একদিন আমাকে একজন ফোন দিয়ে বললেন, ‘চাঁদপুর থেকে বলছি। আমার নাম কামরুজ্জামান প্রধানিয়া। আমার বাগানে মিষ্টি আঙুর ফলেছে। আপনি কি একবার দেখতে আসবেন?’
গত শতকের নব্বই দশক থেকে দেশে আঙুর চাষের চেষ্টা চলেছে। দেশের মাটিতে আঙুরের ফলন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাদ ছিল টক। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তখনো জানত না আঙুর গাছ দেখতে কেমন। গাজীপুরের কাশিমপুর এস্টেটের আঙুর চাষের দৃশ্য টেলিভিশনে তুলে ধরার পর অনেক দর্শক আমাকে চিঠি লিখেছিলেন। বলছিলেন, কোনোমতেই সেটি বাংলাদেশের দৃশ্য নয়। পরের সপ্তাহে আমি পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের একদল শিক্ষার্থীকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। শিক্ষার্থীরা গাছে থোকা থোকা আঙুর ঝুলে থাকতে দেখে অভিভূত হয়েছিল। কিন্তু আঙুর খেয়ে তেমন খুশি হতে পারেনি। কারণ সেই আঙুর স্বাদে ছিল টক। ফলে তখন আঙুর চাষের সম্প্রসারণ তেমন ঘটেনি। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে বাড়ির কোণে বা ছাদে অনেকেই আঙুর চাষের চেষ্টা করেছেন। আমি আঙুর চাষের ক্যাম্পেইন করেছিলাম এই ভেবে যে টক হলেও ভিটামিন ও পুষ্টি তো পাওয়া যেত সেই আঙুর থেকে।
আঙুর চাষের উৎপত্তি মূলত পশ্চিম এশিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। বিশেষ করে বর্তমান ইরান, তুরস্ক এবং ককেশাস অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই আঙুরের চাষ হয়ে আসছে। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম আঙুর চাষ শুরু করে এবং পরবর্তী সময়ে তা ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষের ইতিহাস একেবারেই নতুন। এই সময় ভাবাই যেত না দেশে ফলভারে নত গাছে এক আঙুরের থোকা থোকা সৌন্দর্য দেখা যাবে। কিন্তু সময় বদলেছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি আর কৃষকের প্রচেষ্টায় এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠছে আঙুরের বাগান। চাঁদপুরে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন স্থানীয় উদ্যোক্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রধানিয়া। তার আমন্ত্রণে এক সকালে গিয়ে উপস্থিত হলাম তার আঙুর বাগান দেখতে। সদর উপজেলার চাঁদপুর-মতলব সড়কের পাশে মাত্র ২০ শতক জমিতে বিদেশি এই ফলের চাষ শুরু করেছেন তিনি। থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা সবুজ আঙুর পথচারীদের দৃষ্টি কাড়ছে প্রতিনিয়ত। আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসছেন অনেক দর্শনার্থীও।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফলের চাষ একসময় ছিল না। মানুষ মূলত নিজের জন্য বসতবাড়ির আশপাশে ফলের চাষ করত। সময়ের পরিবর্তনে কৃষক এখন ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন। বলা যায়, গত দুই দশকে বাণিজ্যিক চাষের সাফল্যের কারণে দেশে ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১০টি শীর্ষ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল (ট্রপিকাল ফ্রুট) উৎপাদনকারী দেশের একটি। দেশি ফলের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের বিদেশি ফলের চাষ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা শুধু কৃষক নন, কৃষি পেশার বাইরে অন্য পেশায় নিয়োজিতরাও উদ্যোগী হয়েছেন ফল চাষে। গত এক যুগে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২২ শতাংশ। কম জমিতে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় এখন আমরা। আবার ফল চাষের জমি বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। এই হিসাবে, বছরে ফল চাষের জমি বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, দেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও দ্বিগুণ হয়েছে গত এক যুগে। ২০০৬ সালের এক হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে দিনে প্রায় ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত। বর্তমানের হিসাবে সেটি প্রায় ৮৫ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। যা দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং নিরাপদ পুষ্টি গ্রহণ অবস্থার উন্নয়নের একটি বার্তা। দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, লিচু ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ফল উৎপাদনের চিত্র দেখিনি। অথচ গত দুই দশকে নতুন নতুন ফল ফসলে বদলে যাওয়া বহু এলাকার চিত্র দেখছি। কৃষক, উদ্যোক্তাদের মাল্টা, ড্রাগন, পেয়ারা, কুল, কমলা, লটকন ও অ্যাভোকাডোর মতো পুষ্টিকর ফল উৎপাদনে সফল হয়েছেন অনেকে।
যা হোক করোনা মহামারির পরে ২০২১ সালে ছাদে আঙুর চাষ দিয়ে যাত্রা শুরু করেন কামরুজ্জামান। ছয় মাস আগে তিনি বাণিজ্যিকভাবে চাষের জমিতে আঙুর চাষ শুরু করেন। ইতোমধ্যে তার বাগানে ৪৪টি জাতের আঙুরের মধ্যে ১২০টি মাতৃগাছে ফুল ও ফল এসেছে। তার এই প্রয়াসে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন জেলার অনেক তরুণ উদ্যোক্তা।
কামরুজ্জামান বলেন, ‘প্রথমে ছাদে আঙুর চাষ শুরু করি। ২০২৩ সাল থেকে ভালো ফলন পেতে শুরু করি। এরপর বাণিজ্যিকভাবে চাষে মনোযোগ দিই। আমার বাগানে গ্রিন লঙ, একেলো, বাইকো নুর, লোরাস, ভেলেজ, ডিকসন, সুপার নোভা ও নারু সিডলেস জাতের আঙুর চাষ করছি।’
কথা বলি সেখানে উপস্থিত কয়েকজন দর্শনার্থীর সঙ্গে। তারা জানান, আঙুর চাষে আগে সাফল্য পাননি। তবে কামরুজ্জামানের সফল বাগান দেখে আবার উৎসাহিত হচ্ছেন। কামরুজ্জামানের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন ভবিষ্যতে নিজ উদ্যোগে চাষাবাদের লক্ষ্যে।
চাষ উপযোগী মাটি ও পরিবেশ সম্পর্কে কামরুজ্জামান বলেন, ‘আঙুর চাষে দো-আঁশযুক্ত লালমাটি, জৈবিক সারসমৃদ্ধ কাঁকরজাতীয় মাটি এবং পাহাড়ি পাললিক মাটি সবচেয়ে উপযোগী। জমি অবশ্যই উঁচু হতে হবে, যাতে পানি জমে না থাকে এবং প্রচুর রোদ পড়ে।’
বাংলাদেশে সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বরে আঙুর গাছ ছাঁটাই করা হয় এবং মার্চ-এপ্রিলে ফল আসে। এরপর শীতকালে আবার ফলন পাওয়া যায়। তবে আঙুরের ফল পাকার সময় বৃষ্টি হলে ফলের আকৃতি ও গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়। পাখির আক্রমণ থেকেও ফল রক্ষা করতে হয়। যথাযথ পরিচর্যা ও পরিমিত সার প্রয়োগে একটি গাছ বহু বছর ধরে ফলন দিতে পারে।
চাঁদপুরে এই প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে মিষ্টি আঙুর চাষ শুরু হওয়ায় কৃষি ও উদ্যোক্তা খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এই জেলায় বৃহৎ পরিসরে আঙুর চাষ সম্ভব। চাঁদপুরের মাটিতে বিদেশি এই ফলের এমন সফল চাষ ইতোমধ্যে জেলায় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বেকারত্ব দূরীকরণ ও তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে এটি এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান প্রধানিয়ার সফল প্রচেষ্টা এখন অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণার উৎস।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব