সহযোগীদের অনুরোধে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত সৈকত শহর ফুকেট যেতে হলো। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের প্রায় শেষ প্রান্তে আন্দামান সাগরে অবস্থিত শহরটি বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। ব্যাংকক থেকে দূরত্ব ৮৬২ কিলোমিটার। ১৩ ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছেছিলাম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নৈশ বাসে। ফুকেট কথার অর্থ থাই ভাষায় পর্বতমণি। সেখানে অনেক আকর্ষণীয় সৈকত রয়েছে, যার ঝাউবন চোখ জুড়িয়ে দেয়। মাই-খাও হচ্ছে ফুকেটের দীর্ঘতম সৈকত। টিলা এবং পাহাড়ময় ফুকেট। আমরা একটি ছোট পাহাড়ে উঠেছিলাম, যে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় আধুনিক ও প্রাচীন ফুকেট শহর। এ পাহাড়ের নাম খাও-রং। শহর থেকে একটু দূরে রয়েছে পাটং বিচ। সেখানে জলক্রীড়ার বন্দোবস্ত আছে। ফুকেট থেকে স্টিমারে মাত্র দুই-আড়াই ঘণ্টায় ফি ফি নামক আশ্চর্য দ্বীপে পৌঁছা যায়।
উত্তর ফি ফি-এর তটভূমি প্রবাল আস্তরণে গঠিত। দক্ষিণ অঞ্চলের পুরোটাই চুনাপাথরের তৈরি। দেখেছি রঙিন প্রবাল ও নানা প্রজাতির মাছ বিচিত্র আকৃতি ও বিভিন্ন রঙের। দক্ষিণে বিখ্যাত ভাইকিং কেভ, কোনো তটভূমি নেই, খাড়া পাহাড় সোজা নেমে গেছে আন্দামান সমুদ্রে। পানির ঘর্ষণে পাহাড়ের গায়ে আঁকা চিত্রগুলো হয়ে উঠেছে ভাইকিংদের জাহাজের মতো। ফুকেটে দুই বোনের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি সৌধটি দেখে কিছু সময় ভাবনায় পড়েছিলাম। এ দুই বীর বোনের নেতৃত্বে ফুকেটবাসী ১৭৮৫ সালে বার্মিজদের ফুকেট থেকে বিতাড়িত করেছিল। ওয়াট ফ্রাং থং-এ রয়েছে গৌতমবুদ্ধের স্বর্ণনির্মিত মূর্তি এবং ফ্রা নাং সাং-এ আনুমানিক হাজার বছরেরও প্রাচীন আবক্ষ বুদ্ধমূর্তি।
ফুকেটের অন্যতম আকর্ষণ প্রজাপতি। এখানে প্রজাপতিদের আবাসস্থল বাটারফ্লাই গার্ডেন অ্যান্ড ইনসেক টোরিয়াম। সেখানে খেলছে অসংখ্য প্রজাপতি। থাইল্যান্ডের মার্শাল আর্ট শো দেখাও হলো। গিয়েছিলাম চিয়াংমাই। এটি উত্তর থাইল্যান্ডের একটি প্রাচীন শহর, যার পরিচিতি ফুলের শহর হিসেবে। ৭০০ বছরের পুরনো ফুলের শহর এখনো চির নতুন। ব্যাংকক থেকে এ শহরের দূরত্ব ৬৯৬ কিলোমিটার। থাইল্যান্ডের বিখ্যাত উৎসবের মধ্যে চিয়াংমাইয়ের ‘ফুল উৎসব’ খুবই বিখ্যাত। ফুল সাজানো এবং অন্যান্য গাছের চাষ করার উৎসাহ দেওয়ার জন্যই এ উৎসব। ফেব্রুয়ারিতে উৎসব হয়। দেখার জন্য ভিড় জমান নানা দেশের পর্যটক। ফুল সম্পদের জন্য চিয়াংমাই থাইবাসীর কাছে ভূস্বর্গ। থাইল্যান্ডে রয়েছে অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির। সংখ্যা ১ হাজার ২০০-এর মতো। ওয়াট ফ্রা সিং-এ রয়েছে আনুমানিক ১ হাজার বছর আগে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি ফ্রা সিং। রয়েছে প্রাচীনতম মন্দির ওয়াট চিয়াং মান। এখানে দেখেছি বুদ্ধমূর্তি ওয়াট-কেও-খাও। হাজার বছরের পুরনো এ প্যাগোডাটি রঙিন পোর্সিলিনের টুকরো দিয়ে সজ্জিত। ওয়াট সুয়ান ডক-এ দেখেছি ৫০০ বছরের পুরনো ব্রোঞ্জনির্মিত বুদ্ধমূর্তি। একটি প্যাগোডা দেখলাম ঠিক বৌদ্ধগয়ার মন্দিরের আদলে। দেখা হলো পৃথিবীর বিখ্যাত মন্দির ফ্র-থাট-দয়-টুং। এ মন্দিরের ১ হাজার ৩৬৪ মিটার উঁচু মিনারে সংরক্ষিত আছে গৌতমবুদ্ধের বাঁ-দিকের কলার বোন। দেখা হলো ইতালিয়ান মার্বেলে তৈরি রাজা নবম রাম-এর মন্দির ওয়াট বেঞ্চামা বোফিট। গঠন গির্জার মতো। ব্যাংকক থেকে ৭৬ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ভগ্নপ্রায় অযোধ্যা। ১৩৫০ থেকে ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত এ শহর ছিল থাইল্যান্ডের রাজধানী। ঐতিহাসিক এই রাজধানী বারবার আক্রান্ত ও অধীকৃত হয়েছে বার্মিজদের দ্বারা। ১৭৬৭-তে শহরটির দখল নিয়ে পুরোটাই ধ্বংস করে দেয়। শুনছি থাই জাত্যভিমান প্রতিবারই শত্রুদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। তারা অযোধ্যা ফিরে পেয়েছে। ব্যাংকক থেকে আমরা মাত্র দেড় ঘণ্টায় অযোধ্যায় পৌঁছে যাই। একজন পর্যটক বলেছেন ১৯৯১ সালে ইউনেস্কো অযোধ্যাকে হেরিটেজ সেন্টার হিসেবে ঘোষণা করে। ১৩৫০ সালে রাজা উথং সাংফ্রাং নদীর তীরবর্তী নবনির্মিত রাজধানীর নামকরণ করেন অযোধ্যা। চৌদ্দ শতকে নির্মিত রাজকীয় প্রাসাদ ও মন্দির রয়েছে। অযোধ্যার ধ্বংসস্তূপ থেকে চিনে নেওয়া যায়। ওয়াট ফ্রা শ্রীসানফেটকে। ১৯৬৮-এর অনেক পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত অযোধ্যা থেকে থানবুড়িতে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
শাসনক্ষমতা হাতে পান চক্রী বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ফ্লাকুত্তায়োকা কুলালোকের কাছে। এই কুলালোকই ইতিহাসে রাজা প্রথম রাম নামে অভিহিত হতে থাকেন। রাজা প্রথম রাম রাজধানী আরও দক্ষিণে সরিয়ে এনে বর্তমানে ব্যাংককে স্থাপন করেন। অবহেলিত থাকতে থাকতে একসময় ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ফিরে পেয়েছে তার লুপ্ত মর্যাদা। একসময় ব্যাংককে সাওফ্রায়া নদীতে নাকি ভাসমান বাজার বসত।
লেখক : প্রাবন্ধিক