সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইমাম আজমের ইলমি গভীরতা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ইমাম আজমের ইলমি গভীরতা

শাফেয়ি মাজহাবের বিখ্যাত আলেম মুহাম্মাদ আবু জুহরা (রহ.) ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে একটি জ্ঞানগর্ভ কিতাব লিখেন। কিতাবের শুরুতেই তিনি একটি হাদিস উল্লেখ করেন। হাদিসটি হলো- রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইলমে দ্বীন যদি ঊর্ধ্বাকাশের সপ্তর্ষিম লস্থ নক্ষত্র সুরাইয়া পর্যন্ত দূরে চলে যায়, পারস্যের কয়েকজন সন্তান ইলম অর্জনের জন্য সেখানেও চলে যাবে।’ (আবু হানিফা, ১৮ পৃষ্ঠা।) দুনিয়াখ্যাত হাদিস বিশারদরা স্বীকৃতি দিয়েছেন- রসুল (সা.) ঘোষিত ভবিষ্যদ্বাণীর ফল হলেন ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)। এ বিশ্লেষণ যে ভুল নয় খোদ ইমাম শাফেয়ির উক্তিই তার প্রমাণ। ইমাম শাফেয়ি প্রায়ই বলতেন, ‘আন্নাসু ইয়ালুন ফিল ফিকহি আলা আবি হানিফা। অর্থাৎ ইলমে ফিকহের জগতে আবু হানিফা পিতা আর মুসলিম উম্মাহ সন্তানতুল্য।’ শুধু তাই নয়, ইমাম আবু হানিফার ছাত্ররাও ছিলেন জগদ্বিখ্যাত আলেম ও ফকিহ। চার মাজহাবের অন্যতম মাজহাব হাম্বলি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আহমদকে (রহ.) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- শরিয়তের এসব সূক্ষ্ম বিষয় আপনি কোথায় শিখেছেন? জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আবু হানিফার ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদের কিতাব থেকে।’ (ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.), ৭৯ পৃষ্ঠা)। ইমাম আবু হানিফার ইলমি গভীরতার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বিষয়টি পেয়েছি উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা জাকারিয়ার (রহ.) ‘হাজ্জাতুল বিদা ওয়া উমরাতুন নবী’ গ্রন্থে। গ্রন্থটির ৪৪ ও ৪৫ পৃষ্ঠায় একটি মাসআলা নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। মাসআলাটি হলো- হাজিদের কোরবানির জন্তু চিহ্নিত করা প্রসঙ্গে। রসুল (সা.) কোরবানির উটের ডান পায়ে আঘাত করে চিহ্নিত করে দেন যে, এগুলো কোরবানির জন্য নির্ধারিত। প্রায় সব মাজহাবের ইমামরা বলেছেন, এভাবে কোরবানির পশু চিহ্নিত করা সুন্নত। খোদ ইমাম আবু হানিফার দুই ছাত্র আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রহ.) বলেছেন মুস্তাহাব। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা ফতোয়া দিলেন এভাবে পশুকে আঘাত করা মাকরুহ! যে কাজটি রসুল (সা.) করেছেন, সব ইমাম এটিকে সুন্নত বলেছেন, নিজের ছাত্ররা পর্যন্ত মুস্তাহাব বলেছেন-কিন্তু আবু হানিফা কি না বললেন এটি মাকরুহ! কেন? এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.) লিখেন, ইমাম আজমের দলিল হলো, এভাবে পশুকে আঘাত করা অঙ্গ বিকৃতির শামিল। আর অঙ্গ বিকৃত করা কোরআনের আলোকে হারাম। যখন কোনো ব্যাপার হালাল ও হারাম দুই ধরনেরই দলিল পাওয়া যায় তখন হারামের দিকেই ফতোয়া দিতে হয়। তাই পশুকে অঙ্গহানির মাধ্যমে চিহ্নিত করা মাকরুহ।

রসুল (সা.) পশুর পায়ে আঘাত করেছেন হেফাজতের জন্য। যেন ওই চিহ্নিত পশুগুলো হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়া সহজ হয় কিংবা কোথাও খাবারের উদ্দেশ্যে গেলে মুশরিকরা বাধা না দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে লোকজন খুব বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়। ইমাম আবু হানিফা দেখলেন, সুন্নত পালন করতে গিয়ে লোকজন পশুকে এমন কঠোরভাবে আঘাত করছে যে সেটা পশুর জন্য কষ্টদায়ক হয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি কোরআনের আয়াত দিয়ে ফতোয়া দিয়েছেন, এভাবে বাড়াবাড়ি করাটা নবীজির উদ্দেশ্য ছিল না। শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.) এও বলেছেন, এ মাকরুহের ফতোয়া কেবল আবু হানিফার সমকালীন লোকদের ব্যাপারে প্রযোজ্য ছিল। কেউ যদি পশুকে কষ্ট না দিয়ে চিহ্নিত করে তাহলে তার জন্য এটি মাকরুহ হবে না। যে আমলের যতটুকু গুরুত্ব ওই আমলকে এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া আসলে দ্বীন না বোঝারই নামান্তর। শুধু পশু চিহ্নিত করার বিষয়েই নয়, অনেক বিষয়েই তিনি সমকালীন আলেমদের চেয়ে ভিন্ন ফতোয়া দিয়েছিলেন। যতটুকু মনে পড়ছে তিনি শাওয়ালের রোজার ব্যাপারে কড়াকড়ির বিষয়টিকেও মাকরুহ বলেছিলেন। তখন শাওয়ালের রোজার ব্যাপারে মানুষ খুব কড়াকড়ি করত। তাই তিনি এমন ফতোয়া দিয়েছিলেন। আসলে তিনি পশু চিহ্নিত করা বা শাওয়ালের রোজা রাখাকে মাকরুহ বলেননি। তিনি অতিরিক্ত কড়াকড়িকে মাকরুহ বলেছেন। সুন্নতকে সুন্নতের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যই তিনি এমন ফতোয়া দিয়েছিলেন। কেননা বিদায় হজের ভাষণে রসুল (সা.) বারবার বলেছেন, ‘হে আমার উম্মত! তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। অতীতে বহু জনগোষ্ঠী ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।’ তাই একজন ইসলামী পন্ডিতের দ্বীনি বিষয়ের সীমা-পরিসীমার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। ইমাম আবু হানিফার ফতোয়াগুলো বিশ্লেষণ করলে এর বাস্তবতা ফুটে ওঠে। হে আল্লাহ! আপনি ইমাম আজমকে উত্তম জাজা দান করুন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর