শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রয়োজন ফল-ফসল সংরক্ষণ নিয়ে সময়োপযোগী গবেষণা

শাইখ সিরাজ

প্রয়োজন ফল-ফসল সংরক্ষণ নিয়ে সময়োপযোগী গবেষণা

আমাদের দেশে ২৫-৩৫ শতাংশ ফসল নষ্ট হয় সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার অভাবে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আবার তাপ বাড়িয়েছে পিঁয়াজের দামের ঊর্ধ্বগতি। দাম নিয়ন্ত্রণে শুরু হয়েছে পিঁয়াজ আমদানির কাজ। দেশে পিঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন। এ বছর ফলন হয়েছে ৩৫ লাখ টনের কাছাকাছি। শুধু সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার অভাবে শতকরা ২৫ ভাগ পিঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। নেদারল্যান্ডসের ভাগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখে এসেছি ফল-ফসল সংরক্ষণ নিয়ে নানামুখী কার্যক্রম। কৃষি গবেষণার সূতিকাগার বলা হয় নেদারল্যান্ডসের ভাগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। আজকে নেদারল্যান্ডসের যে কৃষি সমৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন শিল্প এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারের পেছনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এবং আবিষ্কার বড় ভূমিকা রেখে আসছে। কৃষি গবেষণার তথ্য নিয়ে কাজ করতে একাধিকবার আমার ভাগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। গত বছরের এপ্রিলের কথা। সেবার নেদারল্যান্ডসের ডেল্টাপ্ল্যান নিয়ে কাজ করতে পুনরায় ভাগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ কাতারিন টেরউইসখা ফান স্কেলটিংখা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ফেনোমিয়া’র পোস্ট হারভেস্ট কোয়ালিটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইলকা ভেসত্রার সঙ্গে। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন তাদের গবেষণার বিষয়াদি দেখাতে।

ইলকার সঙ্গে গেলাম ফেনোমিয়া বিভাগের অভ্যন্তরে। তিনি ভিতরের ছোট ছোট কক্ষ দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে যে কক্ষগুলো দেখছেন, এগুলো মূলত কোল্ড স্টোরেজ। একেকটার একেক রকম তাপমাত্রা আর আর্দ্রতাও ভিন্ন ভিন্ন।’ জানতে চাইলাম, ‘একেক ফসলের জন্য একেক রকম?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আবার একই ফসলের জন্যও ভিন্ন রকম। আমরা দেখছি কোন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় কোন ফল বা ফসল কতদিন পর্যন্ত গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রাখতে পারে। আমরা গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনকেও কন্ট্রোল করছি।’

ইলকা একটি ছবি দেখিয়ে বিশ্লেষণ করলেন, বাতাসে কী পরিমাণ অক্সিজেন আছে, তার ওপর নির্ভর করছে ফলটি কতক্ষণ সময় সতেজ থাকবে। যখন অক্সিজেনের লেভেল ০.৪ পারসেন্ট থাকছে, তখন ফল ফ্রেশ থাকছে। যখনই লেভেল ১.১ পারসেন্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন কিন্তু ফলের গায়ে কালো দাগ পড়তে শুরু হবে। তাপমাত্রা যত কম হবে, ফল তত তাজা থাকবে, বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। দেখা গেছে পিয়ার ফল ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় যতটা তাজা থাকে, ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কিন্তু সেটাকে ততটা তাজা দেখায় না। নির্দিষ্ট সময় ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে।

একটা স্টোরেজ খুলে দেখালেন তিনি। অনেক প্রকোষ্ঠের ভিতর পিয়ার ফল রাখা। তাতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকোষ্ঠের জন্য অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের একেকরকম মিক্সারের প্রবাহ রাখা হয়েছে। তারা দেখছেন কোনটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর।

জানতে চাইলাম, ‘আপনারা পিয়ারের স্টোরেজ লাইফ পর্যবেক্ষণ করছেন। এই ফলগুলো যখন বাজারে নেওয়া হবে, তখন তো পরিবহনের গাড়িতেও এ অবস্থাতেই রাখতে হবে, তাই তো?’

তিনি বললেন, ‘রাখতে পারলে ভালো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব হয় না। তাই আমরা প্যাকেজিং নিয়েও গবেষণা করছি। স্টোরেজ থেকে বের করে বাজার হয়ে ভোক্তার হাতে পর্যন্ত পৌঁছানো পর্যন্ত কীভাবে প্যাকেট করলে ফলটি টাটকা থাকবে সে নিয়েও আমাদের বিস্তর গবেষণা আছে। আপনাকে দেখাব সব।’

ইলকা নিয়ে গেলেন প্যাকেজিং কক্ষে। সেখানে সারি সারি প্যাকেজিং পেপার রাখা। মনে হলো বড় কোনো প্লাস্টিক পেপারের দোকানে চলে এলাম। অনেক রকমের প্লাস্টিক পেপার। একেকটির উপকরণ ও থিকনেস একেকরকম। রয়েছে রঙের ভিন্নতাও।

ইলকা জানালেন, রং ভিন্ন, কারণ একেক ফসল তাজা রাখার জন্য একেকরকম আলোর প্রয়োজন হয়। যেমন আলুর ক্ষেত্রে সবুজ রংটা ভালো। সবগুলো প্লাস্টিকই ফুডগ্রেডেড। জানতে চাইলাম, ‘পেপারগুলো কি বায়োডিগ্রেডেবল?’ ইলকা উত্তর দিলেন, ‘না।’

আমি বললাম, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের শেল থেকে একরকম বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক তৈরি করা যায়। আপনারা কি সে রকম বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা করছেন?

ইলকা বললেন, ‘শুধু ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই-ই নয়, পরিবেশের বিভিন্ন উপকরণ থেকে তৈরি করা বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক নিয়েও গবেষণা করছি।’

এরপর আমরা আর একটি কক্ষে গেলাম। সেখানে মূলত ফল বা ফসলের বাহ্যিক অবস্থা নির্ণয় করা হয়। স্টোরেজে তোলার আগে এবং স্টোরেজ থেকে বের করে ফল ফসলের অবস্থা নিরীক্ষণ করতে ছবি তোলা হয়। রয়েছে অনেক হাই ডেফিনেশনের ক্যামেরা।

ইলকা জানালেন, সেখানে এমন ক্যামেরা রয়েছে যা আমাদের সাধারণ চোখ ধরতে পারে না। ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ডাটা আকারে কম্পিউটারে চলে যায়। সেই ডাটাগুলো তুলনা করে অবস্থা ফল-ফসল কতটা সতেজ তা বোঝা যায়।

প্রশ্ন করলাম, এর জন্য ইনভেস্ট করে কারা?

ইলকা বললেন, স্টোরেজ প্রতিষ্ঠান, কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করে। তারা শুধু প্রটোটাইপ তৈরি করে দেন। কীভাবে ফল-ফসলের কোয়ালিটি পরীক্ষা হয় তা বোঝা গেল। একটা স্টুডিওর মতো কক্ষে নিয়ে গেলেন ইলকা। সেখানে একটা অর্কিড ফুল রাখা আছে। আছে ১০টি ক্যামেরা। যেগুলো দিয়ে অর্কিডের ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা যায়। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ছবির মাধ্যমে ফুলের আদ্যোপান্ত ডাটা আকারে তারা পেয়ে যায়। একটা আদর্শ অর্কিড ফুলের স্যাম্পল ডাটা অন্য অর্কিড ফুলের ডাটার সঙ্গে তুলনা করে সমস্যা নিরূপণ করতে পারে রোবট। পাশেই আছে বড় গাছের ছবি তোলার ক্যামেরা। বড় প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে সাধারণত তারা টু-ডি ইমেজ নিয়ে থাকে। অন্য একটি কক্ষে ইমেজ প্রসেসিং হয়। সেন্সর ক্যামেরাগুলো সফটওয়্যারের সঙ্গে সংযুক্ত। এতে একদম ঠিক তথ্য পাওয়া যায়।

এরপর আমরা গেলাম রোবটিকস রুমে। বলা ভালো সেখানে রোবটকে শেখানো হয়। রোবটের মাধ্যমে কীভাবে প্ল্যান্ট মরফোলজি নিয়ে কাজ করা যায় তা রোবটকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয়।

সেখানে অনেক ডামি ফল রাখা আছে। রোবটকে শেখানো হচ্ছে কোনটা ক্যাপসিকাম, কোনটা কলা কিংবা কোনটা স্ট্রবেরি। নেদারল্যান্ডসের মতো উন্নত দেশগুলো কৃষি প্রযুক্তির বিকাশে বিস্তর গবেষণা করছে। সেগুলো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় প্রতিষ্ঠানে নয়। এর সূচনা হয় স্কুল থেকেই। মনে পড়ল চীনে একবার আমাদের সুযোগ হয়েছিল শিশুদের রোবটিকস মেলায় অংশগ্রহণের। সেখানে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা রোবট প্রটোটাইপ বানিয়েছিল যেটি গাছ থেকে পাকা ফল পাড়তে সক্ষম। রোবটের মাধ্যমে হারভেস্টের চিত্র আমরা দেখেছিলাম নেদারল্যান্ডসের তরুণ ইয়ন ফান ডের অলেখের ক্যাপসিকাম ফার্মেও।

মূলত কাস্টমার যাতে খুশি থাকে তার সবটাই ফেনোমিয়া পূরণ করতে চায়। ইলকা আমাদের নিয়ে গেলেন কোল্ড স্টোরেজের আকার কেমন হতে পারে তা দেখাতে। তারপর দেখালেন সর্টিং রোবট। বিশাল যন্ত্রটির নাম রোবো সিলিন্ডার। মানহীন ফল-ফসল সর্টিং-এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এতে আছে তিনটি ক্যামেরা। যা ঘণ্টায় ২০০ কিমি গতিতে থাকা কৃষিপণ্যের ছবি তুলতে পারে।

ফল-ফসল সংরক্ষণে ফেনোমিয়ায় গবেষণা ও কার্যক্রম তাদের ফল-ফসল উত্তোলনের পর অপচয় কমিয়ে এনেছে, অক্ষুণ্ন রাখছে পুষ্টিমান। সময় স্বল্পতায় ফেনোমিয়ার সব কিছু দেখার সুযোগ পেলাম না। তবে বৈচিত্র্যপূর্ণ গবেষণা দেখে খুব আপ্লুত হলাম।

প্রযুক্তিই পৃথিবীকে ছোট করে এনেছে। আমরা এখন গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক। এতে যোগাযোগ যেমন সহজ হয়েছে, বেড়েছে বাণিজ্যের পরিধি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে উন্নত দেশগুলো যেখানে কৃষি উৎপাদনে রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কাটিং এজ প্রযুক্তির প্রয়োগ করছে; সেখানে আমরা শতভাগ কৃষি মেকানাইজেশন থেকেই বহুদূর রয়ে গেছি। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে আনতে হবে।

আগামীর পৃথিবী কৃষি বাণিজ্যের পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে, উন্নয়নের পথে হাঁটতে হলে আমাদেরও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। কৃষি গবেষণা ও কৃষি শিক্ষায় মানগত পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের পথেই যেতে হবে। প্রত্যাশা আমাদের সরকার এ বিষয়গুলোর প্রতি সুনজর রাখবে। আমাদের কৃষি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসবে এ ধরনের গবেষণা নিয়ে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর