মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এ বছর ডিসেম্বরের ১ তারিখে জাতি পেল এক সুখবর। ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে হাই কোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করেছেন। এর ফলে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অন্যরা। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চের রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালত যে প্রক্রিয়ায় বিচার করেছেন, তা ছিল অবৈধ। আদালত বলেছেন, দ্বিতীয় অভিযোগপত্র অতিমাত্রায় বেআইনি। কারণ দ্বিতীয় অভিযোগপত্র নিয়ে আইনের যে বিধান আছে, তাতে অফিসার ইনচার্জ নতুন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিতে পারেন। কিন্তু দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আনা হয়েছে পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনে। এই আবেদনটি মঞ্জুর করে আদালত যখন মামলাটি পুনঃ তদন্তের জন্য পাঠান, পুনঃ তদন্তের প্রতিবেদন আসার পর সেই অভিযোগপত্র কোনো ম্যাজিস্ট্রেট গ্রহণ করেননি। সরাসরি এটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। মহানগর দায়রা আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৩ ধারা অনুসারে আমলে নিয়েছেন। কিন্তু ১৯৩(১) অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ আমলে না নিলে মহানগর দায়রা আদালতে দাখিল হতে পারে না। রায়ে হাই কোর্ট আরও বলেন, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৩(১) ধারা অনুসরণ করা হয়নি। ফলে তা আমলে নেওয়া বেআইনি এবং আইনের দৃষ্টিতে তার কোনো কার্যকারিতা নেই। তা ছাড়া প্রথম অভিযোগপত্রটিও গ্রহণযোগ্য না। কারণ ওই অভিযোগপত্রটিও মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে; যা তিনি পরে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট বাদ দিয়ে ২২৫ জন সাক্ষীর কেউই বলেননি আমি গ্রেনেড ছুড়েছি বা ছুড়তে দেখেছি। ফলে প্রকৃত খুনি কে সেটি নেই। এখানে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।
সবার জানা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জাতীয় সংসদে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতা-কর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। তদন্ত শেষে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২।
যাঁদের মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নান এবং তাঁর সহযোগী শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর হয়। আরেকজন মারা যান কারাগারে। বিএনপির নেতৃত্বে সে সময় ক্ষমতায় ছিল চারদলীয় জোট সরকার। জোট সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে এ ঘটনা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার গ্রেনেড হামলার নিন্দাই শুধু নয়, এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আইনগত পদক্ষেপও নেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে ব্যবহার করে নগ্নভাবে। দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে গ্রেনেড হামলায় জড়িত করা হয় বিকৃত মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়ে। এ বছরের ডিসেম্বরের প্রথম দিন সে মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন বিচারিক আদালতে অভিযুক্ত সবাই। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসে অর্জিত হলো আরেক মহান বিজয়।
হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে কোনো কল্যাণ নেই। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিঃসন্দেহে এক জঘন্য অপরাধ। এ ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের প্রতি সদয় হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যে কোনো বিবেকবান মানুষ এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানোার গরজ নৈতিক কারণেই অনুভব করবে। একইভাবে জঘন্য সন্ত্রাসী ঘটনাকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য যারা ব্যবহার করতে চেয়েছে, তারাও নিন্দার দাবিদার। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে ফাঁসানোর জন্য বিচার প্রহসনের নীলনকশা এঁটেছিল পতিত সরকারের কুশীলবরা। তারা মানসিকভাবে কতটা অসুস্থ হলে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় আক্রান্ত হতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়।
স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জড়ানো হয়েছিল ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার জন্য। যাতে শহীদ জিয়ার পুত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে না পারেন। তাদের সে উদ্দেশ্য চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবন ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা চাপানো হয়েছে বিগত ১৫ বছরে। আওয়ামী লীগ সরকার মামলাবাজ হিসেবে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপনের পণ করেছিল। এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা তাদের জনগণের থেকে ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন করেছে। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল বলেই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ভয়ে ক্ষমতাদর্পী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
দেড় দশক ধরে আওয়ামী শাসনামলে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে এসব মামলা। অন্তর্বর্তী সরকার পতিত সরকারের আমলে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ বিষয়ে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। কারণ সব মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর এমনকি যুগের পর যুগ লেগে যাবে। দেশের লাখ লাখ মানুষকে হয়রানির কবল থেকে মুক্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে, এমনটিই দেখতে চায় দেশবাসী।
ডিসেম্বর মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাস। বাংলাদেশের মানুষ রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছিল এই বিজয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব ছোট ছিলাম। আমার আত্মীয়স্বজন অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন। আমি গর্বিত যে নরসিংদীর মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তার কোনো তুলনা নেই। স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশের মানুষ এ বছর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মাস ডিসেম্বর পালন করছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। নরসিংদীর মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঘাঁটি এলাকা গড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে অসীম সাহসিকতায়। ঠিক তেমনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা ছিল সামনের কাতারে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে নরসিংদীর সর্বস্তরের মানুষ লড়েছে জীবনবাজি রেখে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ না হলেও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে জেলজুলুমকে পরোয়া না করে লড়াই করার সুযোগ হয়েছে বলে আমি গর্বিত। আমি আশা করব আগামী বছরের বিজয় দিবসের আগেই বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচিত সরকারের মুখ দেখবে। এ লক্ষ্য পূরণে দলমতনির্বিশেষে সবাই সরকারকে সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত। দেশবাসীর সহযোগিতা নিশ্চিত করতে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণায় সরকারকে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। গণমানুষের ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য বজায় রাখতে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে নিতে হবে ইতিবাচক উদ্যোগ। আইনশৃঙ্খলার রাশও টেনে ধরতে হবে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক