নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস হলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। সম্প্রতি ছাত্র ও জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ইচ্ছানুযায়ী তিনি এই দায়িত্ব নিলেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁর নেতৃত্বে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠিত হবে। খ্যাতিমান এই অর্থনীতিবিদের জন্ম ১৯৪০ সালে চট্টগ্রামে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন চট্টগ্রামেই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি বয়েজ স্কাউটসে যোগ দেন এবং বয়েজ স্কাউটসের পক্ষ থেকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিকসে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন।
বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে তিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের চরম দুর্ভিক্ষের সময় তিনি এ দেশের গরিব মানুষের কল্যাণে কাজ করতে শুরু করেন এবং স্বল্প পরিমাণ ঋণ দিয়েও যে দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব তা তিনি গবেষণায় সফলতা পান। অতঃপর দরিদ্র মানুষের জন্য চালু করেন গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন গরিবদের মধ্যে ঋণ দেওয়ার জন্য। তখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে এবং এর সদস্যবৃন্দ একে অন্যের জামিনদার হিসেবে থাকে এবং একে অন্যের উন্নয়নে সাহায্য করে।
পরবর্তীতে ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্পসহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা। গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশ গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হয়। অতঃপর ২০০৬ সালে দরিদ্র মানুষদের, বিশেষ করে মহিলাদের সাহায্য করার জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও ১৯৭৮ থেকে অধ্যাপক ইউনূস নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ১৪৫টি পুরস্কার অর্জন করেছেন। এযাবৎ সারা পৃথিবীর ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। আধুনিক বিশ্বে ঋণের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে স্থায়ীভাবে উদ্ধার করা যায় - এই গবেষণার রূপকারের জন্য তিনি আজ বিশ্বব্যাপী নন্দিত। অতি সম্প্রতি ছাত্র গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিলেন। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন মানেই ইতিহাস পরিবর্তন। ’৫২, ’৬৯, ’৭১, ’৯০-এ দেশ গঠনে ছাত্রদের ঐক্য ও আন্দোলনের কথা এবং অধিকার আদায়ে তাদের গৌরবময় ভূমিকার কথা দেশবাসী দেখেছেন। ২০২৪ সালেও তাই হয়েছে। একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে দেশ পরিচালিত হবে এটাই ছিল ছাত্র-জনতার ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর এরকম একটি পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব দল ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত কোনো সরকারই এই অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারিনি, আবির্ভূত হয়েছে স্বৈরাচার হিসেবে। ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইচ্ছামতো একতরফা ভোটের আয়োজন করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে, ভিন্নমত পোষণকারীদের জেলে ঢুকিয়েছে, হাজার কোটি টাকা শুধু বিদেশেই প্রচার করেনি, ঘরের মধ্যেও রেখেছে বস্তা ভরে, উন্নয়নের নামে করেছে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ। অবশেষে লাখ লাখ কর্মীকে বিপদে ফেলে দেশত্যাগ করেছে। এসব অপকর্ম আর দেখতে চায় না এ দেশের মানুষ। তাই আগামীতে যেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই তা হলো : ১. প্রত্যেকটি মিডিয়া কারও কোনো তাঁবেদারি করবে না, সত্যি তথ্যটা মানুষের কাছে তুলে ধরবে, ২. এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা চাই যেটা দিয়ে আমরা পুরো বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারব, ৩. এমন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা চাই যেটা একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকেও নিশ্চিন্তে সেবা নিতে পারবে, ৪. এমন একটি বিচারব্যবস্থা চাই যেখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নিশ্চিন্তে স্বচ্ছ একটি বিচার পাবে, ৫. এমন একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাই যেটি সবার আস্থার জায়গা হবে। থাকবে না কোনো হয়রানি, ঘুষ বা অবৈধ লেনদেন বন্ধ হবে, সবকিছুই হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে একজন অভিভাবক হিসেবে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এরকম একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে, এই আশা ও প্রত্যাশাই দেশবাসীর।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়