রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক সালমান শাহর কথা

‘আমার কাছে চিঠি এলো ওপারে যাবার’

‘আমার কাছে চিঠি এলো ওপারে যাবার’

অলঙ্করণ : শাকীর এহসানুল্লাহ

সালমান শাহ : ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ - ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬

‘চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর, হায়রে অনেক দিনের পর,

এই দুনিয়া ছাড়তে হবে এসেছে খবর, হায়রে এসেছে খবর...। কারও কাছে চিঠি আসে বাবা-মায়ের, কারও কাছে প্রেমিকার। আমার কাছে চিঠি এলো ওপারে যাবার, হায়রে ওপারে যাবার।’ ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবিতে সালমানের গাওয়া এই গানটি যে অল্প সময়ে সত্যি হয়ে যাবে তা কি কেউ ভুলেও কখনো কল্পনা করতে পেরেছিলেন। না, তারপরও গানটি সালমানের জীবনে অনাকাক্সিক্ষতভাবে সত্যি হয়ে গেল। সালমান শাহকে বলা হতো ঢাকাই ছবির সাফল্যের বরপুত্র। তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক। ঢালিউডের আকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে এই ক্ষণজন্মা তারকার। প্রয়াণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন আন প্যারালাল, চিরবিদায়ের পরেও হয়ে আছেন প্রবল জনপ্রিয় একজন মানুষ। সালমানের অভিনয় স্টাইল, পর্দায় তার সপ্রতিভ উপস্থিতি আর নায়কোচিত ইমেজ আজও অন্য তারকাদের কাছে অনুকরণীয়। ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান নির্মিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রুপালি পর্দায় তার অভিষেক। শুরুতেই বিশাল সাফল্য দিয়ে সালমান প্রাণসঞ্চার করেন মৃতপ্রায় চলচ্চিত্রে। তারপর শুধুই ইতিহাস। সালমান শাহ মানে দর্শকের ভালোবাসা আর চলচ্চিত্রের জন্য আশীর্বাদ। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬। শুধুই সাফল্যের পথে হেঁটে যাওয়া। প্রয়াণের মাত্র কদিন আগে কথা প্রসঙ্গে অকাল মৃত্যু নিয়ে সালমান শাহ বলেছিলেন, ‘শুধু আমার নয়, কারও ভাগ্যে যেন বিধাতা এমন মৃত্যু না লিখেন।’ বেঁচে থাকার জন্য যার আকুতি ছিল এমন, তিনি কী করে আত্ম অভিমানে নিজেকে সংহার করবেন। এমন প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। সালমান ছিলেন অভিনয়ে, আছেন হৃদয়ে, থাকবেন অনন্তকাল। সালমানের মৃত্যু নেই। আজ তার প্রস্থানের ২৪তম বার্ষিকী।

তাকে নিয়ে শ্রদ্ধাভরে  লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

স্বল্প সময়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ

১৯৮৫/৮৬ সালের দিকে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ‘কথার কথা’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ শিরোনামের একটি গানের মিউজিক ভিডিওতে হানিফ সংকেতের কণ্ঠে গাওয়া গানের প্রধান চরিত্র অপূর্বর ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমেই সালমান শাহ মিডিয়ায় প্রথম আলোচিত হন। তখন তিনি ইমন নামেই পরিচিত ছিলেন। এর কয়েক বছর পর আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘পাথর সময়’ নাটকে এবং কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছিলেন। মাত্র চার বছরের অভিনয় জীবনে ২৭টি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র, কিছু দর্শকপ্রিয় নাটক, টেলিফিল্ম এবং বিজ্ঞাপনে মানসম্মত কাজ করে গেছেন সাফল্যের এই বরপুত্র। দুটি চলচ্চিত্রে শ্রতিমধুর গানও গেয়েছেন।

 

রহস্যে ঘেরা মৃত্যু : কী ঘটেছিল সেদিন

১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘প্রেম পিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে যান সালমান শাহ। সেখানে তার সহশিল্পী ছিলেন নায়িকা শাবনূর। কিছুক্ষণ পর সালমান তার বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরীকে ফোন করে বলেন, তার স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে আসার জন্য। শ্বশুরের সঙ্গে সাউন্ড কমপ্লেক্সে এসে সামিরা দেখতে পান সালমান ও শাবনূর ঘনিষ্ঠভাবে খুনসুটি করছেন। সালমান প্রায়ই এ ধরনের খুনসুটি করতেন। এতে উত্তেজিত হন সামিরা। কিছুক্ষণ পর কমরউদ্দিন চলে গেলে সামিরাও দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। অবস্থা খারাপ দেখে একই গাড়িতে ওঠেন সালমান শাহ ও চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকার। সালমানের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেন সামিরা। তাকে বোঝাতে থাকেন বাদল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সালমান এফডিসির প্রধান ফটকের সামনে নেমে আড্ডা দেন, যা এর আগে কখনো করেননি। রাত ১১টার দিকে নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বি-১১ নম্বর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন বাদল খন্দকার। সামিরাও তখন ঘরে। সাড়ে ১১টার দিকে সালমান বেডরুমে গিয়ে টিভি দেখেন। তখনো তাদের মধ্যে কথা বন্ধ। ১২টার দিকে সালমানের মোবাইলে একটি ফোন আসে। তিনি বাথরুমে গিয়ে কথা বলে বেরিয়ে টিভি বন্ধ করে অডিও ক্যাসেট ছাড়েন। এ সময় আরও একটি ফোন আসে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। উত্তেজিত হয়ে সালমান মোবাইল ফোনসেটটি ভেঙে ফেলেন। ক্ষুব্ধ সামিরা ব্যাগ গুছিয়ে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ফুফুর বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হন। সালমানের পিএ আবুল ইন্টারকমে দারোয়ানকে গেট না খুলতে নিষেধ করেন। সামিরা ফিরে এলে সালমান তাকে ফুফুর বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ৬ সেপ্টেম্বর সকালে ‘তুমি শুধু তুমি’ ছবির শুটিংয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সালমান ঘুমাতে থাকেন। বাজারে পাঠানো হয় তার দেহরক্ষী দেলোয়ারকে। এ সময় কমরউদ্দিন তার ছেলের ফ্ল্যাটে আসেন। সালমানকে বলেন, মা, ভাই ও তাকে নিয়ে সিলেটে যাবেন। এ সময় সিদ্দিক নামের এক প্রযোজকও আসেন। কমরউদ্দিন ও সিদ্দিক চলে যাওয়ার পর সামিরা তার বেডরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। বেলা ১১টার দিকে সালমান ঘুম থেকে উঠে দুই কাজের মেয়ের একজনকে ডেকে চা ও পানি খান। কিছুক্ষণ পর ড্রেসিংরুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা লক করে দেন। ঢোকার আগে আবুলকে বলে যান, তাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে। সাড়ে ১১টার দিকে আবুল সামিরাকে জাগিয়ে বলেন, অনেকক্ষণ আগে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেও তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সামিরা দরজার ডুপ্লিকেট চাবি খুঁজতে থাকেন। পৌনে ১২টায় ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে আবুল ও সামিরা ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে দেখেন ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছেন সালমান। সামিরা ও দুই কাজের মেয়ে সালমানকে উঁচু করে ধরেন। পাশের বাসার কাজের মেয়ে দড়ি কেটে সালমানকে নামিয়ে আনেন। দড়িটি ছিল ব্যায়ামের যন্ত্র থেকে বের করা। নামানোর পর পাশের বাসার কাজের মেয়েটি বলে, ‘শরীর এখনো গরম। উনি মরেননি।’ তখন মাথায় ও গায়ে তেল মালিশ করা হয়। এ সময় মে ফেয়ার বিউটি পারলার থেকে সামিরার বান্ধবী রুবি এসে শুশ্রƒষায় অংশ নেন। হাউজিং কমপ্লেক্সের ম্যানেজারও আসেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চলচ্চিত্রের প্রোডাকশন ম্যানেজার সেলিম এসে সালমান শাহকে মরার মতো পড়ে থাকতে দেখে সালমানের বাবা কমরউদ্দিনকে খবর দেন। খবর পেয়ে কমরউদ্দিন, সালমানের মা নীলা চৌধুরী, ভাই শাহরান ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। তারা গিয়ে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য লিফট দিয়ে নামাতে যান। এ সময় লিফটের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ১৫ মিনিট দেরি হয়। পরে তাকে নামিয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী রমনা থানায় অপমৃত্যু মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে মা নীলা চৌধুরী সালমানের স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়িসহ কয়েকজনকে আসামি করে আদালতে হত্যা মামলা করেন। নীলা চৌধুরী অভিযোগ করেন, সামিরার সঙ্গে ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং এ দুজন মিলে সালমানকে হত্যা করেছে। সামিরা পাল্টা অভিযোগ করেন, নীলা চৌধুরীই আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ অনেক পুরুষকে তার বাড়িতে নিয়ে আসতেন এবং এটা নিয়ে সালমান ও তার বাবা নীলার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ ছাড়া সামিরা পুরো ঘটনার জন্য সালমান-শাবনূরের প্রেমকেও দায়ী করেন। সালমানভক্ত এবং তারই ঘনিষ্ঠজনদের মতে এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। এই হত্যা রহস্যের কূলকিনারা আজ পর্যন্ত হয়নি।

 

স্মরণে সালমান

খুলনায় আমরা একই স্কুলে পড়তাম : মৌসুমী

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে প্রথম জুটি বেঁধে আমরা অভিনয় করি। দুজনেরই প্রথম ছবি এটি। শুধু অভিনয় জীবনের সঙ্গীই নয়, সালমান ছিল আমার আশৈশব বন্ধু, খুলনায় একই স্কুলে পড়তাম। যদিও মাত্র চারটি ছবিতে আমি সালমানের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু আমার প্রকৃত বন্ধু ছিল সে। সে একাধারে ভালো অভিনেতা ও অসাধারণ মনের মানুষ ছিল। তার তুলনা সে নিজেই ছিল। আজ এতটা বছর পরও তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো কখনো পারব না তাকে ভুলে যেতে। সালমান, বন্ধু যেখানেই থাকিস তুই আছিস আগেরই মতো বন্ধু হয়ে মনের গহিনে।’

 

সালমান গড গিফটেড : সোহানুর রহমান সোহান

কিছু মানুষ ক্ষণজন্মা থাকে। সালমানও সে রকম একজন। ফিল্মে মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টা ছবি করে তরুণ থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার মন কেড়েছে সে। সালমান ছিল গড গিফটেড। একজন হিরোর যে রকম হওয়া উচিত সে রকমই ছিল সে। তাকে ডাকলেই পাওয়া যেত। এখনকার হিরোদের সালমানের কাছ থেকে এই শিক্ষাগুলো নেওয়া উচিত। একজন ভালো মানুষও ছিল সে। তাই আজ ২২ বছর  পরেও সালমানকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা যেই সেই আলোচনা নয়। আমি তো টের পাচ্ছি। এই চ্যানেল, সেই পত্রিকা। সবাই তাকে স্মরণ করছে।

 

ওর মধ্যে ভীষণ ছেলেমানুষী ছিল : শাবনূর

ওর মধ্যে ছেলেমানুষী কাজ করত বেশি। খুব প্রাণচঞ্চল একজন মানুষ ছিল। সালমানের দ্বিতীয় ছবি ‘তুমি আমার’-এ নায়িকা হই আমি। আমরা জুটি হয়ে আরও ১৩টি ছবিতে অভিনয় করেছি। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সালমানের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় আমার। মানুষ হিসেবে ছিল অনন্য। খুব শৌখিনও ছিল। গাড়ির প্রতি ছিল তার বেশি আগ্রহ। সালমান আমাকে ‘পিচ্চি’ বলেই ডাকত। সালমানের নিজের ছোট বোন ছিল না। তাই আমাকে ছোট বোনের মতোই দেখত। সালমান অনেক বড় মনের মানুষ ছিল। কোনো অহংকার ছিল না তার মধ্যে।

 

 

সালমানের কর্মযজ্ঞ

সালমান শাহ অভিনীত ছবি

কেয়ামত থেকে কেয়ামত, তুমি আমার, অন্তরে অন্তরে, সুজন সখী, বিক্ষোভ, স্নেহ, প্রেমযুদ্ধ, কন্যাদান, দেনমোহর, স্বপ্নের ঠিকানা, আঞ্জুমান, মহামিলন, আশা ভালোবাসা, বিচার হবে, এই ঘর এই সংসার, প্রিয়জন, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, সত্যের মৃত্যু নেই, জীবন সংসার, মায়ের অধিকার, চাওয়া থেকে পাওয়া, প্রেম পিয়াসী, স্বপ্নের নায়ক, শুধু তুমি, আনন্দ অশ্রু, বুকের ভেতর আগুন [মোট ছবি ২৭টি]

বিজ্ঞাপনচিত্র

মিল্ক ভিটা, জাগুরার কেডস, গোল্ড স্টার টি, কোকাকোলা, ফানটা

ধারাবাহিক নাটক

পাথর সময়, ইতিকথা

একক নাটক

আকাশছোঁয়া, দোয়েল, সব পাখি ঘরে ফেরে, সৈকতে সারস, নয়ন, স্বপ্নের পৃথিবী।

সর্বশেষ খবর