বৈশ্বিক উষ্ণতা বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুতর এবং সংকটপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে, এটি আরও গভীর এবং সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠেছে, যা বিশ্বের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য এক বিরাট হুমকি। আজকের দিনে, পরিবেশগত সংকটের চেয়ে বড় কোনো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ নেই, যা আগামী প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
২০২৫ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগে থেকে প্রায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে গ্রিনহাউস গ্যাসের অতিরিক্ত নিঃসরণ দায়ী। প্রধানত কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের অতিরিক্ত নিঃসরণ জলবায়ুর ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করছে। বন নিধন, শিল্প উৎপাদন, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার এবং কৃষি খাতে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এসব সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি শিল্পায়ন এবং অস্বাস্থ্যকর নগরায়ণের কারণে এই গ্যাসগুলোর নিঃসরণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে তা মানবজাতির জন্য আরও মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব উষ্ণতার আরও বাড়তে থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি খাতে সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। বৈশ্বিক উষ্ণতা তাই শুধু পরিবেশেরই নয়, বরং মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালে বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা এবং পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব সরাসরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর পড়ছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, দাবদাহ, খরা এবং অন্যান্য চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি আগের তুলনায় আরও বেশি তীব্র এবং ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চল এবং দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলো এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লাখ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারাচ্ছে এবং ভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে মালদ্বীপের মতো দেশগুলোর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে, যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জমির ক্ষয় এবং পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে কৃষি খাতে বিশাল প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, বিশেষত গরম অঞ্চলের দেশগুলোতে। দীর্ঘ খরা, অনিয়মিত বৃষ্টি এবং তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি কৃষকদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ক্রমশ সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০ ভাগ জনগণ এখন খাদ্যঘাটতির মুখে রয়েছে। গম, চাল, ভুট্টা এবং অন্যান্য প্রধান ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনের মান আরও খারাপ হচ্ছে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র দেশগুলোর জন্য এটি এক কঠিন সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার কারণে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা বহু প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অম্লতার মাত্রা বাড়ানোর ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যও সংকটে পড়ছে। প্রবাল প্রাচীরের ধ্বংস এবং মাছের প্রজাতির হ্রাস জীববৈচিত্র্যের জন্য এক বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে প্রাকৃতিক বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। এর ফলে বহু প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অনেক প্রজাতি একেবারে বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে, যা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যকে চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্য এবং জীবনধারায় প্রতিফলিত হচ্ছে। তীব্র গরমের কারণে হিট স্ট্রোক এবং তাপ-সম্পর্কিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব স্বাস্থ্যঝুঁকি মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলার জন্য ২০২৫ সালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্যারিস চুক্তির আওতায় বিভিন্ন দেশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপ বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈশ্বিক উষ্ণতা আর একদিনের সমস্যা নয়। এটি এখন এক গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী সংকট, যা শুধু পরিবেশ নয়, বরং মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, এটি স্পষ্ট যে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর জন্য সর্বস্তরে সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। এখনই পদক্ষেপ নিলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারব। তবে যদি আমরা আরও বিলম্ব করি, তবে তা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য অনুগ্রহের পরিবর্তে এক ভয়াবহ পরিণতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।