শিরোনাম
১৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০১:২৭

হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী...

মেহের আফরোজ শাওন

হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী...

১৯৯৬ এর ১২ জানুয়ারী। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় একটি স্বপ্নের। স্বপ্নের নাম ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’। প্রিয় মানুষ, অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর (পরবর্তীতে মাননীয় সংসদ সদস্য এবং সংস্কৃতি মন্ত্রী) এর হাত দিয়ে স্বপ্নের প্রথম ইটটি গাঁথলেন হুমায়ূন আহমেদ। স্বপ্নের শুরুটা বেশ অনেক বছর আগে...

নিজগ্রামে মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় বেশ দূরের আরেক গ্রামে অন্যের বাড়িতে জায়গীর থেকে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন হুমায়ূন এর বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ! যে বাড়িতে জায়গীর থাকতেন সেখানে তরকারীতে লবন কম হওয়ায় আরাম করে খেতে পারতেন না তিনি। ‘মনে কষ্ট পাবে’ এই ভেবে মুখ ফুটে বাড়তি লবন চেয়ে নিতেও পারেননি! ছুটিতে বাড়ি এলে ফিরে যাবার সময় বাঁশের চোঙায় করে নিয়ে যেতেন বাড়তি লবন! সেটা শেষ হয়ে গেলে আবার পরবর্তী ছুটির অপেক্ষা! 

এরপর জীবনের কয়েকধাপ পার করে যখন সংসারজীবন শুরু করলেন তখন কোনো এক জোছনা রাতে জীবনসঙ্গিনীর সাথে গল্পে গল্পে হয়তো বলেছিলেন বাড়ি থেকে বহুদূরের লবনহীন-স্বাদহীন জায়গীর জীবনের কথা! সে কথা স্ত্রী আয়েশা ফয়েজকে বেশ আবেগপ্রবণ করে। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্বামীর সেইদিনগুলোর কথা ভেবে একদিন বড় সন্তানের কাছে বলেছিলেন তাঁর এক আবদারের কথা। শ্বশুরবাড়ি কেন্দুয়ার কুতুবপুর অঞ্চলে তখনও কোনো মাধ্যমিক স্কুল হয়নি! স্কুলের অবর্তমানে হয়তো অন্যগ্রামে গিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ! কিন্তু সেটা সংখ্যায় অনেক কম! ইশশশ একটা স্কুল যদি করে দেয়া যেত ওখানে!

মা’এর আবদার হুমায়ূনের স্বপ্নে পরিণত হয়ে গেল তক্ষুণি। কিন্তু কি হবে সেই স্কুলের নাম! কেউ বলেন ‘হুমায়ূন আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ তো কেউ বলেন মা’এর কাঙ্ক্ষিক স্কুল মা কিংবা বাবার নামে হওয়া উচিত। হুমায়ূন ভাবেন অন্যকথা। মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের নামে হবে এই বিদ্যাপীঠ- ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’!

বন্ধু বেলাল বেগকে সঙ্গে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে তিনি রওনা হন গ্রামে। এই জায়গা সেই জায়গা দেখেন, কোনোটাই একবারে কিনে নেয়ার মতো টাকা জোগাড় করতে পারেন না। তারপরও ধাপে ধাপে অল্প অল্প করে কিনে নেন ৩০ কাঠা জমি! ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাশাপাশি স্থপতিবন্ধু ফজলুল করিমের নকশায় নির্মাণ করেন কেন্দুয়া অঞ্চলের শহীদ মুক্তিযাদ্ধাদের স্মরণে শহীদ মিনার। প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের হাত দিয়ে উদ্বোধন করেন সেই শহীদ মিনার।

‘কুতুবপুরের বাইসাব’ হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সঞ্চয়ের পুরোটা দিয়ে তিলে তিলে গড়তে থাকলেন মা আয়েশা ফয়েজের স্বপ্ন... বেশকিছু নাটকও তৈরী করলেন শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রকল্পের তহবিল সংগ্রহের জন্য!

স্কুলের ভবন তৈরীর কাজ শুরু হলো ২০০১ সালে। আমি তখন স্থাপত্যকলার ২য় বর্ষের ছাত্রী। আমার উপর অর্পিত হলো ভবনের নকশার দায়িত্ব! পরম আগ্রহে আমি ঝাঁপিয়ে পরলাম জীবনের প্রথম সত্যিকারের ভবন নকশার কাজে! তরুণ আমার চোখে তখন পৃথিবীর সুন্দরতম বিদ্যালয়টির নকশা করার স্বপ্ন! একেকবার পাগলামী কিছু চিন্তা করি পরক্ষণেই কাঠামোগত (structural) সমস্যার কারণে পিছিয়ে পড়ি। তখন পরম মমতায় স্থপতি ফজলুল করিম সমস্যার সমাধান করে দেন।

একটু একটু করে নির্মিত হতে থাকে শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের ভবন! নিজে প্রকল্প এলাকায় থেকে কাজ তরান্বিত করতে সাহায্য করেন হুমায়ূনবন্ধু বেলাল বেগ। প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে বেলাল বেগ এর নাম লিখেন হুমায়ূন। ২০০৬ সালে পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয় স্কুলের কার্যক্রম। একেবারে ধীর গতিতে চলতে থাকে তা। ছাত্র ছাত্রী পাওয়াটাই কঠিণ হয়ে দাড়িয়েছিল ঐ এলাকায়! দায়িত্ব নিয়ে স্কুলটি চালানোর জন্য তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অনুরোধ করেন তিনি। কোনো কাজ হয়না। হতাশ হয়ে একবার ভবনটাকে জনসেবামূলক হাসপাতাল করে ফেলবার কথাও ভাবেন! মা আয়েশা ফয়েজ মন খারাপ করে সায় দিয়ে বলেন- “আমার ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে হয়তো একটা বোঝা তুলে নিলি মাথায়!”

২ বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার পর ২০০৮ সালে বিদ্যাপীঠটি ঘুরে দাঁড় করানোর চেষ্টায় নতুন করে হাত লাগালেন হুমায়ূন আহমেদ। ততদিনে বেলাল বেগ পারিবারিক প্রয়োজনে প্রবাসী হয়েছেন। স্কুলের পাশে আমরা পেলাম আমাদের প্রিয় নানাজী- মুক্তিযাদ্ধা, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীকে। ৭২ বছর বয়েসী তরুণ নানাজীকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্কুলটির সঠিক পরিচালনার পথে। শুধুমাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেনী দু’টি শাখার ৪৮ জন ছাত্রছাত্রী এবং ৫ জন শিক্ষক, ২ জন কর্মচারী নিয়ে শুরু হলো শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের নতুন পথচলা। পরবর্তী বছরে এই ৪৮ জন ৭ম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হবার পাশাপাশি ৬ষ্ঠ শ্রেনীর নতুন ব্যাচ ভর্তি হলো। তারপরের বছর আরেকটি নতুন ব্যাচ- পরের বছর আরেকটি...

২০১২ সালে হুমায়ূনের শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের প্রথম ব্যাচ স্কুলের হয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। তাদের পরীক্ষা দিতে হয় অন্য স্কুল থেকে। তখনও আমাদের মাধ্যমিক পাঠদানের স্বীকৃতি হয়নি। কেবলমাত্র নিম্নমাধ্যমিক পাঠদানের স্বীকৃতি হাতে নিয়ে ৫৯ জন সেবছর অংশ নেয় জেএসসি পরীক্ষায়। ভালো ফলাফলের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয় ৫৮ জন। সেই পরীক্ষার ফলাফল হুমায়ূন জেনে যেতে পারেননি!

২০১২, ১৯ জুলাই... হুমায়ূনহীণ ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ দিশেহারা হয়ে পড়ে! ঈদ বোনাস তো দূরের কথা- নিয়মিত বেতন হবে কি না সেই চিন্তাও বারবার আসছিল শিক্ষকদের মাথায়! এদিকে মানসিকভাবে, শারিরীকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়া আমি সাড়ে পাঁচ বছরের নিষাদ হুমায়ূন আর পৌঁনে দুই বছরের নিনিত হুমায়ূনকে নিয়ে হুমায়ূনহীণ পৃথিবীতে বৈঠাহীণ, পালহীণ নৌকায় উদ্দেশ্যবিহীণ! বিদ্যারীঠের দায়িত্ব নেব তেমন কাঁধের জোর কই আমার!!!

কিন্তু আমি যে অনেক সৌভাগ্যবান! হুমায়ূন ভাগ্যে ভাগ্যবতী। নানাজী সালেহ চৌধুরী গর্জন করে আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন- “তুমি যদি এখন এই গরীব শিক্ষকগুলার পিঠে হাত দিয়ে সাহস না দেও তো কে দিবে! বেতন বোনাস এর কথা বাদ দেও- তুমি ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াইলে এরা ২/৩ মাস বেতন ছাড়াও চলতে পারবে।”

নানাজির কথায় আমি বাঘের বল পেলাম যেন! আমার বাবা ইন্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী ঈদের বোনাস সহ শিক্ষকদের জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসের বেতন আমার হাতে দিল। হুমায়ূনের বন্ধু ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের প্রিন্সিপাল জনাব মুনীরুজ্জামান, প্রবীণ প্রকাশক আলমগীর রহমানের স্ত্রী নিষাদ নিনিতের ঝর্ণা চাচী আর আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্বর্ণা ভাবী (প্রকাশক মাজহারুল ইসলামের স্ত্রী) কে সঙ্গে নিয়ে আমি রওনা হলাম কুতুবপুর। আর নানাজি তো আছেনই।

বিদ্যাপীঠের শিক্ষকদলের দৃষ্টি আমাকে বুঝিয়ে দিল যে আমি একা নই। প্রতিষ্ঠানের সকলকে সাথে নিয়ে হুমায়ূনের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হলো শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’র লাইব্রেরি প্রাঙ্গনে।  এর ঠিক ১ বছর পর ২০১৩ সালে তাঁর বিদ্যাপীঠ এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। অংশ নেয় ৪২ জন- পাশের হার ১০০%... ফলাফলের ভিত্তিতে নেত্রকোনা জেলায় ২য় স্থান লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর শুধু এগিয়ে যাবার পালা...

২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের এমপিও ভুক্তি লাভ করে আমাদের এই প্রানের বিদ্যাপীঠ। স্থানীয় সংসদ সদস্য জনাব অসীম কুমার উকিলসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। দেশের ১০ টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত এই বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন ছাত্ররা তাদের মেধার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এই আনন্দ আমি কোথায় রাখি! আজ ১২ জানুয়ারী ২০২০। হুমায়ূন এর স্বপ্নের স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী...

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


বিডি-প্রতিদিন/ সিফাত আব্দুল্লাহ

সর্বশেষ খবর