দেশীয় চলচ্চিত্রের গুণী পরিচালকের তালিকায় ওপরের সারিতেই থাকবে চাষী নজরুল ইসলামের নাম। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ক্যামেরার পেছনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর বিক্রমপুর শ্রীনগর থানার সমষপুর গ্রামে জন্মেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন মা-বাবার জ্যেষ্ঠ পুত্র। বাবা মোসলেহ উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন ভারতের বিহারে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। চাষীর পূর্বপুরুষরা ছিলেন লস্কর বংশের। চাষীর নাম রেখেছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তাঁর সঙ্গে রাজনীতি করতেন চাষীর মামা চাষী ইমাম উদ্দিন। নবযুগ ও লাঙ্গল পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
সেই সূত্রেই এক দিন ফজলুল হককে একটা নাম দিতে বলা হলে তিনি চাষী ইমাম উদ্দিনের ‘চাষী’ আর কাজী নজরুল ইসলামের ‘নজরুল ইসলাম’ মিলিয়ে নাম দেন ‘চাষী নজরুল ইসলাম’। বাবার চাকরিস্থল জামশেদপুরে চাষী নজরুল ইসলামের শৈশব কাটে। শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৬১ সালে ‘আছিয়া’ ছবির মাধ্যমে খ্যাতিমান পরিচালক ফতেহ লোহানীর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। এর দুই বছর পর ‘দুই দিগন্ত’ ছবিতে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার ওবায়েদ-উল-হকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনিই প্রথম পরিচালনা করেন মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’। এটি মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে। ১৯৫৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর সংসারের বড় ছেলে হিসেবে এজি অফিসের পোস্ট-সর্টার হিসেবে ১৯৬৯ পর্যন্ত চাকরি করেছেন। এফডিসি মাত্র তখন গড়ে উঠছে। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে ফতেহ লোহানীর প্রধান সহকারী আউয়াল সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি। একই সঙ্গে আলী মনসুরের কৃষ্টি সংঘের সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করেন। ছবির প্রতি তাঁর ভালো লাগার কথা জেনে খালাতো বোনের স্বামী সৈয়দ আউয়াল এক দিন চাষীকে পরিচয় করিয়ে দেন পরিচালক-অভিনেতা ফতেহ লোহানীর সঙ্গে। তখন ‘আছিয়া’ ছবির কাজ চলছিল। এতে স্বল্প উপস্থিতির একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য চাষীকে নেওয়া হয়। কিন্তু পরদিন তাঁকে দেওয়া হয় সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব। ১৯৬১ সালের জুন মাসে ক্যামেরার পেছনে কাজ শুরু করেন চাষী। পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত বেতার ও টেলিভিশনে সান্ধ্যকালীন অভিনয় চালিয়ে যান তিনি। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে চারবার সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড, যৌথ প্রযোজনা কমিটি, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সদস্য ছিলেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন ফুটবল লিগ অ্যাসোসিয়েশনের (ডামফা) ফুটবল সম্পাদক, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ আর ১৯৯৭ সালে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৪ সালে ভূষিত হন একুশে পদকে। অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সংগ্রাম’ ছবির জন্য বাংলাদেশ সিনে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড (১৯৭৪), শের-ই-বাংলা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৮), স্যার জগদীশচন্দ্র বসু স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জহির রায়হান স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জহির রায়হান আজীবন সম্মাননা, আন্তর্জাতিক কালাকার পুরস্কার (২০০৫), ফজলুল হক স্মৃতি পদক (২০০৫) প্রভৃতি। ১৯৬৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত কাজী পরিবারের কে জি আহমেদের মেয়ে জ্যোৎস্না কাজীকে বিয়ে করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি এই কীর্তিমান চলচ্চিত্রকার ইন্তেকাল করেন।