একটা সময় ছিল, সন্ধ্যা নামার আগেই টেলিভিশনের সামনে বসে যেত গোটা পরিবার। হাতে গরম চা, চোখেমুখে কৌতূহল আর প্রত্যাশা। নাটক, খবর, সিনেমা সবকিছুর ফাঁকে ছিল এক অপার আনন্দের বিরতি ‘বিজ্ঞাপন’। তখন বিজ্ঞাপন মানে শুধু বিরতি নয়, এক খণ্ড আনন্দ। সেসময় আজকের মতো বিরক্তিকর ‘স্কিপ অ্যাড’ নয় বরং ৩০ সেকেন্ডের মুগ্ধকর শিল্পকর্ম, যেখানে গান ছিল, গল্প ছিল, জীবনের ছোঁয়াও ছিল।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন মানেই যেন এক জাদু। ‘যেখানে আনন্দ, সেখানে কোকাকোলা’ এই জিঙ্গেলটা তখনকার প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হতো। ’৯৫ কিংবা ’৯৬ সালের সেই টিভি বিজ্ঞাপনে সিনেমার খলনায়ক জাম্বু হয়ে উঠেছিলেন রূপকথার দৈত্য, যিনি গাড়ি চাইতে আসা তরুণকে বলছেন, ‘আগে কোকাকোলা খা!’ আর দেশের মানুষ? তারা যেন সত্যিই তৃষ্ণায় কাতর হয়ে উঠেছিল কোকের বোতলে থাকা পুরস্কারের আশায়। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কোকাকোলা কিনে ছিপি স্ক্র্যাচ করে দেখার উত্তেজনা আজও অনেকে ভুলতে পারেন না। আরেক দিকে ছিল পেপসি। সেসময় আইয়ুব বাচ্চু মডেল হয়েছিলেন পেপসির। শিক্ষকের কানমলা আর সংলাপ ‘তুমি কোনদিনও মিউজিসিয়ান হতে পারবে না’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। অন্যদিকে জেমসের মডেল হয়ে করা ‘একটা পেপসি?’ ছিল তুমুল জনপ্রিয়। তবে তরুণ-তরুণীর হাসি, তারুণ্যের দুষ্টু আবেদনে ভরপুর মডেল শুভ্রদেব আর সংলাপ ‘পেপসি আর আছে কি?’-সব মিলে ছিল নিখাদ মজা। ‘লাইফ ইজ কুল, লাইফ ইজ পেপসি’-এ ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল ঢাবি, ইডেন, নর্থসাউথের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। পেপসির বিজ্ঞাপনগুলো যেন জীবনের গতি, প্রেম আর উৎসবের প্রতীক ছিল। তবে ‘আর সি কোলা’র নোবেল-পুথির ‘তোমার জন্য মরতে পারি ও সুন্দরী’ জিঙ্গেলটিও সবার স্মৃতিতে এখনো ভাসে।
বিটিভির পর্দায় তখন সকাল-বিকাল ঝলমল করত রেডকাউ, ডিপ্লোমা, অ্যাংকর মিল্কের বিজ্ঞাপন। ‘যে দেশে গরু খায় বারোমাস সবুজ ঘাস...’ এই লাইনটা শুনলেই চোখে ভেসে উঠত নিউজিল্যান্ডের সবুজ প্রান্তর। ছোটবেলার চোখে নিউজিল্যান্ড মানে তখন ছিল দুধ আর গরুর দেশ! আর ‘আম্মু তুমি লক্ষ্মীইইই’ অ্যাংকর মিল্কের সেই মিষ্টি সংলাপ তো আজও বাঙালি শিশুমনের চিরচেনা স্মৃতি। আর চায়ের কথা না বললেই নয়। ‘ফিনলে চা, আসল চা’ আবুল হায়াতের মুখে বলা এই সংলাপ যেন বিটিভির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। বিজ্ঞাপনের শেষে তার মেয়ের প্রশ্ন ‘আসল চা কেন?’ তার উত্তরেই যেন ফুটে উঠেছিল এক নিখাদ নির্মাণশৈলী। আফসানা মিমি যখন একই সংলাপে হাজির হলেন, তখন চায়ের গন্ধ যেন ভরে উঠল পর্দাজুড়ে। অন্যদিকে ‘এইচ-আর-সি চা’ বা ‘ডানকান চা’ বিজ্ঞাপনগুলোও ছিল তরুণ প্রজন্মের টি-ব্রেকের সঙ্গী। জিঙ্গেলের শব্দে, চা পাতার রঙে আর হাসিতে মিলেমিশে যেত এক টুকরো বিকাল। খ্যাতিমান শিল্পী নচিকেতার কণ্ঠে একটা বিজ্ঞাপন ছিল ইস্পাহানি মির্জাপুর চায়ের। অসাধারণ ছিল সেই বিজ্ঞাপন, মনকাড়া ছিল জিঙ্গেলের কিছু কথা। ‘বৃষ্টিদিন নাও ভাসে...’ বিজ্ঞাপনটি যেন এক গল্প। তাতে যেন ভেসে উঠেছিল বৃষ্টিদিনের গল্প। নৌকা করে মাছ ধরা। বর্ষাদিনে বসার ঘরে চায়ের সঙ্গে আড্ডা ইত্যাদি। সেই আবেগঘন জিঙ্গেল আজও বহুজনের হৃদয়ে উঁকি দেয়। মনির খান শিমুল ও রিয়ার করা ‘ইস্পাহানির বিজ্ঞাপনটিরও সমাদৃত হয়। ৯০ দশকের বিজ্ঞাপন স্মৃতিচারণা অসম্পূর্ণ রয়ে যায় যদি মিতা নূরের সেই ‘আলো আলো বেশি আলো’র অলিম্পিক ব্যাটারির বিজ্ঞাপনটির কথা না বলি। আরেকটি হলো বাতির রাজা ফিলিপস এর ‘ও মানিক কি বাত্তি লাগাইলি?’ আরেকটি বিজ্ঞাপনকে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা দেওয়া যায় সেটি হলো ফেরদৌস ওয়াহিদের খুশখুশে কাশি দূরকারী ম্যাটসিলস লজেন্সের টিভি কমার্শিয়ালটি। কসমেটিকসের দুনিয়ায় তখন রাজত্ব করছিল ম্যানোলা। ‘ম্যানোলা মানে টলমল শিশিরের লাবণ্য’-এই সুরেলা বিজ্ঞাপনটি যেন সকালবেলার শিশিরের মতোই কোমল। পরে এলো কেয়া কসমেটিকস আর নোবেল-মৌ জুটির হাত ধরে ভালোবাসার সংজ্ঞা পেল নতুন রূপ। ‘ভালবাসা মানে তুমি আর আমি...’-এই লাইনটা শুধু বিজ্ঞাপন নয়, হয়ে উঠেছিল এক প্রজন্মের প্রেমের প্রতীক। কিউট রোমান্স ট্যালকম পাউডারের সুমনা হকের কণ্ঠে সেই ঐতিহাসিক জিঙ্গেল ‘তুমি ছাড়া আমি যেন আমি নই’, যেন আজও মনে ভাসে। মেরিল বেবি পাউডারের ‘সোনা জাদু মলি লে’ বা রিয়ার করা ‘মেরিল লিপজেল’ আজও অমলিন। সেসময়ে রোমানা পেইন্টসের বিজ্ঞাপনগুলোও ছিল তুমুল আলোচিত। ‘সময় তো বদলায়, বদলায় মন’-এই জিঙ্গেল শুধু রং নয়, সময়ের বদলের এক কাব্যও ছিল। পেইলাক বা অ্যাকুয়া পেইন্টসের বিজ্ঞাপনগুলোও গাইত জীবনযাপনের গল্প, যেখানে দেয়াল মানে শুধু দেয়াল নয়, একটা স্বপ্নের ক্যানভাস। বার্জার পেইন্টের বিজ্ঞাপনে মনির শিমুল আর লামিয়া তাবাস্সুমের করা বিজ্ঞাপন, রক্সি পেইন্ট, মোল্লা সল্ট, জুঁই নারিকেল তেল (আমরা মন এখনো হারায়), নিপ্পন টিভি (নিপ্পন হাজির), পেইলাক পেইন্ট, ডিপ্লোমা গুঁড়ো দুধ, ফিনলে চা, লিপটন চা, বম্বে পটেটো স্টিকস (একা একা খেতে চাও, দরজা বন্ধ করে খাও), স্টারশিপ কনডেন্স মিল্ক, হুইল (আমার বাংলাদেশ), আজাদ প্রোডাকস, কেয়া, ক্যামেলিয়া সাবান, লাক্স সাবানের (শাকিলা জাফর)-এর বিজ্ঞাপন, গোয়ালিনী, কুল শেভিং, তিব্বত ল্যাদার শেভিং ক্রিম, হেনোলাক্স ইপসিতা শ্রাবণী), মেরিল স্পাস সোপ, সিটিসেল ‘পালাবি কোথায়?’ (তিশা-রুমি), ড্যানিস কনডেন্স মিল্কসহ অনেক বিজ্ঞাপন জনপ্রিয় হয়েছিল। আর কে ভুলতে পারে ‘ইকোনো বলপেন। ‘যুগের সাথে চলো, ইকোনো লিখে ভালো’- এই লাইন শুনেই হাত চলে যেত কলমের দিকে। প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবালের ‘বলপেন ক্যাম্পাস’ বিজ্ঞাপনও সে সময়ের স্কুলছাত্রদের অনুপ্রেরণা ছিল।
বিটিভির শুক্রবারের বাংলা সিনেমা চলাকালে নন্দিনী, পাকিজা, সুন্দরী, জনী প্রিন্ট, বৌ রানী প্রিন্ট শাড়ি (রানী রানী বৌরানী)-এসব শাড়ির বিজ্ঞাপনের জৌলুসে চোখ ঝলসে যেত। চম্পা, বিজরী বরকতুল্লাহ, দিতি, শাবনূর, মৌসুমী, বিপাশা- তারা ছিলেন টেলিভিশনের মডেলিং দেবী। আঁচল উড়ে যেত, জিঙ্গেল বাজত, আর দর্শকের মন ভেসে যেত রঙের ঢেউয়ে। সঙ্গে সুমনা হকের সেই মিষ্টি জিঙ্গেল। আর সেই সময়ের দুই নাম না বললে গল্পটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সাদিয়া ইসলাম মৌ ও আদিল হোসেন নোবেল। তারা দুজন ছিলেন নব্বইয়ের দশকের মডেলিং রাজা-রানী। তাদের পর্দায় দেখা মানেই ছিল স্টাইল, ক্লাস আর চোখে পড়া সৌন্দর্য। সঙ্গে ছিলেন মনির খান শিমুল, তানিয়া আহমেদ, ফয়সাল আহসান, তানভীন সুইটি, পল্লব চক্রবর্তী, ফারজানা চৌধুরী রিয়া, সাব্বির আহমেদ, রোমানা খান, পাপ্পু (মোল্লাসল্ট), স্মৃতি ফাহমি (লেমন ডিউ), ফারিয়া, লামিয়া, ঈশিতা, লামিয়া, জারা, সোনিয়া-যাদের ভঙ্গিমা ও হাসি আজও দর্শকের মনে রয়ে গেছে। তখন ‘বাটা পাপা’ গানের তালে তালে সবাই নাচত। আর শিশুদের কাছে প্রিয় ছিল আলোজ্বলা কেডসের ‘জাম্প জাম্প জাম্প কেডস’র বিজ্ঞাপন। কেউ রান্নাঘরে নতুন লবণ এনে স্ত্রীকে অবাক করছে (মধুমতী লবণে আছে আয়োডিন), কেউ ফ্ল্যাট কিনে আনন্দে বলছে ‘সুন্দর বাড়ি হলো, এবার সুন্দর দেখে একটা বউ আন’, বা ‘এই যে শোন! ব্রিজের কন্ট্রাক্টটা পেয়ে গেলাম’, অথবা ‘বাড়ি! আমার জন্য বাড়ি!’ বলা যায়, তখনকার বিজ্ঞাপনগুলো ছিল সত্যিকারের গল্প।