মহৎবাণী দিয়ে ফেলেছেন। যুগে যুগে আমাদের সমাজে মহামানবেরা আসেন, তাঁরা বাণী দেন, যা দুনিয়ার মানবসমাজ ও মানবসংস্কৃতি ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ করে, মানবসভ্যতা সেসব বাণী থেকে শিক্ষণীয় দর্শনটা অনুধাবন করে, অনুসরণ করে এবং সামনে এগোনোর মহৎ-পথ খুঁজে পায়।

সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ওবায়দুল কাদের সাহেবের এই মহৎবাণী নিয়ে জনপ্রিয় এক বাংলা দৈনিকে চমৎকার কলাম লিখেছেন শিক্ষাবিদ-লেখক ও খ্যাতিমান সংবাদপত্র কলামিস্ট প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁর এই লেখাটির শিরোনাম- ‘রাজনীতির প্রতি অনাস্থা বাড়ল কেন?’ এই লেখাটির ভিতরে লেখকের বিশ্লেষণ হচ্ছে : “ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে পত্তন-হওয়া আমাদের এই রাষ্ট্রটি যে আমলাতান্ত্রিক ছিল, পাকিস্তানি শাসনামলে সেই চরিত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ, শাসকদের অভিপ্রায় ছিল পূর্ববঙ্গকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করা। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছিল সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতে। আমরা চেয়েছিলাম, সেই পাকিস্তান থেকে বের হয়ে গিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে; সম্ভব হয়নি। কারণ, বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও ছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের মতোই রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক চরিত্রটি অপরিবর্তিত রাখতে বদ্ধপরিকর। নিজেদের উন্নতিকেই তাঁরা দেশবাসীর উন্নতি বলে বিশ্বাস করতেন, প্রচারও করেছেন।”

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার পান্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো প্রসঙ্গে- সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে পাকিস্তান আমল এবং বর্তমান সময়কাল অবধি। কিন্তু আমাদের তিনবারের হ্যাটট্রিক করা সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাষ্ট্র ও সমাজের সেই আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী চরিত্র সম্পর্কে কি এতটুকু স্টাডি করার চেষ্টা করেন? এর প্রতিকারের লক্ষ্যে কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের নতুন লড়াই শুরুর কথা ভাবেন? না-কি একটা মহৎ-বাণী দিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আস্থা জিইয়ে রাখাই আসল লক্ষ্য?

এদিকে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে নষ্ট রাজনীতি ও নষ্ট মানুষ এবং নষ্ট সংস্কৃতি, অমানবিকতা এবং নানা বেআইনি কাজ-কারবার যে সমানে গ্রাস করে নিচ্ছে সবকিছু, ‘সিক স্যার’ (সি.ই.চৌ.) তার কিছু নমুনাও উল্লেখ করেছেন, তাঁর ওই লেখাটাতেই, যেমনটি তিনি করে যাচ্ছেন তাঁর প্রতিটি লেখায়। আমাদের ‘সজ্জন রাজনীতিক’ ওবায়দুল কাদের সাহেব সেসব কী দেখতে পান? বুঝতে পারেন, কেন দুর্দশা এই দেশের? আমলাতন্ত্র কীভাবে এই রাষ্ট্র ও সমাজকে ধসিয়ে দিচ্ছে? নষ্ট রাজনীতিকরা তাঁরই দলের ভিতরে বাইরে বসে নানা-রকম ক্ষমতা ভোগ করে পুরো রাষ্ট্রটিকে, সমগ্র সমাজটিকে অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতির অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করছেন? আর নিজেদের রাজনৈতিক গোষ্ঠীগত উন্নয়নকেই ‘দেশবাসীর উন্নতি’ বলে বিশ্বাস করছেন, মানুষকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন!

শিক্ষাবিদ-কলামিস্ট সিক-স্যার-এর লেখাটা যেদিন (৭ মে/২০২৩) ছাপা হয়েছে বাংলা দৈনিকটিতে, সেই পত্রিকায় সেদিন ছাপা হয়েছে কাদের সাহেবদের আওয়ামী লীগের প্রধান সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ‘এনএসএফ-মার্কা’ কাহিনির সামান্য-কিছু তথ্য। খবরটির শিরোনাম -‘ভর্তিচ্ছুদের ফুল দিতে এসে হামলার শিকার ছাত্রদল’, সচিত্র রিপোর্ট। সংবাদ-চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে- দুজন সহশিক্ষার্থী অন্য-এক আহত রক্তাক্ত-ছাত্রকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের উদ্দেশে। এরা ছাত্রদল কর্মী। খবরে বলা হয়েছে : ‘ছাত্রদলের ভাষ্য- শনিবার (৬ মে/২০২৩) তারা ক্যাম্পাসে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানায়। শিক্ষা চত্বর সংলগ্ন কার্জন হল গেটে ফুল দিয়ে হাই কোর্টের দিকে ফেরার পথে ছিল তারা, মোটরসাইকেলে এসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসব ছাত্রদল কর্মীর ওপরে হামলা চালায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির ও সাধারণ সম্পাদক তানভির হাসানের নেতৃত্বে এ হামলা হয়। অন্তত ছয়জন ছাত্রদল নেতা আহত হন, তাদের একজন সাব্বিরের মাথায় ১২টি সেলাই লেগেছে। তারা কাকরাইলের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। এই যে ঘটনাটি ঘটাল ছাত্রলীগের বাহিনী মোনেম খানের এনএসএফ স্টাইলে, এর কি জবাব দেবেন ওবায়দুল কাদের সাহেব? নিজেরা মস্তান পুষবেন, বিরোধী দল দমনে, পুলিশকে ব্যবহার করেন দলীয় মস্তানদের মতো, পুরো বেআইনি কায়দায়।  দলীয় কর্মীদের দিয়ে বিরোধী দলের ও মতের লোকজনের ওপর যখন-তখন হামলা করেন, এমনকী নিজ দলের ভিন্নমতের কর্মীরাও ছাড় পান না ওইসব মস্তানির হাত থেকে।  তাহলে নষ্ট রাজনীতি দূর করে সুস্থ রাজনীতি কীভাবে কায়েম হবে, কাদেরভাই?

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ‘মোনেম খানি এনএসএফ মার্কা’ ক্যাডার দিয়ে ছাত্রলীগ রাজনীতি চালাতে চান, পুলিশকে দলীয় ক্যাডারের মতো ব্যবহার করে গণতন্ত্রের আন্দোলনের কর্মীদের দমন করতে চান, গণতন্ত্র ও সুশাসন বিসর্জন দেন অকাতরে। তারপরে আবার বলেন- ‘নষ্ট রাজনীতি সুস্থ রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।’ এ কেমন স্ববিরোধী কথাবার্তা, কাদেরভাই!

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর