প্রতি বছর পবিত্র রমজান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে খেজুরের চাহিদা এবং এর বাজার পরিস্থিতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রমজানে খেজুর যেন অপরিহার্য পণ্য বিবেচিত হয়। ইফতারে খেজুর রাখার পেছনে ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে।
চাহিদা ও আমদানি পরিস্থিতি : দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন। যার মধ্যে প্রায় ৬০-৭০ হাজার মেট্রিক টন শুধু রমজান মাসেই ব্যবহৃত হয়। খেজুর আমদানির প্রধান উৎসগুলো হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইরাক, তিউনিসিয়া এবং আলজেরিয়া।
সৌদি আরব : সৌদির আজওয়া ও আম্বার খেজুর বাংলাদেশে জনপ্রিয়। এই খেজুরের দাম তুলনামূলক বেশি হলেও মান উচ্চ হওয়ায় ভোক্তারা তা কেনেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত : আমিরাতের দুবাই খেজুরের বড় এক্সপোর্ট হাব। এখান থেকে বিভিন্ন জাতের খেজুর কম খরচে আমদানি করা যায়। দুবাইয়ের খেজুর বাজারজাত সহজ হওয়ায় বাংলাদেশে এর দামও তুলনামূলকভাবে সহনীয়।
মিসর : মিসরীয় ডেগলেট নুর এবং অন্যান্য জাতের খেজুর গুণগত মান এবং সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে বাংলাদেশের বাজারে চাহিদাসম্পন্ন। মিসর থেকে খেজুর আমদানিতে সুবিধাজনক চুক্তির ফলে এটি বাজারের মূল্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়ক হয়। পবিত্র রমজানে খেজুরের চাহিদা অসীম। ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইফতারে খেজুরকে সুন্নত বিবেচনা করেন। গত বছর রমজানের আগে খেজুর আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি (সিডি) ২৫% থেকে হ্রাস করে ১৫% নির্ধারণ করলেও ভোক্তারা বিশেষ সুবিধা পাননি। এর কারণ আমদানি সংশ্লিষ্ট শুল্ক স্টেশনসমূহে বর্তমানে খেজুরের মানভেদে প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ১ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৪ ডলারের মধ্যে শুল্কায়ন করা হয়, যা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য থেকে অনেক বেশি। দেশের আমদানিকারকরা সাধারণ মানের খেজুর ইরাক থেকে আমদানি করেন। ইরাকে বর্তমানে মাঝারি মানের যে খেজুর প্রতি মেট্রিক টন ৭০০-৮০০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়। সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতি মেট্রিক টন খেজুর আমদানির জন্য ৮১৫ ডলারে এলসি খুলেছে। অন্যদিকে রেফার কনটেইনারে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি টন খেজুরের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৪ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। রেফার কনটেইনারে শুধু উন্নতমানের খেজুর নয়, সাধারণ মানের খেজুরও গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য আমদানি করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে বিকল্প পথে খেজুর আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে লিড টাইম বৃদ্ধি পাওয়ায় খেজুরের গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য রেফার কনটেইনারের ব্যবহার বাড়ছে। এর ফলে যে পরিমাণ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, শুল্কায়নযোগ্য মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ আমদানিকারক ও ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। খেজুর সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ মিসর, তিউনিসিয়া এবং আলজেরিয়া থেকে আমদানি হয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের মূল্য থাকায় দেশভিত্তিক আমদানি মূল্য নির্ধারণ করা হলে উচ্চহারে শুল্কায়নের যে নেতিবাচক প্রভাব, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া খেজুর আমদানিতে ১০% হারে অগ্রিম আয়কর প্রদান করতে হয়, যা পরবর্তীতে সমন্বয় করার সুযোগ না থাকায় প্রদত্ত আয়কর ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করার কারণে খেজুরের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
খেজুর রমজানকেন্দ্রিক পণ্য হলেও সরকারের আমদানি নিরুৎসাহিতকরণের লক্ষ্যে বিলাসবহুল পণ্য বিবেচনায় আমদানির জন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন আরোপ করে রেখেছে। ফলে ব্যাংকগুলো শতভাগ মার্জিন ছাড়া এলসি না খোলায় খেজুর আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিকে খেজুর আমদানিতে উচ্চহারে শুল্ক, অন্যদিকে এলসি খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন থাকায় খেজুরের স্থানীয় মূল্য বৃদ্ধি পায়। বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী আমদানি করা পণ্যের মোড়কে আমদানিকারকের নাম ও ঠিকানা স্পষ্ট অক্ষরে লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সমাধানের পথ : ক) আসন্ন রমজানে খেজুরের বর্ধিত চাহিদা ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতা বিবেচনায় সুনির্দিষ্ট মেয়াদে খেজুর আমদানিতে বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও অন্যান্য করাদি ছাড় প্রদানের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে; (খ) খেজুর আমদানিতে আমদানি সংশ্লিষ্ট শুল্ক স্টেশন কর্তৃক আরোপিত বিদ্যমান শুল্কায়নযোগ্য মূল্য খেজুরের গুণগত মান ও আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বিবেচনায় শুল্কায়নযোগ্য মূল্য পুনর্নির্ধারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে; (গ) খেজুর আমদানির জন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ এলসি মার্জিনের শর্ত শিথিল করে ব্যাংক ও গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে পারে; (ঘ) খেজুরের বাজারমূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল করতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।
লেখক : পরিচালক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ