চলচ্চিত্রে নায়ক সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। হাতেগোনা নায়কের ওপর নির্ভর করে চলছে ছবি নির্মাণ। নতুন মুখের অভাব নেই। সংকট রয়েছে দক্ষ নায়কের। এতে মানসম্মত ছবি খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। দু-একজন নায়ককে যদি বছরে সিংহভাগ ছবিতে অভিনয় করতে হয় তাহলে তার পক্ষে ভালো কাজ করার সময় কোথায়। এমন আক্ষেপের কথা জানিয়ে প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচন্দা বলেন, নতুন যারা আসছে তাদের মধ্যে অল্প পরিশ্রমে দ্রুত তারকা এবং অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার লোভ বেশি। মেধাহীনতায় ভুগছে তারা। ফলে শূন্য থাকছে ফলাফল।
নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, 'আমাদের সময় আমি, আলমগীর, সোহেল রানা, ফারুকসহ অনেকে ছিলাম। সবাই সমান দক্ষতায় কাজ করে দর্শক মন জয় করেছি। দর্শক আনুকূল্য পেতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাদের। এফডিসি বা আউটডোরে শুটিংয়ের সময় এসি দূরে থাক, পাখা পর্যন্ত পেতাম না। বিশেষ করে আউটডোরে গেলে এখনকার মতো ভালোমানের হোটেলেও উঠতে পারতাম না। অনেক সময় শুটিংয়ের বিরতিতে মাটিতে পড়ে ঘুমিয়েছি। তার পরও এসব নিয়ে কখনো আফসোস ছিল না। কারণ চলচ্চিত্র আর অভিনয়কে ভালোবেসেই ত্যাগ স্বীকার করতে এ জগতে এসেছি। এর সুফলও পেয়েছি। তা ছাড়া আমাদের সময় অনেক জ্ঞানী-গুণী নির্মাতা ছিলেন। তারা শতভাগ কাজ আদায় করে নিতেন। এখন সে অবস্থা আর নেই। তাই যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।'
ষাটের দশকে রহমান, নাদিম, আজিম, রাজ্জাক, সত্তর দশকে আলমগীর, সোহেল রানা, ফারুক, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবাল, উজ্জ্বল, ওয়াসিম, জাভেদ, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন, আশির দশকে সুব্রত, সাত্তার, সোহেল, বাপ্পারাজসহ অনেকে চলচ্চিত্রে আসেন এবং দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেন। নব্বই দশকে পাওয়া যায় ওমর সানি, নাঈম, সালমান শাহ, শাকিল খান, মান্না, কাজী মারুফ, অমিত হাসান, আমিন খান, রিয়াজ, ফেরদৌস, শাকিব খান প্রমুখকে। তারা সবাই দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় দুই নায়ক সালমান শাহ ও মান্নার অকাল মৃত্যু এবং অনেক নায়ক অনিয়মিত হয়ে পড়লে ২০০০ সালের প্রায় শুরু থেকে শাকিব খানকে একাই নায়কের ভার বইতে হয়। এর মধ্যে ডিপজল কিছু দিনের জন্য নায়ক চরিত্রে জনপ্রিয়তা নিয়ে শাকিবের পাশাপাশি অভিনয় করেন। এক সময় তিনিও সরে যান। এরপর চলচ্চিত্রের নির্মাণ আঙ্গিক দিয়ে দৃষ্টি কাড়েন এমএ জলিল অনন্ত। তিনি অবশ্য নিজ প্রোডাকশন হাউসের বাইরে অভিনয় না করায় নিয়মিত তাকে পাওয়া যায় না। ফলে এখনো ঢাকাই ছবির ভার বয়ে চলতে হচ্ছে শাকিব খানকে।
এ সময়ে চলচ্চিত্রে নায়ক হয়ে আসেন ইমন, নিরব, আরজু, সায়মন, বাপ্পি, আমান, সাগর, নিলয়, রোজ, জায়েদ খান, আরিফিন শুভসহ অনেকে। এদের মধ্যে আরিফিন শুভ এখন পর্যন্ত আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন। কিন্তু নির্মাতারা তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না বলে জ্বলে উঠতে গিয়েও বারবার নিভে যাচ্ছেন তারা। অভিনয় শেখার কোনো প্রতিষ্ঠানও নেই। এমন মন্তব্য করেছেন চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ। ফলে ঢাকাই ছবিতে নায়ক সংকট শুধু চলমান নয়, আগামীর জন্য তৈরি হচ্ছে চরম অনিশ্চয়তা ও বিশাল শূন্যতা।
চলচ্চিত্রে শিল্পী সংকটে বিভিন্ন সময় ব্যক্তিগতভাবে অনেক প্রযোজক-পরিচালকই নতুন মুখ উপহার দেন। আস্থার সংকটে সেই সব নতুন মুখ অকালেই ঝরে যান। সংকট কাটাতে সুপার হিরো-সুপার হিরোইন নামে একটি প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখান থেকেও নির্ভরশীল কোনো শিল্পী বের হয়ে আসেননি। দু-একজন এখনো কাজ করছেন বটে, কিন্তু শিল্পী হতে পারেননি। চলচ্চিত্রে শিল্পী সংকট কাটাতে এফডিসির উদ্যোগে 'নতুন মুখের সন্ধানে' শিরোনামে যে কার্যক্রম এক সময় চালু ছিল তাও নানা জটিলতায় বন্ধ। ফলে চলচ্চিত্রে নায়ক সংকট কোনোভাবেই কাটছে না।