ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে হজ তার অন্যতম। হজ আল্লাহ ও বান্দার মাঝে এক গভীর প্রেমময় সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। বান্দাহ ও রবের মাঝে নিঃশর্ত আনুগত্যের একটি হৃদয়কাড়া ঝলক ফুটে ওঠে হজের মাধ্যমে। কালো গিলাফে ঢাকা বাইতুল্লাহর দিদারে পাগলপারা হয়ে ওঠে প্রতিটি মুমিনের মন। বারবার ছুটে যেতে চায় হৃদয়প্রশান্তির অনন্য ঠিকানা কাবার পানে। বারবার পেতে চায় বাইতুল্লাহর সান্নিধ্য। মাটির পৃথিবীতে আল্লাহর ঘর- ভাবতেই দেহমনে প্রশান্তির এক শীতল পরশ বয়ে যায়। হজ একটি আরবি শব্দ। শাব্দিক অর্থ সংকল্প করা। শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতির আলোকে নির্ধারিত সময়ে বাইতুল্লাহ শরিফ জিয়ারত করাকে হজ বলে। আল্লাহর ঘরে যেতে সামর্থ্য রাখে এমন প্রাপ্তবয়স্ক স্বাধীন মুসলমানের ওপর জীবনে একবার আল্লাহর ঘরে যাওয়া তথা হজ করা অপরিহার্য বিধান। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বাইতুল্লাহ শরিফে) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের ওপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ করা ফরজ (আলে ইমরান-৯৭)।’ সামর্থ্যরে ব্যাখ্যা হচ্ছে- আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার পাথেয় ও বাহনে সক্ষম হওয়া (মুসতাদরাক-১৬১৩)।
মানুষের ইবাদতের জন্য তৈরি সর্বপ্রথম ঘর হচ্ছে বাইতুল্লাহ শরিফ। মক্কাতুল মোকাররমায় নির্মিত কালো গিলাফে ঢাকা কাবাঘরটিই মুমিনের মর্যাদা বৃদ্ধি ও বরকত লাভের এক অনন্য মাধ্যম। ইরশাদ হয়েছে, বাস্তবতা এই যে মানুষের (ইবাদতের) জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরি করা হয়, নিশ্চয়ই তা সেটি, যা মক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় এবং সমগ্র জগতের মানুষের জন্য হিদায়াতের উপায় (সুরা আলে ইমরান-৯৬)।
মসজিদে হারাম বা বাইতুল্লাহ শরিফ পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম মসজিদ। দ্বিতীয় মসজিদ হচ্ছে আল মাসজিদুল আকসা।
ইবরাহিম (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাস্তায় বসে আমার পিতার নিকট কোরআন পাঠ করতাম, যখন আমি সিজদার আয়াত পাঠ করলাম তিনি সিজদা করলেন, তখন আমি বললাম আব্বা! আপনি রাস্তায় সিজদা করছেন! তিনি বললেন, আমি আবুজর (রা.)-কে বলতে শুনেছি, আমি রসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোন মসজিদটি প্রথম নির্মিত হয়? তিনি বলেছিলেন, মসজিদুল হারাম। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল আকসা। আমি বললাম, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। আর জমিন তোমার জন্য মসজিদ (সিজদার স্থান)। অতএব যেখানেই সালাতের সময় হবে, সালাত আদায় করবে (সুনানে আন-নাসায়ী-৬৯০) বাইতুল্লাহ শফিমুমিনের হৃদয় প্রশান্তির অনন্য ঠিকানা। বারবার দেখেও তার আশ মেটে না। কেনই বা আশ মিটবে! আল্লাহ যে এই ঘরকে বারবার ফিরে আসার জায়গা বানিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-(আর স্মরণ কর সেই সময়ের কথা) যখন আমি বাইতুল্লাহকে পরিণত করি বারবার ফিরে আসার জায়গা এবং পরিপূর্ণ নিরাপত্তার স্থানে (সুরাতুল বাকারা-১২৫)।
হজের কার্যাবলি হজরত ইবরাহিম খলিল (আ.) ও তাঁর পরিবারের সীমাহীন ত্যাগ ও কোরবানির স্মারক। হজরত ইবরাহিম (আ.) তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)কে নিয়ে বাইতুল্লাহ শরিফ পুনর্নির্মাণ করেন। আল্লাহতায়ালার নির্দেশে তিনি হজের ঘোষণা দেন। ইরশাদ হয়েছে- এবং সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহিমকে সেই ঘর (অর্থাৎ কাবাগৃহ)-এর স্থান জানিয়ে দিয়েছিলাম। ১৬ (এবং তাকে হুকুম দিয়েছিলাম) আমার সঙ্গে কাউকে শরিক কর না এবং আমার ঘরকে সেই সব লোকের জন্য পবিত্র রেখ, যারা (এখানে) তাওয়াফ করে, ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় এবং রুকু-সিজদা আদায় করে। এবং মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদযোগে এবং দূরদূরান্তের পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যেগুলো (দীর্ঘ সফরের কারণে) রোগা হয়ে গেছে (সুরাতুল হজ : ২৬-২৭)। হজ ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম। সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর হজ আবশ্যকীয় একটি আমল।
ইবনু ‘উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি।
১. আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল-এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। ২. সালাত কায়েম করা। ৩. জাকাত আদায় করা।
৪. হজ সম্পাদন করা এবং ৫. রমজানের সিয়ামব্রত পালন করা (রোজা রাখা) (সহিহ বুখারি-৮)।
প্রেমময় হজের মৌসুম চলছে। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ইতোমধ্যে অনেকেই হারামাইন শরিফাইনে চলে গিয়েছেন। তারা হজ আদায়ের অপেক্ষায় আছেন। আল্লাহ তাদের হজে মাবরুর নসিব করুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বারবার বায়তুল্লাহ শরিফে হাজিরা দেওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক : খতিব; আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর