সরকারি অনুদানের ছবির কাজ শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না। অনুদানপ্রাপ্ত বেশির ভাগ ছবির ক্ষেত্রেই এই অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে নিয়মেই পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি কোনো কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থাও নেই। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা ছটকু আহমেদ বলেন, চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান মানে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অনুদান পাওয়ার পর অনেক নির্মাতা ‘একটি ছবি নির্মাণে এই অর্থ যথেষ্ট নয়’ এই অজুহাত দেখিয়ে ও অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। অথচ নির্মাতারা অনুদানের অর্থের পরিমাণ জেনেই আবেদন করেন। তাহলে অর্থ পাওয়ার পর কেন ছবি নির্মাণে খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করা? বর্তমানে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে ৫০ ও শিশুতোষ চলচ্চিত্রের জন্য ৪০ লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে পৃথকভাবে দেওয়া হয় চিত্রনাট্যের জন্য ৫০ হাজার টাকা। নির্মাতারা অভিযোগ করে বলেন, এক অর্থবছর শেষ হয়ে নতুন অর্থবছরের ছবির কাজ শুরু হলেও আগের অর্থবছরের চিত্রনাট্যের অর্থ আর পাওয়া যায় না। এর জন্য প্রতিনিয়ত মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিতে হয়। সব মিলিয়ে সরকারি অনুদানের টাকা নিয়ে নয়-ছয় কোনোভাবেই থামছে না। আরেকটি অভিযোগ হলো চিত্রনাট্যের সঙ্গে জমা দেওয়া শিল্পীর তালিকায় খ্যাতনামা শিল্পীদের নাম জমা দিয়ে অনুদান আদায়ের পর উল্লিখিত শিল্পীদের না নিয়ে ছোটখাটো শিল্পীকে নামমাত্র অর্থ বা বিনা অর্থে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। আবার শিল্পী না নিয়ে নির্মাতা নিজের আত্মীয়স্বজন দিয়ে অভিনয় করান। এরপরও কারচুপি আছে। আর তা হলো স্পন্সর বা একজন প্রযোজককে প্রলুব্ধ করে তার কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে কোনোভাবে ছবির কাজ শেষ করে তা টিভি চ্যানেলের কাছে বিক্রি করে দিয়ে সেই নির্মাতা অসাধু পথে লাভবান হন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মোট ৪১টি ছবি নির্মাণের লক্ষ্যে অনুদান দেওয়া হলেও মুক্তি পেয়েছে মাত্র ১৫টি। সরকার মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৭৬-৭৭ সাল থেকে চলচ্চিত্রে অনুদানের প্রথা চালু করে। মাঝখানে বন্ধ থাকলেও ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে নিয়মিতভাবেই অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে মোট ৪১টি চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুক্তি পেয়েছে মাত্র ১৫টি ছবি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র অনুদানের প্রথম চেক প্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে। তবে বিশেষ অবস্থায় অনুরোধ সাপেক্ষে পরিচালক ওই সময় বৃদ্ধি করতে পারেন। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক নির্মাতা ছবি নির্মাণে বছরের পর বছর পার করছেন। মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশের কারণে তারা এ ধরনের কাজ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে নির্মাতাদের কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হয় না। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে অনুদান দেওয়া হয় ‘নমুনা’ নামের একটি চলচ্চিত্রকে। যেটি পরিচালনা করেছেন এনামুল করিম নির্ঝর। ছবিটি এখনো মুক্তি পায়নি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের অনুদান পাওয়া জুনায়েদ হালিমের ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের গল্প’ ছবিটি নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় এখনো মুক্তি পায়নি। এ ছাড়া ২০১০-১১ অর্থবছরে ফারুক হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ ও মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘ধোঁকা’ ছবিগুলোও একই অবস্থায় রয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মারুফ হাসান আরমানের ‘নেকড়ে অরণ্যে’, প্রশান্ত অধিকারীর ‘হাডসনের বন্দুক’, সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকীর ‘একা একা’, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ক্যাথরিন মাসুদের ‘কাগজের ফুল’ টোকন ঠাকুরের ‘কাঁটা’, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ড্যানি সিডাকের ‘কাঁসার থালায় রূপালি চাঁদ’, জানেসার ওসমানের ‘পঞ্চসঙ্গী’ ছবিগুলো আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। নমুনা ছবির পরিচালক এনামূল কবির নির্ঝর বলেছেন, ‘আমার ছবিটির কাজ শেষ করে ২০০৯ সালে সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছিলাম। এরপর আমাকে ছবিটির বেশকিছু দৃশ্য পুনরায় চিত্রগ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সেজন্য অনেক টাকা দরকার। যে কাজটি এখন আমার জন্য করা সম্ভবপর নয়। যখন আমাকে অনুদান দিয়েছিল তখন তো আমার চিত্রনাট্য দেখেই দিয়েছিল। এজন্য ছবিটি এখনো ওই অবস্থায়ই আছে।’ অনুদানের অর্থে ছবি নির্মাণ করা আবু সাইয়ীদ বলেন, ‘একটি ছবি নির্মাণ করতে দেড় বছরের বেশি সময় লাগা উচিত নয়। অনুদান প্রদান কমিটিতে দুর্বলতা থাকতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অ্যাকশনে আছি। যে ছবিগুলো এখনো নির্মিত হয়নি, সেগুলো যাতে হয় এজন্য নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছি।
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘নেকড়ে অরণ্য’ ছবির জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত পরিচালক মারুফ হাসান আরমান, একই অর্থবছরে ‘একা একা’ চলচ্চিত্রের জন্য সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘যৈবতী কন্যার মন’ চলচ্চিত্রের জন্য নারগিস আক্তার, একই অর্থবছরে ‘খাঁচা’ চলচ্চিত্রের জন্য খান শরফুদ্দীন মোহাম্মদ আকরাম ও ‘কাঁটা’ চলচ্চিত্রের জন্য টোকন ঠাকুরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নিয়েছিল মন্ত্রণালয়। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, সরকারি অনুদানের ছবি কে দেখে, কোথায় প্রদর্শন হয়, এসবের নির্মাণকাজ কখন শেষ হয়, আদৌ শেষ হয় কিনা— এই বিষয়গুলো সরকারসহ কেউই জানে না। মানে সরকারি অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করার এক বিরাট খাতের নাম হচ্ছে ‘চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান প্রথা’। এই অনুদান প্রথা বন্ধ করে ওই অর্থ চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অন্য খাতে ব্যয় করা যেতে পারে।